আবু সাঈদ খান : রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তি, প্রজাতন্ত্রের অভিভাবক। তবে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেছিলেন, ফিতা কাটা আর মিলাদ পড়া ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো কাজ নেই। কথাটি রূঢ় সত্য। বিভিম্ন মহল থেকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলা হচ্ছে- আজ সে আলোচনায় যাব না।
ক্ষমতা কম আর বেশি যা-ই থাক, প্রজাতন্ত্রের অভিভাবকের বক্তব্যের আলাদা তাৎপর্য আছে। এমনই তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বনানীর দুর্গাপূজামন্ডপে তিনি বলেছেন, ‘ধর্ম নয়; ধর্মনিরপেক্ষতাই হোক দেশ গঠনের বুনিয়াদ।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বা জাতি গঠনের অশুভ চিন্তা থেকে অতীতে জাতিতে জাতিতে বহু সংঘাত হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে। ধর্মের নামে মনুষ্যত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। আমরা সেই ধর্মভিত্তিক জাতি বা রাষ্ট্র গঠনের পাঁয়তারা আজও লক্ষ্য করি। বিশ্ববাসীকে এই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। এটি সময়োপযোগী উচ্চারণ।
ধর্ম যে রাষ্ট্রের বুনিয়াদ, তা ধর্মরাষ্ট্র। এই ধর্মরাষ্ট্রই পৃথিবীতে অনেক অধর্ম ও অশান্তির জন্ম দিয়েছে। ইউরোপের ইতিহাসে আমরা দেখি, যখন প্রজা বিদ্রোহ হয়েছে, সাধারণ মানুষ অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। তখন রাজার বর্শা ও পোপের ফতোয়ার তীর একই সঙ্গে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তা মোকাবেলা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ বা ইহজাগতিক রাষ্ট্র। তাই ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর ওপর ধর্ম বা পোপের খবরদারি নেই। এশিয়ার বেশিরভাগ রাষ্ট্রকে এক কাতারে ফেলার সুযোগ নেই। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ধর্মরাষ্ট্র; দুই-ই আছে। আর বেশিরভাগ রাষ্ট্রই দুইয়ের মিশেল অর্থাৎ না ধর্মনিরপেক্ষ, না ধর্মরাষ্ট্র। অথচ ইউরোপে রাজনীতিতে যখন পোপের প্রবল দাপট, তখন উপমহাদেশের রাজ্যগুলো অনেকাংশে ধর্মের প্রভাবমুক্ত ছিল। এখানে অশোক ও আকবরের মতো শাসক দেশ পরিচালনা করেছেন, যারা ধর্ম পরিচয়ের বাইরেও সব মানুষকে একই দৃষ্টিতে দেখেছেন। বাংলার সুলতানি আমলের কথাও বলা যায়। সুলতানরা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান হলেও তাদের শাসনব্যবস্থা ছিল অনেকাংশে ধর্মনিরপেক্ষ। রাজকর্মচারীদের বড় অংশ ছিল হিন্দু। কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতাই ছিল প্রধান বিবেচ্য। উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ধর্মভিত্তিক বিভাজন রেখা টেনেছিল ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী। সেটি ছিল তাদের শাসন ও শোষণ টিকিয়ে রাখার অপকৌশল।
উপমহাদেশের মানুষ ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়েছে। তবে ধর্মভিত্তিক বিভাজনের চিন্তা এসেছে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দশকে। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের মূলে ছিল জমি ও চাকরির ব্যাপার। জমিদার হিন্দু, প্রজা মুসলমান; মহাজন হিন্দু, খাতক মুসলমান। ব্যাপার ছিল শোষক আর শোষিতের। এ শোষণের অবসানে কর্মসূচি নেয়নি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। ফলে তা রূপ নিয়েছিল হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বে। এটিকে কাজে লাগিয়েছিল হিন্দুত্ববাদী আর মুসলমান স্বাতন্ত্র্যবাদীরা। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে বিনায়ক দামোদর সাভাকর ঘোষণা করেন- হিন্দুজ আর এ নেশন। এর দুই বছর পর ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে মোহাম্মদ আলী জিম্নাহ একই কথা প্রতিধ্বনিত করেন- মুসলমানস আর এ নেশন টু এনি নেশনহুড। এভাবেই শুরু হলো হিন্দু-মুসলমানের উল্টোপথের যাত্রা। যার পরিণতিতে ‘৪৬-এর রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ও ‘৪৭-এ দেশভাগ। তখন বেদনাবিদ্ধ অম্নদাশঙ্কর রায় লিখলেন, ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর ‘পরে রাগ করো/ তোমরা যেসব বুড়ো খোকা/ বাঙলা ভেঙে ভাগ করোঙ্ঘ’ তখন উপমহাদেশজুড়ে ধর্মের মাতম। ভারত থেকে দলে দলে লোক পাকিস্তানে, আর পাকিস্তান থেকে ভারতে ছুটছে। এ পটভূমিতে লেখা একটি গল্প- লেখকের নাম মনে পড়ছে না। এখনকার মুম্বাইয়ের একটি মুসলিম পরিবার। করাচিতে হিজরতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সেই পরিবারের এক যুবক মানসিক রোগী। ক্ষণে ভালো, ক্ষণে অপ্রকৃৃতস্থ। সে এসব গাট্টিবোচকা বাঁধা দেখে বলল, তোমরা এসব কী করছ? একজন বলল, আমরা দেশে যাব, করাচি যাব। তখন অপ্রকৃতস্থ যুবক বলল, ‘এই বোম্বেতে আমাদের ১৪ পুরুষের বাস, বাপ-দাদার কবর এখানে। আর এটি আমাদের দেশ নয়; আমাদের দেশ করাচিঙ্ঘ সবাই কি পাগল হয়ে গেল নাকিঙ্ঘ’ এভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তখন ‘সব বুড়ো খোকাকে’ পথ ভুলিয়েছিল।
