স্বাধীনতা দিবস ২০২৩ : স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা
আবু সাঈদ খান : পাকিস্তান ছিল অস্বাভাবিক রাষ্ট্র; যার পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মাঝখানে ১২শ’ মাইলব্যাপী ভারত। জীবনাচার, ভাষা ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব ততোধিক।
এমনই দূরত্ব ও ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী এককেন্দ্রিক শাসন চালু করে। এর ফলে যাদের ওপর শাসনভার ন্যস্ত হলো, তারা ছিলেন পূর্ব বাংলা সম্পর্কে অজ্ঞ ও উদাসীন। পূর্বাংশের উন্নয়নে তাদের কোনো মনোযোগও ছিল না। কেবল অবজ্ঞা-উপেক্ষাই নয়– সেই সঙ্গে ছিল পূর্ব বাংলাকে পদানত রাখবার ঘৃণ্য কৌশল। একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার চেষ্টা ছিল সেই কৌশলেরই অংশ।
আরও পড়ুন : একাত্তরের পথ দেখিয়েছে ঊনসত্তর
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা আবার বাংলাকেন্দ্রিক রাজনীতির বলয়ে ফিরে আসে। ঐতিহাসিকভাবেই স্বশাসনের ভাবনা বাংলার জনগণের মানসপটে ছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস বাংলাকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রবক্তা ছিলেন। বহিরাগত অবাঙালি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তার রোধে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট ছিল। অভিন্ন লক্ষ্য ছিল শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকেরও। দেশভাগের প্রাক্কালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎ বসু, কিরণ শঙ্কর রায় প্রমুখ সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন; তা বাংলার স্বশাসনের দাবি স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হয়; যা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক যুবসমাজকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। স্বাধীন বাংলা উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও যুবসমাজের হৃদয় থেকে সেই স্বপ্ন মুছে যায় না।
’৪৮-৫২-এর ভাষা আন্দোলনের আবহে সুপ্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদের অঙ্কুরোদগম হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসনের দাবিও ওঠে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রাক্কালে ছাত্র-জনতার দাবির মুখে বাংলার তিন জনপ্রিয় নেতা শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবিনামায় দাবিগুলো সন্নিবেশিত হয়। একুশ দফার ১৯ নং দফায় বলা হয়, ‘‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বশাসিত ‘সভরেন’ করা হইবে এবং দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যবস্থা ব্যতীত অন্য সমস্ত বিষয় অবশিষ্টাত্মক (Residuary Power) ক্ষমতাসহ পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার স্থাপন এবং অস্ত্র তৈরির কারখানা নির্মাণ করতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশ্রস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।” (অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, পৃ ১৮২-৮৪)।
লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব ও পশ্চিম অংশে আলাদা রাষ্ট্রের কথাই বলা হয়েছিল। ২১ দফা প্রণেতাদের মনের গভীরে এমন স্বপ্ন লুকায়িত ছিল কিনা, তা বলা কঠিন। তবে একুশ দফায় দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের। ফেডারেল ব্যবস্থায় রাষ্ট্র বা রাজ্যের অনুরূপ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অনেক নজির রয়েছে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে যায়। শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সূচনাতেই নেতাদের মধ্যে আত্মকলহ শুরু হয়। সেই সুযোগ গ্রহণ করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। সরকার গঠনের বছর না পেরোতেই ৯২ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করা হয়। সেদিন যুক্তফ্রন্ট নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াননি। বরং তাঁরা আপসের মাধ্যমে ক্ষমতায় স্বাদলাভের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন।
