
আবু সাঈদ খান : শৈশবের গল্প দিয়ে শুরু করি। আমাদের বাহিরবাড়ির এক কোণে কয়েকটি বেগুন গাছ। প্রচুর বেগুন ধরেছিল। কিন্তু ইঁদুর বেগুন কেটে ফেলছিল। তখন কীটনাশক দিয়ে কীট-পতঙ্গ মারার চল ছিল না। ফাঁদ দিয়ে বেশ ক’টি ইঁদুর মারা হলো। তারপর দেখতে দেখতে কিছু বেগুন লকলক করে বড় হলো। আমার দাদি সকাল-বিকেল বেগুনগুলো চোখে চোখে রাখতেন। গুনে গুনে দেখতেন। একদিন সকালে মহাউৎসাহে দাদির সঙ্গে বেগুন তুলতে গেলাম। গিয়ে দেখি, একটি বেগুনও নেই। দাদির কপালে হাত। বললেন, হায় আল্লাহ! আমি বললাম, ইন্দুরে খাইছে। দাদি বললেন, নারে ভাই, মানুষ-ইন্দুরে খাইছে। তারপর আমার বায়না, মানুষ-ইন্দুর কেমন, মানুষ-ইন্দুর দেখব। সেদিন নাকি এটি ছিল ‘টক অব দ্য ভিলেজ’। এ গল্পের সঙ্গে সুনামগঞ্জের হাওরের বাঁধ ভাঙার গল্পের মিল আছে। পার্থক্য, বেগুনচোর যে মানুষরূপী ইঁদুর, আমার দাদি চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বাঁধ ভাঙার পেছনে যে মনুষ্যরূপী ইঁদুরের কাজ তা বুঝতে পারলেন না বা বুঝতে চাইলেন না। তিনি দুষেছেন- জলবায়ু, ইঁদুর আর কৃষকদের। তিনি জলবায়ু, বাঁধের গায়ে ইঁদুরের গর্ত ও নৌকা পারাপারের জন্য কৃষকদের বাঁধ কাটাকে আসল কারণ মনে করেন। গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে যথাসময়ে বাঁধ মেরামত না হওয়ায় বন্যায় বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে গেছে বলে পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত মন্তব্য করেন। তিনি মেরামতের টাকার হরিলুট হওয়ার অভিযোগ করেন। পানিসম্পদমন্ত্রী হরিলুটের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, ‘এসব কাজ নিয়ে লুটপাট হতে পারে। তবে হরিলুট হবে বলে আমি মনে করি না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজে দুর্নীতি হয় না, এমন কথা আমি বলব না।’ এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির কারণে বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়েছে, এটা আমি মানতে রাজি না’ (প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০১৭)। বাঁধের গায়ে ইঁদুর যে বাসা বেঁধেছিল, কোন কোন স্থানে কৃষকরা নৌকা করে ফসল নিতে বাঁধ কেটেছিল; তা সত্য। কিন্তু দ্রুত হাওর ভেসে যাওয়ার আসল কারণ যে যথাসময়ে বাঁধ মেরামত ও নজরদারি না করা।
অভিযোগ আছে- ঠিকাদাররা কাজ করার বিল জমা দিয়ে টাকা তুলে পকেটে পুরেছেন, কাজ করেননি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের যোগসাজশে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, তা আমলে নিয়েছে দুদক। দুদক এ ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ঠিকাদারসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুপারিন্টেনডেন্ট নূরুল ইসলাম, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাইসহ ১২ জন কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। এই মানুষরূপী ইঁদুররা কেবল বাঁধ রক্ষার ক্ষেত্রে নয়, সামগ্রিক উন্নয়নের শত্রু। দুর্নীতিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন নেই। কিন্তু দুর্নীতি যে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে খামছে ধরেছে, তা অস্বীকার করার মতো নয়।
বাংলাদেশে এক সময় ইঁদুরের উৎপাত ছিল। মাঠের ফসল ইঁদুরের পেটে যেত, মানুষ থাকত অনাহারে। এখন জলবায়ুর পরিবর্তন বা কীটনাশকের ব্যবহার বা অন্য কারণে ইঁদুরের প্লাবন নেই। কিন্তু মনুষ্যরূপী ইঁদুরের উপদ্রব যে কত ব্যাপক, তা সবার জানা। এসব মানুষ-ইঁদুর কেবল বাঁধের মাটি খায় না, সড়কের ইট-সিমেন্ট-পিচ-সুরকিও খায়, পাহাড়-জমি-নদী-বনভূমিও গ্রাস করে, ব্যাংক লোপাট করে। যা সামনে পায় তাই দখল করে। এই দুর্নীতি-দখলবাজিই আমাদের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় বড় হুমকি।
