
আবু সাঈদ খান : রংপুরের পাগলাপীর এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে যে হামলা হলো, তা নতুন নয়। ২০১২ সালে রামুতে, ২০১৩-তে পাবনার সাঁথিয়ায়, ২০১৬-তে নাসিরনগর ও একই বছর গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালপল্লীতে হামলার সঙ্গে এ ঘটনার তেমন পার্থক্য নেই। আর রামু ও নাসিরনগরের ঘটনার সঙ্গে পাগলাপীরের ঘটনা হুবহু মিলে যায়।
রামু ও নাসিরনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তির ফেসবুকে ‘ধর্মের অবমাননাকর’ স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে হামলা চালানো হয়েছে। পাগলাপীরে একই ঘটনা ঘটেছে। রামু ও নাসিরনগরে ‘ধর্মের অবমাননাকারী’ ছিলেন উত্তম বড়ূয়া ও রসরাজ মণ্ডল। এখনও উত্তম বড়ূয়ার পরিচয় মেলেনি। আর রসরাজের ফেসবুকে কে বা কারা এটি পোস্ট করেছিল, তা প্রমাণিত। এবার টিটু রায়, যিনি নিরক্ষর। এলাকাবাসী বলছে, সাত বছর আগে টিটু এনজিওর পাওনা পরিশোধ করতে না পারায় এলাকা ছেড়েছেন। জীবিকার তাড়নায় ঢাকায় রিকশা চালিয়েছেন। এখন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন। সবার প্রশ্ন, এই নিরক্ষর টিটু কী করে ফেসবুক চালাবেন বা স্ট্যাটাস দেবেন? এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ, ‘যে স্ট্যাটাস নিয়ে রংপুরে তুলকালাম কাণ্ড হলো, লাশ পড়ল, পুড়ল ১০ সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িঘর, তা প্রথম দেন খুলনার ‘মাওলানা আসাদুল্লাহ হামিদী।’ গত ২৮ অক্টোবর তিনি স্পর্শকাতর স্ট্যাটাসটি দেন এবং গতকাল পর্যন্ত ৮৭ জন ফেসবুক ব্যবহারকারী তাদের ওয়ালে এর শেয়ার দিয়েছেন, যাদের একজন রংপুরের এমডি টিটু। টিটুর নামে শেয়ার দেওয়া হয় ১৯ অক্টোবর। আসাদুল্লাহ হামিদী স্ট্যাটাস দেওয়ার কথা কালের কণ্ঠের কাছে স্বীকারও করেছেন। তিনি ফেসবুকে নিজের পরিচয় দিয়েছেন- ‘ইসলামী আন্দোলনের বাংলাদেশের দীঘলিয়া উপজেলার সভাপতি এবং খুলনা জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক’ (কালের কণ্ঠ, ১২ নভেম্বর ২০১৭)। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, একটি চক্র এ ঘটনার পেছনে কাজ করেছে। এমডি টিটুর নামে যা করা হয়েছে তার সঙ্গে টিটু রায়ের কোনো সম্পর্ক আছে কি-না, সেটি বড় প্রশ্ন। কাউন্টার টেররিজমের সাইবার ক্রাইম বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তারা মনে করছেন, যে কার্টুন ও স্ট্যাটাসটি টিটু রায়ের বলে দাবি করা হচ্ছে, তা টিটুরই- এর স্বপক্ষে সন্দেহাতীতভাবে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং তারা মনে করছেন, টিটু রায়কে কেউ পরিকল্পিতভাবে ফাঁসিয়েছে।’ (সমকাল, ১৩ নভেম্বর ২০১৭)।
রামু ও নাসিরনগরসহ বিভিন্ন স্থানের ঘটনায় তদন্ত ও মামলা হয়েছে; কিন্তু অগ্রগতি নেই। আসল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে, বহাল তবিয়তে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ঘটনায় পদক্ষেপ নিতে পুলিশ প্রশাসন কতটুকু আন্তরিক? সবারই বোধগম্য, রামুর ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হলে হয়তো নাসিরনগরের ঘটনা ঘটত না, আর নাসিরনগরের ঘটনার জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে হয়তো দুর্বৃত্তরা পাগলাপীরে হামলার সাহস পেত না, ষড়যন্ত্র আটকে পড়ত না। আমি বুঝতে পারি না, রাজন হত্যাকাণ্ডের মতো এসব বিচার দ্রুত করা হয় না কেন!