আমরা জানি- ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। পূর্ব বাংলা শৃগ্ধখলিত হলো পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতর। পাকিস্তানের গণপরিষদের সভায় জিম্নাহ ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাস উল্লেখ করে বলেছিলেন, রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে আর কেউ হিন্দু, মুসলমান থাকবে না। তা সত্য হয়নি। পাকিস্তানে ধর্মই হয়ে উঠেছিল রাজনীতির হাতিয়ার। দেশটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। পাকিস্তানে ২৪ বছর ধর্মের নামেই দেশ শাসন করা হয়েছে। যখনই পূর্ব বাংলার মানুষ অধিকারের দাবি তুলেছে, স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে, তখন জবাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তারস্বরে চিৎকার করেছে- গেল গেল, ইসলাম গেল; গেল গেল, পাকিস্তান গেল। ইসলাম আর পাকিস্তান ছিল সমার্থক। তাদের চোখে বাংলা ছিল হিন্দুর ভাষা। ‘৫৪তে বলা হয়েছিল- হক- ভাসানীর নৌকায় ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন প্রমুখ ইসলামের শত্রু, ভারতের চর; ৬ দফা, ১১ দফা ইসলাম ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ইত্যাদি। আর একাত্তরে নির্মম গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ করেছে ইসলাম রক্ষার নামেই। ইসলাম রক্ষার নামে নেওয়া হয়েছিল ‘পোড়ামাটি’ নীতি।
ধর্মের নামে দেশ শাসনের এই ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন রাষ্ট্র্রপতি আবদুল হামিদ। ষাটের দশকে তিনি ছিলেন রাজপথের সংগ্রামের মিছিলে শরিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন রাজনীতিক তিনি। একজন পোড়-খাওয়া রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও ধর্মভিত্তিক জাতি বা রাষ্ট্র গঠনের অশুভ পাঁয়তারা লক্ষ্য করেছেন।
আমরা দেখছি, পৃথিবীর নানা দেশে মুসলিম জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রতিবেশী মিয়ানমারে বৌদ্ধ আধিপত্যবাদের নির্মম শিকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা। প্রাণভয়ে ৯ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এসে হিন্দুত্ববাদী নীতি কার্যকর করছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর পাঠ্যপুস্তক থেকে মুসলমান লেখকদের রচনা, এমনকি রবীন্দ্রনাথের মানবিক রচনা পর্যন্ত বাদ দেওয়া হচ্ছে। দলের ক্যাডাররা গোরক্ষার নামে মানুষ হত্যায় মেতেছে। সংখ্যালঘুদের বাংলাদেশি আখ্যায়িত করে দেশছাড়া করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব নিয়ে উদ্বিঘ্ন ভারতের বিবেকবান মানুষ। প্রতিবাদ হচ্ছে, কিন্তু হিন্দুত্ববাদের আস্ম্ফালন বন্ধ হচ্ছে না।
আশার কথা, বাংলাদেশে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার সম্নিবেশিত হয়েছে। কিন্তু এখনও রয়েছে রাষ্ট্রধর্ম। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ‘রাষ্ট্রধর্ম’। এমন বৈপরীত্য নিয়ে পথচলা। এটি সত্য- বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলো শক্তিশালী নয়। তবে মনের বাঘে আক্রান্ত ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদাররা। হেফাজতের দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘হিন্দু’ ও প্রগতিশীল লেখকদের রচনা বাদ দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের প্রস্তাব বাদ দিয়ে তাদের যথেচ্ছ চলার ছাড়পত্র দিয়েছে সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী দলের নেতা-কর্মীদের দলে টেনে নিতে দ্বিধা করছে না ক্ষমতাসীনরা। আর শত সমালোচনার মুখেও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত দোস্তি অটুট। হেফাজতকে নিয়ে দুই বড় দলই টানাটানিতে ব্যস্ত। কে মাথা পাবে, কে ল্যাজ পাবে- এ নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা। এভাবেই ঘটছে রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ। এ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা হবে কেবলই সংবিধানের অলঙ্কার।
এ সবকিছু অজানা নয় রাষ্ট্রপতির। তাই তিনি দেশবাসীকে ধর্মনিরপেক্ষ বুনিয়াদের কথা স্ট্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আর যারা হীন রাজনীতির স্বার্থে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে স্থান করে দিচ্ছেন, রাষ্ট্রপতির এ বক্তব্য তাদের জন্যও সতর্কবার্তা।
আবু সাঈদ খান : লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com