
আবু সাঈদ খান : একের পর এক ঘটনা ঘটছে। নৃশংসতার বলি হচ্ছে নিরপরাধ শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষ। নির্যাতনের নির্মম শিকার অনেকেই জানত না- কেন তাদের জীবনের স্পন্দন থেমে গেল। তবে ২৭ অক্টোবর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার খৈনকুট গ্রামের কিশোরী আজিজা আক্তার জানত, মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে চাচির লোকেরা তার গায়ে আগুন দিয়ে ঝলসে দিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সে বাবাকে বলছিল – ‘আব্বা, আমি কাকির মোবাইল নিসি না।’ মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে ২৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের সাগর নামক কিশোরকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২১ অক্টোবর মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে বরিশালের মুলাদী উপজেলার চর শফিপুরের সমিতিহাট এলাকায় শাওন নামের ১৩ বছর বয়সের এক কিশোরের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। এখন শোনা যাচ্ছে, চাচির সঙ্গে অপর পুরুষের সম্পর্কের কথা জেনে ফেলায় আজিজাকে হত্যা করা হয়েছে, যাতে এটি ফাঁস না হয়। কুমিল্লা সেনানিবাসে তনু হত্যা ও টাঙ্গাইলে বাস কর্মচারীদের লালসার বলি রৃপার কথা আমাদের জানা আছে। কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কত নারী ও শিশু যে ধর্ষণ ও নির্মমতার শিকার হচ্ছে, সে খবর আমরা কতটুকু রাখি?
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ভয়াবহ রৃপ নিয়েছে। তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য, আমাদের সমাজে নারী ও শিশুর প্রতি আচরণ কখনও মানবিক ছিল না। দীর্ঘকাল বেত দিয়ে পিটিয়ে শিশুদের ‘মানুষ’ করার তত্ত্বের প্রয়োগ ছিল। এখনও আছে। ভালো শিক্ষক মানে হাতে বেত থাকবে, তাকে দেখে শিক্ষার্থীর হৃৎকম্পন শুরু হবে। বউয়ের গায়ে হাত তোলার রেওয়াজ ছিল। স্ত্রীলোককে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেটি নাকি জরুরি! এমন মনস্তত্ত্বের খানিকটা পরিবর্তন হলেও তার অবশেষ আছে। এখনও পুরুষতান্ত্রিকতা প্রকট। পুরুষের চোখে নারী অধস্তন, সেবাদাসী। তবে এটি একমাত্র কারণ নয়, আরও বহুবিধ কারণ আছে। সমাজে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের চিরাচরিত প্রবণতা আছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে এমন নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। এখন তা বেড়ে যাওয়ায় প্রায়শই নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু, বিশেষ করে প্রান্তিক বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারী ও শিশু- শিশুদের মধ্যে কন্যাশিশু নির্যাতনের হারই বেশি। নানা মহল থেকে এর কারণ হিসাবে সুশাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা বলা হচ্ছে- তা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই।
আকাশ সংস্কৃতি অন্যতম কারণ, তা স্বীকার্য। ঘরে বসে কম্পিউটারের বোতাম টিপে নানা তথ্য, নানা কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। তার মধ্যে থাকে পর্নোগ্রাফি, ভায়োলেন্সের নানা দৃশ্যও। যা তরুণদের ভায়োলেন্সপ্রবণ ও বিপথগামী করে। রাজনীতির ছাতার নিচেও অপরাধপ্রবণতা ডানা মেলছে; যা সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়ছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে- আমরা সমাজ জীবনের একটি সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি। একদা গ্রামভিত্তিক সমাজ ছিল। পাশাপাশি শহরও ছিল। শহরের লোকসংখ্যা ছিল খুব কম। স্বাধীনতার আগে শতকরা ১০ ভাগের বেশি ছিল না। তখন শহরগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও সামাজিক পরিবেশ ছিল গ্রামের মতো। শহরবাসীর মধ্যে সনাতন সামাজিক মূল্যবোধই ছিল ক্রিয়াশীল। স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে আশির দশক থেকে নানা বাস্তবতায় শহরের লোকসংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এখন শহরবাসী শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ হলেও আর এক দশকে শহরেই বেশিরভাগ লোক বাস করবে বলে অনুমান করা যায়। নানা স্থানের ব্যাপক মানুষ শহরে ছুটে আসছে। তারা এসে সনাতন মূল্যবোধ পরিহার করছে। আবার নাগরিক মূলবোধও ধারণ করতে পারছে না। আবার গ্রামগুলো হয়ে উঠেছে শহরের মতো। সেখানেও মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটছে। গ্রাম ও শহরের সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। একটি ভঙ্গুর বা নির্মীয়মাণ সমাজের চেয়ে স্থিতিশীল সমাজে অপরাধপ্রবণতা কম। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, নতুন ঢাকার চেয়ে পুরান ঢাকায় অপরাধপ্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম। এর কারণ, সেখানে অচেনা লোকের সংখ্যা কম। সবাই প্রায় সবার চেনা। অচেনা রাজ্যে মানুষ যতটা অপরাধপ্রবণ, চেনা রাজ্যে ততটা নয়। যেসব শহরে ক্লাব, ক্রীড়া সংগঠন, পাঠাগারসহ নানা সংগঠনে জনগণ সম্পৃক্ত, সেখানে মানবিক মূল্যবোধও তত বিকশিত হয়। এসব নাগরিক উদ্যোগ জরুরি।