যুক্তফ্রন্টের দুই শরিক কৃষক প্রজা পার্টি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে প্রদেশে সরকার গঠন করে। ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীসহ উভয় দলের কতিপয় নেতা কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীগিরিও করেন। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের দাবি হিমাগারে চলে যায়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সোহরাওয়ার্দী বলেন, আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মানে পূর্ব পাকিস্তান ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে। এ বক্তব্যে আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। তবে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ অনেকেই স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন এবং ঘোষণা করেন যে, ন্যায্য দাবি না মানলে পাকিস্তানকে ‘আসলামু ওলায়কুম’ জানানো হবে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। গ্রেপ্তার ধরপাকড়ের পাশপাশি সোহরাওয়ার্দী, আবু হোসেন সরকার, আতাউর রহমান খান প্রমুখের ওপর এবডো (Elective Bodies Disqualfications Order) আরোপিত হয়। অনেকেই স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে নির্বাসনে যান। এই সময়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে যুবসমাজের মাঝে গোপন তৎপরতা শুরু হয়। অনেক ইতিহাসবিদ এ সময়টা এড়িয়ে গেছেন। আমার বিবেচনায় এই পর্বটি গুরুত্বপূর্ণ।
সে সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ও ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ ও খোকা রায়ের মধ্যে একাধিক গোপন বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের এক পর্যায়ে শেখ মুজিব প্রকাশ্যে স্বাধীনতার স্লোগান দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তবে কমিউনিস্ট নেতৃদ্বয় এটি সময়োপযোগী নয় বলে বারণ করেন। শেখ মুজিব তাঁদের কথা শুনেছিলেন। (মণি সিংহ, জীবন সংগ্রাম অখণ্ড, পৃ ৩২)। তবে স্বাধীনতার লক্ষে তাঁর কার্যক্রম থেমে ছিল না। সাবেক ছাত্রনেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব নিজ হাতে মুসাবিদা করে নিজে প্যাডেল চালিয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার স্বপক্ষে যে লিফলেট ছেপে আনতেন তা গভীর রাতে দ্রুতগামী সাইকেলে চড়ে আমি, মণি, সিরাজুল আলম খান, ফরিদপুরের আনিস সেগুলো বিলি করতাম।’ (শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বলেছি বলছি বলব, পৃ ২৬)। তাছাড়া শেখ মুজিব সেনাবাহিনীর স্বাধীনতাকামী সৈনিক ও অফিসারদের কার্যক্রমকে সমর্থন ও সহযোগিতা করেন, তা আজ অনেকের লেখায় ওঠে এসেছে।
ষাটের দশকে বৃহত্তর ময়মনসিংহে ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল আজিজ বাগমারার নেতৃত্বে অপূর্ব সংসদ এবং সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে ‘নিউক্লিয়াস’ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই সময়ে লন্ডনে পাঠরত বাঙালি শিক্ষার্থীরা ‘Unhappy East Pakistan’ ব্যানারে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে মিলিত হয়। ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট ও অপূর্ব সংসদের কার্যক্রম গোপন বৈঠক, যোগাযোগ ও প্রচারপত্র বিলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে নিউক্লিয়াস স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে স্বাধীনতার দ্বারে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬২-৬৪ সালের শিক্ষা আন্দোলন সামরিক শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে আশার সঞ্চার হয়। তবে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ প্রথমদিকে ভারতবিরোধী উন্মাদনা সৃষ্টি হলেও তা অচিরেই উবে যায়। বরং পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত অরক্ষিত থাকার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে। ভারত পূর্ব সীমান্তে আক্রমণ করলে কী হতে পারত– তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব লাহোরে সংবাদ সম্মেলনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত ৬ দফা পেশ করেন।
৬ দফায় ২১ দফার চেয়ে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট করে উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে ফেডারেল রাষ্ট্র। ২১ দফায় পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও মুদ্রা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত করার কথা বলা হয়েছিল। ৬ দফায় দুই অংশে পৃথক বিনিময়যোগ্য মুদ্রা ব্যবস্থা অথবা সারাদেশে একক মুদ্রা ব্যবস্থা থাকলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর ব্যবস্থার কথা বলা হয়। আরও বলা হয়, প্রদেশের কাছে রাজস্ব ধার্য করার এখতিয়ার থাকবে, প্রদেশ বিদেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি চুক্তি করতে পারবে এবং নিজস্ব নিরাপত্তায় আধা সামরিক বাহিনীও থাকবে। আসলে ৬ দফা ছিল কৌশলগত কর্মসূচি; যার মর্মবাণী ছিল স্বাধীনতা। তাই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ স্লোগান দিয়েছিল, ৬ দফার আসল কথা– স্বাধীনতা।
