সমঝোতাই সময়ের দাবি

আবু সাঈদ খান : রাজনীতিতে চরম ও নরম দুই পন্থাই আছে। তবে নরমপন্থিদেরও চরমপন্থা এবং চরমপন্থিদেরও নরমপন্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত কম নয়। আসলে কোনো পথ আঁকড়ে থাকা নয়, প্রয়োজনে কৌশলের পরিবর্তন করতে হয়; সেটিই রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পন্থায় হাঁটছে তা পর্যালোচনার আগে পেছনে তাকাতে চাই।
রাজনীতির ইতিহাসে চরম ও নরমের দ্বন্দ্ব বহুল আলোচিত। একই রাজনীতির মধ্যে দুটি প্রবণতা জড়াজড়ি করে থাকে। অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেসের রাজনীতির আবহেই লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিন বিহারী পাল, ঋষি অরবিন্দ প্রমুখ যে বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী ধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তা ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর হৃদকম্প ধরিয়ে দিয়েছিল। তবে জনবিচ্ছিন্ন ধারাটি টিকে থাকতে পারেনি। ১৯০৫ সাল থেকে শুরু করে বড়জোর পনেরো বছর এসব বৈপ্লবিক তৎপরতা বাংলা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। পক্ষান্তরে গান্ধী-নেহরুর নরমপন্থা রাজনৈতিক স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। ১৯৪২ সালে গান্ধী ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, কিন্তু অচিরেই নরমপন্থায় ফিরে যান। আবার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য থেকে সুভাষ বসু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরাস্ত হয়েও স্মরণীয়-বরণীয় হন। যে আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তান কাঠামোর ভেতরে সমাধানসূত্র খুঁজছিল, এর এক দশক পর ১৯৬৬ সালে সেই আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ৬ দফা দিয়ে বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী ধারার সূচনা করেছিল। এ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ মুক্তিসংগ্রামের কাণ্ডারিতে পরিণত হয়। কোন পদক্ষেপ কতখানি যৌক্তিক ছিল তা মূল্যায়নের জন্য এসব ঘটনার অবতারণা নয়। আমি এসব ঘটনা উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে দেখাতে চাইছি- কখন, কীভাবে কৌশলের পরিবর্তন হয়েছিল। রাজনীতিতে সময়ে কঠোর আবার সময়ে নরম হতে হয়, আপসও করতে হয়। সময়টা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আর চরমপন্থিদের পদচারণা নেই। তবে একরোখা বা কট্টর ও উদারনৈতিক ধারা আছে। একরোখা মনোভাব ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলেই ক্রিয়াশীল। নির্বাচন সামনে রেখে এরই পুনরাবৃত্তি দেখছি। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধানে যেভাবে আছে, সেভাবেই নির্বাচন হবে। বিএনপি বলছে, দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য কিছ মানবে না। ক্ষমতাসীন ও বিএনপির কট্টর অবস্থানের রহস্য এক নয়। আওয়ামী লীগে কট্টরপন্থিরা হয়তো ভাবছে- বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন আছে; অতএব ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। বরং দলটিকে কৌশলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে ঠেলে দেওয়াই হবে ‘বুদ্ধিমানের’ কাজ। হয়তো আরও ভাবা হচ্ছে- ক্ষমতায় এসে উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি করে জনগণকে ভোট না দেওয়ার যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়া হবে। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের প্রভাবিত বিএনপির একাংশ বিশৃঙ্খল অবস্থা চাইছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বদলা নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যে কারণে বিএনপিকে কৌশলে নির্বাচনের বাইরে রাখাই তাদের লক্ষ্য। দুই জোটের দুই কট্টরপন্থাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বড় হুমকি।
দুই প্রধান দলের মূল নেতৃত্বের মধ্যে এমন ভাবনা আছে বলে মনে করি না। শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, তিনি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না। খালেদা জিয়াও বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যাবে না। তারপরও আমরা ঘরপোড়া মানুষের মতো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই। আমরা ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন দেখেছি, আবার আন্দোলনের নামে সহিংসতাও দেখেছি। ওই নির্বাচন ও আন্দোলন দুই-ই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এসবের পুনরাবৃত্তি চাই না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই- আওয়ামী লীগের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের যে ঐতিহ্য আছে, যে ভাবমূর্তি আছে- দলটি নিশ্চয়ই তা হারাতে চায় না। তার চেয়ে বড় কথা, বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কি আসবে? আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া উন্নয়নের ধারা কি অব্যাহত রাখা আদৌ সম্ভব? এটি ভুলে যাওয়া উচিত নয়- গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিপূরক, একটি বাদ দিয়ে আরেকটি এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।