যে সড়ক ১০ বছর টেকার কথা, মাত্রাতিরিক্ত লুটপাটের কারণে সেটি দুই বছরও টেকে না। অথচ আমাদের এখানে সড়ক, ভবন, বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। অনেক উপমা দেওয়া যায়। যেমন- চার লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণে বাংলাদেশে এক কিলোমিটারে ব্যয় বাংলাদেশি টাকায় ১২৩ থেকে ২৫০ কোটি টাকা। অথচ এক কিলোমিটারের ব্যয় ভারতে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা, পাকিস্তানে ৭০ থেকে ১১০ কোটি টাকা, মালয়েশিয়ায় ৬০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা এবং চীনে ৯০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ. দি ডেইলি স্টার. নেট; ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬)। অথচ এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি কম। বিস্ময়কর ব্যাপার, বাংলাদেশের ভেতরেও নির্মাণ ব্যয়ে তারতম্য আছে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে প্রতি কিলোমিটার ২৩০ কোটি, কুড়িল ফ্লাইওভারে তা ১১৪ কোটি টাকা, জিয়া কলোনি ও বনানী ফ্লাইওভারে ৯৯ কোটি টাকা। (প্রাগুক্ত) অন্যান্য ক্ষেত্রেও এমন এমন তথ্য অঢেল। অনিয়ম, দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহির অভাবই যে এর মূল কারণ, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।
ঘুষ এখন যেন সংস্কৃতির অংশ। একে আর ঘুষ বলা হয় না। ঘুষখোর বলে কাউকে গালিও দেওয়া হয় না। এটির নাম একদা ছিল দক্ষিণা। রাজকর্মচারীরা দক্ষিণহস্ত প্রসারিত করে নিতেন, তাই হয়তো দক্ষিণা। এর নাম ছিল উপঢৌকন, বকশিশ। এমনকি ধর্মীয় একটি পরিভাষাও আছে- হাদিয়া। এর আধুনিক নাম পার্সেন্টেজ, স্পিড মানি। এটি বেতনের অতিরিক্ত বলে উপরিও বলা হয়। এক ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ঘুষ কর্তাদের খানা। তারা খানেওয়ালা, তিনি খিলানেওয়ালা। তিনি তাদের খাওয়ান, তাই কাজ পান। তাছাড়া ফাইল নড়ে না, ব্যাংক ঋণ মেলে না, বিদ্যুৎ-গ্যাসের লাইন পাওয়া যায় না, প্রকল্প অনুমোদন হয় না। কোনো কিছুই হয় না। এটি নিয়ম হয়ে গেছে। অনেকে কৌশলে ঘুষের স্বপক্ষে যুক্তি দেন। বলেন, ঘুষ সব দেশেই আছে, বাংলাদেশেও আছে। কথাটি সত্য। তবে উন্নত দেশে বিচার আছে, নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও আছে। এমনকি পানামা পেপার্সে প্রকাশিত কেলেঙ্কারি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে তোলপাড় হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অপসারিত হয়ে গেলেন। বাংলাদেশে এতে কাদের নাম আছে বা নেই, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, মোগল আমলে দুর্নীতিবাজের শাস্তির নমুনা আছে। যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী উপমহাদেশের সম্পদ দু’হাতে লুটেছে, তারাও গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের দুর্নীতিকে ক্ষমা করেনি। তাকে পার্লামেন্টে অভিশংসন করা হয়েছিল। আর দুর্নীতি ও সম্পদ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত ক্লাইভও আত্মহত্যা করেছিলেন।
বাংলাদেশেরও ‘ঘুষ খানেওয়ালা’কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে রাষ্ট্রকেই। এটি সুশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। রাষ্ট্র দুর্নীতির তদন্ত করছে না, বিচার করছে না- তা বলছি না। কিন্তু সাফল্য কতটুকু? অনেক ক্ষেত্রেই রাঘববোয়াল পার পেয়ে যায়, চুনোপুঁটি জেলে যায়। একদা সরকারি দলের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়া হতো না। এখন আমলে নেওয়া হয়, তদন্ত হয়; কিন্তু অভিযোগ আপনাআপনি খারিজ হয়ে যায়। অভিযুক্তরা ‘ধোয়া তুলসীপাতা’য় পরিণত হন।
এ প্রসঙ্গে একাত্তরের উত্তাল দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উক্তি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেছেন, আপনারা গোলাকাটা ইঁদুর থেকে সাবধান থাকবেন। তিনি বুঝিয়েছিলেন, আমাদের ঘরে, গোলায় শত্রুরা লুকিয়ে আছে। আসলেও ছিল। ২৫ মার্চের পর ঘরের ইঁদুরগুলো গোলা কাটল, পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মেলাল। তারাই তো শান্তি কমিটি-রাজাকার হয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের পথ চিনিয়ে দিল, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিল। এখনও দেশে গোলাকাটা ইঁদুর আছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঁধকাটা, রাস্তাকাটা, পাহাড়কাটা, ব্যাংককাটাসহ নানা কিসিমের ইঁদুর। দেশের সামগ্রিক স্বার্থে ব্যবস্থা নিতে হবে সেসব শত্রুর বিরুদ্ধে- যারা দেশের সম্পদ হরিলুট করছে, উন্নয়নের চাকা খামচে ধরছে। এসব ইঁদুরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে উন্নয়নের চাকা ঘুরবে না, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না। আর এটি করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও রাজনীতিরই-ব্যক্তিগতভাবে তা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
আবু সাঈদ খান: লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com