
আবু সাঈদ খান : নতুন বছরের আয়নায় বিগত বছর বা বছরগুলোর সমস্যা ও সম্ভাবনা দেখা দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। যদিও নতুন বছর শুরুর মধ্য দিয়ে বিগত দিনের সমস্যা বা সম্ভাবনা নতুন মাত্রা লাভ করে না। তবে নতুন বছরে সবকিছু নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবিত হই।
বাংলাদেশ যে সামনের দিকে ছুটছে, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। নারীর উন্নয়ন, শিশুর মৃত্যুহার কমানো, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে। কোনো কোনো সূচকে ভারতসহ প্রতিবেশীদের চেয়ে ভালো করেছে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা, জননিরাপত্তাহীনতা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, প্রশাসনে অনিয়ম-দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট, জমি-জল-জঙ্গল গ্রাস, শিক্ষার সংকট ও ধস, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি আমাদের অগ্রযাত্রায় হুমকি। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার- সবকিছুর চালিকাশক্তি যে রাজনীতি, সেখানে আমরা যেন পিছিয়ে পড়ছি। কেউ কেউ এখন ভাবছি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মডেল। বলা হচ্ছে- কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন। এটি বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক সচেতন জনগোষ্ঠীর জন্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সামগ্রিক বিবেচনায়ও এ ধারণা ত্রুটিপূর্ণ। যে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশীদারিত্ব থাকে না, সেই উন্নয়ন স্থায়ী হয় না, টেকসই হয় না। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্রে উন্নয়নও জরুরি।
সমস্যা গণতন্ত্র সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিতেও। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন বা যাপিত জীবনে গণতন্ত্র নিয়ে কোনো কথা নেই। গণতন্ত্র বলতে যা চলছে তা ভোটতন্ত্র, সেটিও নানা সংকটে নিপতিত।
২০১৮ সাল নির্বাচনের বছর। এই বছরই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ঢাকা উত্তর সিটিসহ বেশ কিছু সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, বাকবিতণ্ডার শেষ নেই। ২০১৪ সালে একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর থেকে প্রত্যাশিত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের; যেখানে সব দল অংশ নেবে। সবার জানা, বিগত দিনে নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রশ্নে একটি জাতীয় ঐকমত্য ছিল, সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনকালে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান মেনে নিয়েছিল। তবে আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী বিধান প্রবর্তনের পর থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে আর ঐকমত্য নেই। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের দাবি করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান থেকে সরতে চাইছে না। যে কারণে বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ওই নির্বাচন ছিল একতরফা, ভোটারবিহীন। বিএনপি এর সমালোচনা করছে। এর জবাবে ক্ষমতাসীনরা বিএনপির অংশগ্রহণ না করাকেই দায়ী করছে। সে যাই হোক, নির্বাচনটি যে ভোটারবিহীন, একতরফা ছিল, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। এ প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারের চার বছর কাটল। নতুন নির্বাচনের বছর এলো; কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো ঐকমত্য হলো না। নতুন বছরে জাতির সামনে এটিই বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশা আছে, না ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হবে?
এটি সবারই বোধগম্য, যেমনি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না, তেমনি বিএনপিকে বাদ দিয়েও কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না। অর্থবহ নির্বাচন মানে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বড় দলসহ সব দলের অংশগ্রহণ। এর বড় প্রমাণ ২০১৪ সালের নির্বাচন। আওয়ামী লীগই বলছে- প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের জন্য বিএনপি দায়ী। তারা এলে এমন নির্বাচন হতো না। এখন প্রশ্ন হলো-যাদের ছাড়া অর্থবহ নির্বাচন হয় না, তাদের কি উপেক্ষা করা যায়? সে বিবেচনায় নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজনে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। আর বিএনপিকেও বুঝতে হবে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও তারা সরকারকে বাধ্য করার মতো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। উপরন্তু আন্দোলনের নামে যেসব সহিংসতা হয়েছে, তার দায় বিএনপি এড়াতে পারে না। এ বাস্তবতায় দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান প্রবর্তনের সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে তাদেরও ছাড় দিতে হবে। বিএনপি ছাড় দিয়েও ছিল। দলটি সহায়ক সরকারের কথা বলেছিল। যদিও সহায়ক সরকারের রূপরেখা দিই-দিচ্ছি করে আর দিল না। তবুও মনে হয়েছিল, আজকের বাস্তবতায় সমাধানের পথ খুঁজছে। এখন আবার দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বক্তব্য হাজির করছে।