বিএনপি নেতৃত্বকে বুঝতে হবে যে, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করল। কিন্তু ব্যাপক জনসমর্থন থাকার পরও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ও তার সহযোগীরা ২০১৪ সালে একই দাবি আদায় করতে পারল না। যে দাবি ২০১৪-তে আদায় হলো না, তা কি ১৮-তে আদায় সম্ভব? আসলে একই ঘটনা দু’বার ঘটে না। তাই পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে কৌশলও পরিবর্তন করতে হয়। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিএনপির সামনে সে সুযোগ ছিল। শেখ হাসিনার নির্বাচনকালীন সরকারে যোগদানের প্রস্তাব গ্রহণ করলে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতো। আর সেটি হতো সর্বদলীয় বা ঐকমত্যের সরকার। জানি, বিএনপি নেতৃত্ব এ ভুল কখনও স্বীকার করবে না। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা কখনও ভুল স্বীকার করেন না। তবে বিএনপি ভেতরে ভেতরে ওই নির্বাচন বর্জন নিয়ে অনুশোচনা যে করে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সে যা-ই হোক, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে কেবল রাজনৈতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, অগণিত নেতাকর্মী হামলা-মামলার শিকার হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়েছে। সম্ভবত আবার নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে থেকে দলটি আর ক্ষতিগ্রস্ত হতে চায় না।
তাই বলা যায়, উভয় দলের ভেতরেই নির্বাচনমুখী প্রবণতা প্রবল। তবে দুই বড় দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণই শেষ কথা নয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই আসল কথা। আর সেটি করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে ঐকমত্য প্রয়োজন (সংবিধানের আলোকেও এর সমাধান সম্ভব। এ নিয়ে অনেকে লিখেছেন, আমিও একাধিকবার লিখছি; আজ সে আলোচনায় যাব না)। এর বাইরে ঐকমত্য প্রয়োজন রাজনীতিতে সেনা মোতায়েন ও সুযোগের সমতা প্রশ্নেও। আঞ্চলিকতা-সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন উঠেছে- সুযোগের সমতা কি সারা বছর, না কেবল নির্বাচনকালীন? সারা বছর যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা হয়, আর নির্বাচনকালে সুযোগের সমতা কতখানি ফলপ্রসূ? কেউ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যত খুশি সভা করবে, কেউ অনুমতি পাবে না- তা হয় না। সংসদ রেখে নির্বাচন হলে কেউ যাবেন এমপি বা মন্ত্রিত্বের তকমা নিয়ে, কেউ যাবেন সাধারণ পরিচয়ে। তখন কি সুযোগের সমতা থাকে? এ বিরোধ নিরসনে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার বিকল্প নেই। সেনা মোতায়েনের গুরুত্ব সমধিক, তবে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার মানে নেই। বিচারকের কাছেই বিচারিক ক্ষমতা থাকবে, অন্য কারও সে ক্ষমতা থাকা যুক্তিযুক্ত নয়।
এ ছাড়া টাকার খেলা, আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাথাব্যথা দেখি না- এর কারণ কারও অজানা নয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাপার প্রায় সব প্রার্থী ধনকুবের। তা নিয়ে কথা নেই। বিপত্তির ব্যাপার, নির্বাচন তাদের কাছে বিনিয়োগ। তারা বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে নামেন। এসব কোটিপতির টাকার খেলা নিয়ন্ত্রণ না করলে সৎ-সাধারণ নাগরিকের পক্ষে কি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব? টাকার খেলা বন্ধ না করলে কেবল ধনী প্রার্থীদের মধ্যে সুযোগের সমতা হবে: সব প্রার্থীর ক্ষেত্রে নয়। তাই টাকার খেলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন একই পোস্টারে সব প্রার্থীর ছবি সরবরাহ করতে পারে। আয়োজন করতে পারে একই সঙ্গে পরিচিতি সভা ও টেলিভিশন বিতর্কের।
নির্বাচনী বিধিতে আছে- নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার চলবে না। নির্বাচনী প্রচারে আঞ্চলিকতা ও সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। কিন্তু অতীতে ‘নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ ও ‘ধানের শীষে বিসমিল্লাহ’ ধ্বনি শুনেছি। শুনেছি ‘নৌকায় ভোট দিলে উলুধ্বনি শোনা যাবে’। ‘রংপুরের ছাওয়ালে’র নামে আঞ্চলিক প্রচারণাও দেখেছি। এসবের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে ব্যাপারেও নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা অর্থবহ নির্বাচন চাই- সেটি হতে হবে যেমনি অংশগ্রহণমূলক, তেমনি সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত। তা হতে হবে ধর্ম-টাকা-আঞ্চলিকতা-সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবমুক্ত।
লেখক : আবু সাঈদ খান
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com