৬ দফা দেওয়ার পর শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ পাকিস্তান সরকারের নিশানায় পরিণত হয় সত্য, তবে জনগণের মাঝে আশার আলোর রশ্মি দেয়। তখন একসময়ের স্বায়ত্তশাসনের সবচেয়ে সোচ্চার উভয় ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন ৬ দফার বিরোধিতা করে। মস্কোপন্থি খ্যাত মুজফ্ফর ন্যাপ ও সহযোগী ছাত্র ইউনিয়ন দফাকে অপূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি বলে সমালোচনা করে। অপরদিকে পিকিংপন্থিরা ৬ দফাকে সিআইএ’র দলিল বলে প্রচার করে। তখন মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থি উভয় দলের মধ্যে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন তিরোহিত। তারা পাকিস্তানভিত্তিক সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে অঙ্গীকারবদ্ধ। এভাবেই তাত্ত্বিক বিভ্রান্তিতেও বামরা পিছিয়ে যায়, জাতীয়বাদী আওয়ামী লীগ এগিয়ে যায়। শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বাংলার মুখপাত্র।
১৯৬৬ সালে মস্কোপন্থি ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন ৬ দফা আন্দোলনের কর্মসূচি সমর্থন করে। ১৯৬৯ সালে উভয় ছাত্র ইউনিয়ন ৬ দফা ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহার সংবলিত ১১ দফায় স্বাক্ষর করে। ততদিনে নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের হাতে চলে গেছে। তবে ১১ দফায় সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন চুক্তি বাতিলসহ প্রগতিশীল উপাদান সংযোজনে দুই ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা অগ্রগণ্য। এর আগেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আন্দোলনের রাজপথে শামিল হন। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্টনে এক শ্রমিক সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন এবং সেখান থেকে হরতালের ডাক দেন। মওলানার অংশগ্রহণ আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। তা আর ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকে না, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আসাদ-মতিউরের রক্তে গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি জান্তা শেখ মুজিবসহ ৩৫ জন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়ে রাজপথ ও সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের বিদ্রোহ দমনের যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা বুমেরাং হয়। শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তিই আন্দোলনের মূল দাবিতে পরিণত হয়। মিছিলে মিছিলে দাবি ওঠে– জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব। ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হলে প্রতিবাদী জনতার জোয়ার অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আদালতের বিচারকের বাসভবনে হামলা হলে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করা হয়। মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে তখন দুটি পথ খোলা। তিনি কি আপসের পথে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন, না স্বাধীনতার লক্ষ্যে অগ্রসর হবেন। তিনি ১৯৭০ সালে নির্বাচন করেছেন, জনতার ম্যান্ডেট লাভ করেছেন। কিন্তু আপস করেননি। দলের ভেতরে দুটি ধারা ছিল– একটি আপসকামী; যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সামনে রেখে পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। অপরদিকে নিউক্লিয়াস প্রভাবিত র্যাডিকেল ধারা, যারা স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ধাবিত করছিলেন।
র্যাডিকেলদের কাঁধেই ছিল বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদের হাত।
উনসত্তরের আন্দোলন চলাকালেও প্যারোলে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের পক্ষে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই ছিলেন। তিনি তা শোনেননি। বরং যুব-ছাত্রনেতাদের প্রস্তাবের প্রতিই সমর্থন জানিয়ে প্যারোলে মুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্যের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে আপস করে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবল ঝোঁক ছিল, তবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর রানিংমেট তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আপসহীন।
মার্চের উত্তাল দিনে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের মতো সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধু তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এমনকি ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে দিয়েছেন; সেই পতাকা নিয়ে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকে গিয়েছেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে ঘোষণা করেন– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রামে উন্নীত হয়।
২০২৩ সালের ২৬ মার্চ সমকালে প্রকাশিত।
আবু সাঈদ খান: লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com