দুঃখজনক হলো যে, পুলিশ প্রশাসন এসব ঘটনা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। এবারের ঘটনাই ধরা যাক, স্ট্যাটাসের জন্য পাগলাপীর এলাকায় কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা চলল। মানববন্ধনের ডাক দেওয়া হলো। এসবের পরও পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার ছিল। পুলিশের এই ভূমিকা রহস্যজনক। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ নিয়েছিল, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং থানা কথিত টিটু রায়ের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা নিল। যেখানে নির্দেশনা আছে যে, পুলিশের সদর দপ্তরের পরামর্শ ছাড়া এ ধারায় মামলা গ্রহণ করা যাবে না। তবে কি পুলিশের সদর দপ্তর কথিত টিটু রায়ের বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি দিয়েছিল? পুলিশ কী করে নিশ্চিত হয়েছিল যে, ফেসবুকের এমডি টিটুই এই টিটু রায়? পুলিশের এ ভূমিকায় প্রতীয়মান হয়, তাদের বিবেচনায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল না। বরং তারা কথিত টিটু রায়কে শাস্তি দিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা কি এই দায় এড়াতে পারেন? যিনি টিটু রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, তিনি রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তক ও বর্তমান মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির লোক। এখন প্রশ্ন, এলাকার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কী ভূমিকা নিয়েছিল? তারা কি অবস্থা নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট ছিল, না রামু ও নাসিরনগরের মতো ‘কাফেরের’ শাস্তি দিতে তৎপর হয়েছিল? গলদ রাজনীতিতেই। অতীতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী যে অবস্থান ছিল, আজ তা নেই। এর কারণ ভোটের রাজনীতি। আর ভোটের রাজনীতির জন্য প্রয়োজন মুসলিম সেন্টিমেন্ট কাজে লাগানো। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কে কত বেশি মুসলমান! যে কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা তারা এখন মোকাবেলা করে না। বরং ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট পেতে এসব অপতৎপরতায় যোগ দেয়।
মনে করা হয়, ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর। এটি কাজে লাগাতে জিয়াউর রহমানের ফরমানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলনীতি পরিবর্তন করা হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে ‘আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। আর সেই ধারাবাহিকতায় এরশাদের ফরমানে রাষ্ট্রধর্ম করা হলো। আদালতের রায়ে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার প্রতিস্থাপিত হলেও এখনও রাষ্ট্রধর্ম বহাল আছে। ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম পুনর্বহাল করা হয়েছে। এখনও রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে অন্যতম বড় দল বিএনপি ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে মহব্বতের সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। ২০ দলীয় জোটের মধ্যে দু-একটি ছাড়া সব ক’টিই ধর্মীয় দল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মন জয়ে তৎপর। একসময় খেলাফত মজলিশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছিল। এখনও হেফাজতের চাপের মূখে কওমি মাদ্রাসা সংস্কারের উদ্যোগই কেবল পরিহার করেনি, তাদের দাবির মুখে স্কুল পাঠক্রমে পরিবর্তন এনেছে। রাজনীতিতে এখন ধর্মের ব্যবহারের প্রতিযোগিতা চলছে। রাজনীতি থেকে নীতি ও আদর্শের অবক্ষয় ঘটেছে। রাজনীতি টুপাইস কামানোর ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বিপথগামী রাজনীতিবিদদের মধ্যে সংখ্যালঘুদের জমি ও সম্পদের ওপর লোলুপ দৃষ্টিও যে কাজ করে, তা কারও অজানা নয়।
আজ যে বহুধা বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে, তা কি অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক গুণের বিকাশ ঘটাতে পারছে? ব্রিটিশ ভারতে একদা পৃথক শিক্ষা অর্থাৎ হিন্দু কলেজ ও আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা চালু হয়েছিল সত্য। তবে পরবর্তীকালে তা ছাপিয়ে সাধারণ শিক্ষাই প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাধারণ শিক্ষাই ছিল শিক্ষার মূলধারা এবং স্বাধীনতা-উত্তর তা অপরিবর্তিত ছিল। তখন প্রয়োজন ছিল একমুখী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া, প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। তা করা হয়নি। উপরন্তু আশির দশক থেকে ব্যাপকভাবে মাদ্রাসা ও বিদেশি কারিকুলামভিত্তিক ইংরেজি মাধ্যম চালু হয়েছে। যে শিক্ষা সমাজকে বিভক্ত করছে, নতুন প্রজন্মকে জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত করছে না, যেসব শিক্ষা জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে না, সেই শিক্ষার মাধ্যমে কি দায়িত্বশীল নাগরিক গড়ে উঠতে পারে?
নানা কারণে সামাজিক আবহ বদলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর সারা দুনিয়ায়ই ধর্ম, বর্ণবাদ, জাতীয় উগ্রতা উথলে উঠেছে। তা আমাদেরও স্পর্শ করছে। ভোগবাদ মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করেছে। তাই প্রতিবেশীর বিপদে মানুষ আর আগের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে না। তা আরেকবার প্রমাণ হলো- পাগলাপীরের হিন্দু বাড়িতে হামলায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা কেন এগিয়ে গেল না, কেন তাদের পাশে দাঁড়াল না? আমি ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ সংবাদপত্রের অভিন্ন শিরোনামের কথা তখন জানতাম না। সেই দাঙ্গা মোকাবেলায় ঢাকায় বেগম রোকেয়ার বোনের ছেলে আমির হোসেন চৌধুরীর আত্মদানের কথাও পরে শুনেছি। তবে তখন আমার এলাকায় মুসলমান যুবকদের হিন্দু বাড়ি পাহারা দিতে দেখেছি। এমন বোধ যে এখনও একেবারে নেই, তা বলছি না। তবে ভাটা পড়েছে। তা জাগিয়ে তোলার কাজটি করতে হবে প্রধানত রাজনীতিকদেরই।
সঙ্গত কারণেই পুলিশ প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। ঘটনার পরেই কেবল নয়, ঘটবার আগেও।
আবু সাঈদ খান: লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com