সরকার ও বিএনপি স্ব-স্ব অবস্থানে অনমনীয় থাকলে ঐকমত্যের ক্ষেত্র সংকুচিত হবে, একটি অর্থবহ নির্বাচনের সম্ভাবনা তিরোহিত হবে। তবে বিএনপির এটি যদি এমন কৌশল হয়- যা চাওয়া হয়, তা পাওয়া যায় না। হাতি চাইলে ঘোড়া মেলে। তাহলে ব্যাপারটা আলাদা।
সরকার বলছে- বিএনপিকে আর সাধাসাধি করবে না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রায়শই জানিয়ে দেন যে, ২০১৪ সালের আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়সহ নির্বাচনকালীন সরকারে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা যোগ দিল না। তবে সে প্রস্তাব উপেক্ষা করা যে ভুল ছিল, তা বিলম্বে হলেও বিএনপি নেতৃবৃন্দ বুঝেছেন। সে যাই হোক, এবার প্রধানমন্ত্রী এমন প্রস্তাব দেবেন কি-না, জানি না। ২০১৪ সালে যা যৌক্তিক ছিল, আজ তা অযৌক্তিক হওয়ার কোনো কারণ নেই। এবার এমন প্রস্তাব এলে বর্তমান সংবিধানের আওতায় সমাধান হতে পারে। বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংবিধান কোনো বাধা নয়। বলা হচ্ছে, বিএনপি সংসদে নেই- কী করে মন্ত্রী হবে? এখনও টেকনোক্র্যাট ও মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা আছে। নির্বাচনকালীন সরকারের ক্ষেত্রে এ বিধান অনুসরণ করা যেতে পারে। এর বাইরেও সমাধান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সদিচ্ছাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন। এ জন্য চাই সংলাপ। সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুই দলসহ রাজনৈতিক দলগুলো এক টেবিলে বসবে। এর কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বিএনপি এখন সংলাপের কথা বলছে। আওয়ামী লীগ নানা কথা বলে তা নাকচ করে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে জোটে নিয়েছে, জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি, তারেক ২১ আগস্টের খুনি ইত্যাদি। এসব কথার পেছনে সত্যতা থাকতেও পারে। তাই বলে এক টেবিলে বসবে না; তা হয় না। রাজনীতির ইতিহাস বলে, শত্রুর সঙ্গেও বসতে হয়। ভারতে বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের এমন অভিযোগ রয়েছে। সমালোচনা করছে, আবার প্রয়োজনে বসছেও। আমরা ভুলে যাইনি- স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি যে কতবার বসেছে, তার হিসাব নেই। আর মনে রাখতে হবে- গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সরকার ও বিরোধী দল শত্রু নয়, প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা যায়; কিন্তু ধ্বংস কামনা করা যায় না। বরং প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত ধরাধরি করেই এগোতে হয়। এটিই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
কেবল একটি অর্থবহ নির্বাচনের প্রয়োজনেই নয়, নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলাসহ আরও কিছু ইস্যুতেও ঐকমত্য অপরিহার্য। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হলে কেবল ট্রেজারি বেঞ্চে বসার গোঁ ধরলেই চলবে না। বিরোধী আসনে বসার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা মেয়র বা অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখি যে, বিজিত প্রার্থী বিজয়ীকে অভিনন্দন জানান; কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে তা দেখা যায় না। জাতীয় পর্যায়েও এটি জরুরি। আমরা চাই- সংসদ নির্বাচনেও পরাজিত দল বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানাবে এবং বিনা বাক্যে বিরোধী আসনে বসবে। কোনো বিবেচনায়ই সংসদ বর্জন করবে না, প্রতিপক্ষকে বিপাকে ফেলতে হরতাল-অবরোধের রাজনীতি করবে না। দেশের সামগ্রিক স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধ, উন্নয়ন, জননিরাপত্তাসহ আরও কিছু বিষয়ে ঐকমত্য সময়ের দাবি। এ জন্য সব দল মিলে একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে হবে, যাতে সরকারের পরিবর্তন হলেও জাতীয় মৌল নীতির পরিবর্তন ঘটবে না। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের অমিল থাকবে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ, পররাষ্ট্রনীতি, উন্নয়ন নিয়ে মতপার্থক্য থাকবে না। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ে হবে মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহক।
আবু সাঈদ খান: লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com