বিপর্যস্ত কক্সবাজার বাঁচাবে কে?

কক্সবাজার দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় স্থান। এর রয়েছে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত। উপকূলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দ্বীপ, পাহাড়, নদী ও বন; সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি, যা উপভোগ করতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের শত শত পর্যটক ভিড় করছে।
এটি বেদনাদায়ক যে, এই রূপসী কক্সবাজার আজ বিপর্যস্ত, ক্ষত-বিক্ষত। সেখানে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, গৃহায়ন, বাণিজ্যিকীকরণ, গাছ কাটা, পাহাড় কাটা আর দখলবাজদের অবাধ দৌরাত্ম্য চলছে। নদী ও সমুদ্রসৈকত থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গভীর নলকূপ দিয়ে যথেচ্ছ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। এর ফলে সমগ্র কক্সবাজার আজ ঝুঁকির মুখে। এই অপতৎপরতা রোধে ১৮ মে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও সমকাল যুক্তভাবে ‘বিপর্যস্ত কক্সবাজারের পরিবেশ-প্রতিবেশ: করণীয় নির্ধারণে সেমিনার’-এর আয়োজন করে। কক্সবাজার শহরে অনুষ্ঠিত সেমিনারে ঢাকা থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির, পরিবেশ আইনজীবী সমিতি-বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখের সঙ্গে আমিও যোগ দিই। সেমিনারে জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জাহিদ ইকবালসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা, বন বিভাগ ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারাও অংশ নেন। সেই সঙ্গে ছিলেন জেলার বিশিষ্টজন, লেখক, সাংবাদিক, পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মী।
স্থানীয় ব্যক্তিদের থেকেই আলোচনা শুরু হয়। তাঁরা দখলবাজদের উদ্দেশে ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। তাঁদের আক্রমণের তীর প্রশাসন ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থার দিকেও। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন তাঁদের সীমাবদ্ধতা ও অসহায়ত্বের কথা। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, তিনি পাহাড় কাটার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান। পরে জানতে পারেন, তখন অন্য এলাকায় পাহাড় কাটা হয়ে গেছে। তিনি লোকবলের পাশাপাশি জনগণের সহযোগিতা কামনা করেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অসহায়ত্বের কারণ খোলাসা না করলেও কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না– দখলবাজরা ক্ষমতাসীনদের লোক। কর্মকর্তাদের ধড়ে কয়টা কল্লা যে, তাঁরা দখলবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন?
অনেক বনভূমি বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থার দখলে চলে গেছে। সেখানে তাদের অফিস, আবাসন ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে। সব রাষ্ট্রীয় সংস্থার লক্ষ্য– কক্সবাজারে তাদের একটি দপ্তর চাই। ধনীদেরও এখানে আবাসন চাই। নইলে তারা যেন জাতে উঠতে পারবে না।
সর্বশেষ ৭০০ একর বনভূমিতে সরকারের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ একাডেমি গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। উচ্চ আদালতের রায়ে তা স্থগিত। শেষ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। রামুর সংরক্ষিত বন এলাকায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেড়ারেশনের একটি ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটি বাস্তবায়িত হলে ৩০ হাজার গাছ কাটা পড়বে বলে বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। সমুদ্রসৈকতের তিনশ মিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা নিষিদ্ধ। অথচ সাদা চোখেই দেখা যায়, তিনশ মিটারের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এর জবাব কে দেবে? কক্সবাজার সদরসহ সর্বত্র অসংখ্য পাহাড় ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে কাগজ-কলমে এই অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে।
ভ্রান্ত নীতির কারণে চকরিয়া সুন্দরবন হারিয়ে গেছে। আশির দশকেও এখানে সুন্দরী, কেওড়া, পাইনসহ গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত ছিল। সেই সবুজের মেলা নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সরকারের অনুমতি নিয়েই চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় চিংড়ি চাষ শুরু হয়। প্রভাবশালী মহল গাছ নিধন করে ঘের করেছে। এভাবেই সুন্দরবনের ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু। চিংড়ি চাষের জন্য লোনাপানি প্রবেশের ফলে মাটিও অনুর্বর হয়ে পড়েছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে আর সেখানে গাছপালা গজাবে না।
এখন কেউ চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় গেলে বুঝতে পারবে না, এখানে সুশোভিত বন ছিল। আগামী প্রজন্ম যদি জানতে চায়, কোথায় চকরিয়া সুন্দরবন ছিল, তাদের কৌতূহল নিবারণের জন্য সেখানে একটি ফলক নির্মাণ করা যেতে পারে! কেবল সুন্দরবন নয়; যথেচ্ছ বৃক্ষনিধনে উপকূলের সবুজ বেষ্টনীও ন্যাড়া হয়ে গেছে।
সৌন্দর্যের আধার সেন্টমার্টিন এখন চরম ঝুঁকিতে। সেখানে দেড় শতাধিক আবাসিক হোটেল নির্মিত হয়েছে। সুইমিং পুলও তৈরি করা হচ্ছে। না; কেউ অনুমতির ধার ধারেনি। তবে কোনো কোনো দরবারে যে মোটা অঙ্কের নজরানা দিতে হয়েছে– তাতে সন্দেহ নেই। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, পর্যটকরা গিয়ে কোথায় থাকবেন? আসলে থাকার কী প্রয়োজন? পৃথিবীর বহু দর্শনীয় স্থান আছে, যেখানে থাকার সুযোগ নেই। ভ্রমণ শেষে ফিরে আসতে হয়। এমনকি সুন্দরবনেও তো আবাসন সুযোগ নেই। সেখানেও কি পর্যটকদের জন্য হোটেল নির্মাণ করা হবে?