এ পরিবর্তন কোনো বিবেচনায় বিপ্লব নয়, তবে এটি এক ধরনের বিবর্তন। এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ধাত্রিত্বের, সুশাসনের। আইনের যথার্থ প্রয়োগ এ অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনতে পারে। শিশু রাজন হত্যার বিচারসহ কিছু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপরাধীদের শাস্তি হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালী পরিবার বা রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে- এমন আসামিকে গ্রেফতারও করা হয় না, গ্রেফতার করে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও সাজা হয় না। সাজা হলেও রাষ্ট্রপতির ‘অনুকম্পা’ পাওয়া যায়। যার ফলে অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে, অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। তাই ‘বরপুত্ররা’ কিছু তোয়াক্কা করছে না, ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। এভাবেই অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে দিন দিন। অপরাধীরা হচ্ছে উৎসাহিত। আকাশ থেকে পাওয়া সবকিছু গ্রহণের ক্ষেত্রেও সচেতন হওয়া দরকার। চীনে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি, ভায়োলেন্স সংবলিত ছবি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেটি করা কঠিন কাজ। এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নযোগ্য কি-না তা নিয়ে কথা আছে। তবে আমরাও আমাদের মতো করে আকাশে আনন্দ ভুবন গড়তে পারি এবং তরুণদের আকৃষ্ট করতে পারি। রাষ্রদ্ব ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের এমন উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সেটি করতে পারলে নতুন প্রজন্ম জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেও ধারণ করতে পারবে। এমন উদ্যোগ ছাড়া সুস্থ জীবনবোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠী গড়ে উঠবে না।
আমাদের সমাজে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এর অন্যতম কারণ কম্পিউটারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা জীবন। এ যন্ত্রের মধ্যে ভুল পথে চলার হাতছানি আছে, যা থেকে অনেক শিশুই বিপথগামী হয়। বিল গেটসও তার অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুসন্তানের হাতে সেলফোন দেননি। সম্প্রতি ব্রিটিশ দৈনিক দ্য মিররে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের খাবার টেবিলে সেলফোন থাকে না। অন্তত ১৪ বছরের আগে সন্তানদের সেলফোন তুলে দিইনি।’ সন্তানদের ঘুমের জন্যও সময় নির্ধারণ করে দেন তিনি। কিন্তু আমরা আমাদের সন্তানদের চাহিদা অনুযায়ী সব কিছুই দিচ্ছি। শিশুদের যন্ত্র থেকে দূরে রাখছি না। ফলে যন্ত্রের মধ্য দিয়ে আসা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও তরুণরা।
আমাদের অপরিকল্পিত শহরে প্রয়োজনীয় খেলার মাঠ নেই। নেই পাঠাগার, ব্যায়ামাগার, যা শিশুর শৈশব কেড়ে নিচ্ছে। এর ফলে শৈশব-বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে ক্রোধ ও ক্ষোভের জন্ম নিতে পারে। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই অপরাধপ্রবণতা কমাতেই কেবল নয়। আজকের শিশু যাতে সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে, সে জন্য চাই যুগোপযোগী শিক্ষা ও শিশুর বাসযোগ্য পরিবেশ। শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য চাই খেলাধুলা, সঙ্গীত, নৃত্যসহ নানা আয়োজন। এ সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। খোদ রাজধানীর মাঠ, পার্ক, খোলা জায়গা বেদখল হচ্ছে, সেখানে গড়ে উঠছে নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। তা উদ্ধার করার বিকল্প নেই। রাষ্ট্র ও সমাজকে দৃষ্টি দিতে হবে সেসব হতদরিদ্র পরিবার ও পথশিশুদের প্রতি- তারাও যেন আশ্রয় ও দু’বেলা খেতে পায়, পেতে পারে শিক্ষার অধিকার।
পরিশেষে বলব, অপরাধপ্রবণতা রোধে আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। তাই আইনের প্রয়োগে সংশ্নিষ্টদের সচেষ্ট হতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে- সেটিই সময়ের দাবি।
আবু সাঈদ খান: লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com