
আবু সাঈদ খান : পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল দুটি ঘটনা- ফরাসি বিপ্লব ও অক্টোবর বিপ্লব। ফ্রান্সে অষ্টাদশ শতকের শেষে ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর’ বাণী ধারণ করে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবে সম্পত্তির ওপর অধিকারের দাবি ছিল। আর ১৯২১ সালে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অক্টোবর বিপ্লব ফরাসি বিপ্লবে ধ্বনিত সাম্যের বাণীকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছিল, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সাম্যে পরিণত করেছিল। আর মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে সেটি ঘটেছিল রাশিয়ায়, কার্ল মার্কসের নির্দেশিত পথে।
আজ থেকে শত বছর আগে পৃথিবী অবাক চোখে দেখেছিল, যাদের স্থান ছিল অভিজাতদের পায়ের নিচে, সেই মজুর-কৃষক-সৈনিকরা কেবল বিদ্রোহ করেনি- রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়েছে, ক্ষমতা হাতের মুঠোয় নিয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়া- যারা সমগ্র বিশ্বের ভাগ্যবিধাতা, তারা এই ‘অরাজক’ অবস্থা সইতে প্রস্তুত ছিল না। বলশেভিকদের গলাটিপে মারার আস্ম্ফালন করেছিল। তবে মানবতাবাদী বার্নার্ড শ, বার্ট্রান্ড রাসেল ও রবীন্দ্রনাথ নবউত্থানকে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। বিপ্লবের ১৩ বছর পর রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া সফর করে লিখেছিলেন, ‘আপাতত রাশিয়ায় এসেছি- না এলে এ জন্মের তীর্থ দর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত। এখানে এরা যেসব কাণ্ড করছে, তার ভালোমন্দ বিচার করবার পূর্বে সর্বপ্রথমই মনে হয়, কী অসম্ভব সাহস। সনাতন বলে পদার্থটা মানুষের অস্থিমজ্জায় মনে-প্রাণে হাজারখানা হয়ে আঁকড়ে আছে; তার কত দিকে কত মহল, কত দরজায় কত পাহারা, কত যুগে কত ট্যাক্সো আদায় করে তার তহবিল হয়ে উঠেছে পর্বতপ্রমাণ। এরা তাকে একেবারে জটে ধরে টান মেরেছে; ভয় ভাবনা সংশয় কিছুই মনে নেই।… এখানে যে প্রকাণ্ড ব্যাপার চলছে সেটা দেখে আমি সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি।’
অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়া বদলেছিল। রাশিয়া ও জারের গড়ে তোলা বিরাট সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত দেশগুলো একত্রিত হয়ে সমতার ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়েছিল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেই বিশাল ভূখণ্ড থেকে ক্ষুধা তাড়িয়েছিল। সব মানুষের জন্য বাসযোগ্য আবাসন সুযোগ নিশ্চিত করেছিল। সব শিশুর জন্য একই পোশাকে একই মানের শিক্ষা দিয়েছিল। ভেদাভেদ ছিল না মানুষে মানুষে, রুশ আর উজবুকে। নারীকে দিয়েছিল সমমর্যাদা। তখন মজুরের সন্তানও স্বপ্ন দেখতেন, সে দেশের কর্ণধার হবে। অনেকে হয়েও ছিলেন। ক্রীড়াতে তারা অর্জন করেছিল অভূতপূর্ব সাফল্য। সোভিয়েত সিনেমা পশ্চিমা দুনিয়ায় চমক লাগিয়ে দিয়েছিল। দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অসামান্য সাফল্য এনেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের নভোযান সবার আগে চাঁদে পৌঁছেছিল। এসব অর্জনের মূলে ছিল মানুষের শক্তি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করে। আর সোভিয়েত সেসব বিভাজন মুছে দিয়ে মানুষের শক্তিতে বলীয়ান হয়েছিল। যা এনে দিয়েছিল উৎপাদন ও উন্নয়নে গতিময়তা। এসেছিল মানবতাবোধেরও জাগরণ। এর প্রভাব থেকে দূরে থাকতে পারেনি পশ্চিমের পুঁজিবাদী দেশগুলো। বিপ্লব-আতঙ্কিত এসব ধনী দেশ তলার মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা ভাতা ইত্যাদি চালু করে। একে বলা যায়, অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পরোক্ষ অবদান।
লেনিন-স্ট্যালিনের নেতৃত্বে কমিউনিষ্ট পার্টি বিপ্লবী প্রয়াসকে সোভিয়েত অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়নি। তা দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। যে কারণে গঠিত হয়েছিল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। নানা ভাষায় মার্কসবাদী সাহিত্য অনুবাদের জন্য বিরাট প্রকাশনাসহ বিশ্ববিপ্লব সংগঠনে তৎপর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে অধনতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন ছিল অপরিমেয়। প্রাচ্যের পশ্চিমা উপনিবেশগুলোর মধ্যে স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াইকে উজ্জীবিত করেছিল। এসব সংগ্রামে সোভিয়েতের অকুণ্ঠ সমর্থনও ছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অপর অবদান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন হিটলার-মুসোলিনির থাবার মুখে সমগ্র বিশ্ব ভীতবিহ্বল, তখন মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পৃক্তি বিশ্বকে নাৎসি-ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। বিশ্ব আরেকবার দেখেছিল, রেড আর্মির যুদ্ধকৌশল ও অমিত তেজ!
যখন রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয়, উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের করতলগত। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে পরাজয়ের পর আর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ নেই। ৩২ বছর বয়সী কংগ্রেস তখন ব্রিটিশের করুণা প্রার্থনা করছে, ১২ বছর বয়সী মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য করুণার ভাগ চাইছে। এ পটভূমিতে সংঘটিত অক্টোবর বিপ্লব মুক্তিকামীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়েছিল। তখন ভারতের মুক্তিকামীরা সোভিয়েতের সঙ্গে যোগাযোগে তৎপর হয়েছিলেন। সেখানে ছুটেও গিয়েছিলেন। বিশেষ করে সেসব মুহাজির – যারা ব্রিটিশ শাসিত রাজ্যে বসবাস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জায়গাজমিন বেচে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন বা অন্যত্র যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তারা অনেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের শহর তাসখন্দে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (এম এন রায়)। রায়ের নেতৃত্বে সেখানেই গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। এ পার্টি কোনো কার্যকর ভূমিকা না রাখতে পারলেও তা দেশের অভ্যন্তরে সাড়া জাগিয়েছিল। এ পথ ধরে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্গঠিত হয়েছিল। ভারতজুড়ে শ্রমিক-কৃষকের যেসব সাহসী লড়াই সংঘটিত হয়েছিল, তাতে ছিল অক্টোবর বিপ্লবের প্রেরণা।
আমাদের সাহিত্যেও অক্টোবর বিপ্লব দিয়েছিল নতুন মাত্রা। কাজী নজরুল ইসলাম কুলি-মজুরসহ নানা কবিতায় সাম্যের বাণী বাঙ্ময় করেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল সংয়ের অনুবাদ করেন। তার ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের নায়ক আনসারকে একজন বলশেভিক হিসেবে চিত্রিত করেন এবং আনসারের মুখ দিয়ে বলান, ‘সূতোয় কাপড় হয়, দেশ স্বাধীন হয় না।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখ কথাসাহিত্যে মার্কসবাদী চেতনার স্বাক্ষর রেখেছেন। শ্রেণিসংগ্রামের কবি সুকান্ত লিখেছেন, ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।’ এ সময়ের অনেকেই কবিতা, উপন্যাস ও গল্পে শ্রেণিসংগ্রামের ধারাকে বেগবান রেখেছেন।
এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডেও রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সমাজতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বামপন্থিদের ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। তবে বিচ্যুতিও কম নয়। বামপন্থিদের বড় দুর্বলতা- তারা আন্দোলন রচনা করে; কিন্তু আন্দোলনের ফসল গোলায় তুলতে পারে না। একদা দলগুলো চীন ও রাশিয়ার তরিকা নিয়ে শক্তির অপচয় করেছে। এখনও আত্মকলহে লিপ্ত।
অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের অপ্রতিরোধ্য যাত্রা শুরু হয়েছিল, চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, কিউবা ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো নিয়ে নতুন বিশ্ব গড়ে উঠেছিল। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিস্তৃতিতে পুঁজিবাদী দুনিয়া আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। সেদিন আর নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় ধস নেমেছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো পুঁজিবাদে ফিরে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা এশিয়ার দেশগুলো ধর্মীয় ঐতিহ্যে ফিরতে চাইছে। আজ রাশিয়া বা চীন যে পথে চলছে, তাকে আর সমাজতন্ত্র বলা যায় না। চীনের দেশীয় বৈশিষ্ট্যের সমাজতন্ত্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার কোনো সংশ্রব নেই। যেটি আছে তা জাতীয় স্বার্থ। সেই স্বার্থে তারা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিউবা আদর্শের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রেখেছে; কিন্তু মার্কিন অবরোধ আর ষড়যন্ত্র তাদের ক্ষতবিক্ষত করছে। এ পরিস্থিতিতে অনেকে সমাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, অক্টোবর বিপ্লব ভুল, সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, পুঁজিবাদই শেষ কথা ইত্যাদি। পুঁজিবাদের ধারক-বাহক এসব বুদ্ধিজীবীর মুখে পুঁজিবাদের সংকট নিয়ে কোনো কথা নেই। মার্কিনসহ পুঁজিবাদী দেশগুলো আজ নিজ দেশের মানুষের নিরাপত্তা-শান্তি-শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারছে না। সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতের মুঠোয়, ব্যাপক মানুষ বঞ্চিত। তাই ফুঁসে উঠছে সাধারণ মানুষ। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত হয়েছে অকপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট, যার মর্মমূলে শ্রেণিচেতনা। মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নজর নেই নেতৃত্বের। রাষ্ট্র সারাক্ষণ পুঁজিপতিদের পুঁজি আহরণের সূযোগ করে দিতে নিয়োজিত। আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার, যুক্তরাষ্ট্রসহ কতিপয় দেশের অর্থনীতি এখন অস্ত্রশিল্পনির্ভর। দেশে দেশে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ চালান দিয়ে, যুদ্ধ বাধিয়ে অস্ত্র ব্যবসার প্রসার ঘটাচ্ছে। ফলে বিশ্ব হয়ে উঠছে অশান্ত। তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে চলতে হবে সেই পথে- যে পথ দেখিয়েছিল অক্টোবর বিপ্লব, গড়েছিল মানবিক সমাজ। এমন মানবিক সমাজ গড়া পুঁজিবাদের মাধ্যমে সম্ভব নয়, সমাজতন্ত্রই কেবল সে সমাজের দিশারি। তাই এ কথা নির্দি্বধায় বলা যায়, এক মানবিক বিশ্ব গড়ার প্রয়োজনে নিপীড়িত-নির্যাতিত-বঞ্চিতরা যুগে যুগে অক্টোবর বিপ্লবকে আলিঙ্গন করবে, লাল ঝাণ্ডা উঁচিয়ে ধরবে। এ ভিন্ন বিশ্বশান্তি যে সুদূরপরাহত, তা বলাই বাহুল্য।
আবু সাঈদ খান: লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com