বনভূমিতে প্রভাবশালীদের আধিপত্য। জানা গেছে, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম নিয়মবহির্ভূতভাবে সংরক্ষিত বন এলাকায় ‘শহীদ এটিএম জাফর আলম মাল্টি ডিসিপ্লিন একাডেমি’র নামে ১৫৫ একর বনভূমি ইজারা নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এটিএম জাফর আলম তাঁর ভাই। একাত্তরের শহীদদের নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মহৎ কাজ। তবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে তা নির্মাণ করা কি সমর্থনযোগ্য?
প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। ১৯ মে সেমিনার শেষে রামুর শহীদ এটিএম জাফর আলম মাল্টি ডিসপ্লিন একাডেমি এলাকায় গিয়ে দেখলাম, সেখানে ভবন নির্মিত হয়েছে। ভবনের একটি ফলকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে এটিএম জাফর আলমের শহীদ হওয়ার ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধু ১৯ মার্চ এটিএম জাফর আলমকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাবাহী গোপন পত্র দিয়ে তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ও সমমনা নেতৃবৃন্দের কাছে প্রেরণ করেন।’ এ বক্তব্যে তথ্যগত বিভ্রান্তি রয়েছে। আসলে তখন পশ্চিমবঙ্গে ছিল রাষ্ট্রপতির শাসন। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর পদ খালি ছিল। শান্তি স্বরূপ ধাবন গভর্নর ছিলেন। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় সেই সময়ে ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী; তিনি ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন।
আমার জানামতে, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. আবু হেনা বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতা গিয়েছিলেন, যা তোফায়েল আহমেদসহ অনেকেই তাঁদের স্মৃতিচারণে বলেছেন। শহীদ এটিএম জাফর আলমের বঙ্গবন্ধুর পত্র নিয়ে কলকাতায় যাওয়ার বিষয়টি আমার কাছে নতুন। জাফর আলমকে চিনতেন এমন একজন, সেই সময়ের ছাত্রনেতা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, জাফর আলম পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু কেন তাঁকে দিয়ে কলকাতায় চিঠি পাঠাবেন! এ তথ্যের যথার্থতা নিরূপণের ভার গবেষকদের ওপর ছেড়ে দিলাম। আমার কথা হচ্ছে, শহীদের নামেও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কোনো স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান গড়া সংগত নয়।
কক্সবাজারের সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা। পাহাড় কেটে প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে তাদের জন্য ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে না পারলে তা হবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি।
আশার কথা এই যে, কক্সবাজারের নাগরিক সমাজ সমস্যা সম্পর্কে সচেতন এবং তা মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছে। ১৮ মার্চের সেমিনারে তাদের সোচ্চার কণ্ঠে তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেমিনারের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বলতে চাই– কক্সবাজারের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সিদ্ধান্ত নিতে হবে– সংরক্ষিত এলাকায় কোনো বিবেচনায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না; সেন্টমার্টিনে কোনো হোটেল-মোটেল থাকবে না; কোনো জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। যেসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে, তা সরিয়ে নিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার কক্সবাজার কমিশন গঠন করতে পারে, যারা খতিয়ে দেখবে কোথায়, কীভাবে পাহাড়, বনভূমি দখল করা হয়েছে। সেই সঙ্গে একটি টাস্কফোর্স থাকবে, যারা অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দেবে। যেখানেই পাহাড় কাটা, বালু তোলার খবর পাবে, সেখানেই হাজির হবে। কক্সবাজার রক্ষায় জনগণেরও দায় আছে। নাগরিক সমাজ, পরিবেশকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক ও ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীকে নিয়ে ‘কক্সবাজার বাঁচাও’ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে সারাদেশে। কক্সবাজার বাঁচাতে দেশজুড়ে সম্মিলিত আন্দোলনের বিকল্প নেই।
লেখাটি সমকালে প্রকাশিত।
আবু সাঈদ খান: বীর মুক্তিযোদ্ধা; উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল