আবু সাঈদ খান : এখনকার তরুণদের জানার কথা নয়। যারা আশির দশকে বা তার আগে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে- ছাত্র সংসদ নির্বাচনকালে হরেক রকমের স্লোগান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতো। রাজনৈতিক কড়া কড়া স্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে হালকা মেজাজের ধ্বনি দেওয়া হতো। এসবের একটি হচ্ছে- খবর আছে নাকিরে?/আছে আছে/কোন সে খবর?/’তনু-মনু’ পরিষদ, ‘তনু মনু’ পরিষদ। বর্তমান রাজনীতির মাঠে স্লোগানটি যেভাবে দেওয়া যেতে পারে, সেটি এমন- খবর আছে নাকিরে?/আছে আছে/কোন সে খবর?/এরশাদ এরশাদ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাজনীতিতে সদা আলোচিত চরিত্র।
গত ২৮ আগস্টের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর এরশাদের নেতৃত্বাধীন ৫৮ দলীয় জোট থেকে ইসলামপন্থি ২১ দল বেরিয়ে গেছে। এর আগেও ১১ দল জোট ছেড়েছে। এরশাদ নির্বিকার। ওদের থাকা না-থাকা নিয়ে তার সুখ-দুঃখ নেই। তিনি জানেন, এসব দল কাজির গরুর মতো। কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। এর মধ্যে কয়েক কিসিমের দল আছে। বড়গুলো ভক্সওয়াগন পার্টি। এই মডেলের গাড়িতে চালকসহ চারজনের সিট আছে। এসব দলের সদস্য অনুরূপভাবে চার। কিছু আছে, বাইক পার্টি মানে দু’জনের পার্টি- একজন সভাপতি ও আরেকজন সাধারণ সম্পাদক। আর বেশিরভাই ‘ওয়ানম্যান ওয়ান পার্টি’। এমন এক পার্টির নেতার ভাতিজার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি রসিকতা করে বললেন, আমার চাচার পার্টিকে সবাই ‘ওয়ানম্যান ওয়ান পার্টি’ বলে। কথাটা সবসময় ঠিক না। যখন চাচা দলের ঘোষিত নীতিতে অটুট থাকেন, তখন সেটি ওয়ানম্যান ওয়ান পার্টি। আর যখন ঘোষিত নীতিতে আস্থা হারান, তখন সেটি নো ম্যান ওয়ান পার্টি হয়ে যায়। এসব দলের অফিস নেই। তবে প্যাড আছে, ফাইল আছে। এটি বগলদাবা করে নেতা ছোটেন। আগে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক সংবাদপত্র অফিসে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পেঁৗছে দিতেন। এখন আর নেতাকে যেতে হয় না। ২০-২৫ টাকা দিয়ে যে কোনো কম্পিউটার থেকে বিবৃতি পাঠিয়ে দেওয়া যায়। নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন চালু হওয়ায় এরা বেকায়দায় পড়েছেন। নিবন্ধন করাতে অনেক কসরত করতে হয়। তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই জোটের মধ্য দিয়ে কিছু পাওয়ার রাজনীতি। এরাই ছিল এরশাদের দলের শক্তি। দুই দফায় এমন ৩৪টি দল এরশাদের জোট ছাড়ল। আমার বিশ্বাস, এরশাদ প্রয়োজন মনে করলে ৬৮ দলকে জোটে নিয়ে আসতে পারবেন। এ ব্যাপারে তিনি সিদ্ধহস্ত।
আমরা রাজনীতিতে সামরিক শাসকদের ভূমিকার কথা ভুলে যেতে পারি না। সেনাশাসকরা কেবল সংবিধান লঙ্ঘন বা রাজনীতিতে পরিত্যক্ত পাকিস্তানি ভাবধারার সংযোগ ঘটাননি; রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে নানাভাবে কলুষিত করেছেন। তারা রাজনীতিতে ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতার ব্যবহার, ‘হোন্ডা গুণ্ডা মণ্ডা’র ব্যবহার, টাকা ও পদ দিয়ে রাজনীতিকদের দলে ভেড়ানো বা মাথা কেনা, নীলনকশার বা পাতানো নির্বাচন, মিডিয়া ক্যু ইত্যাদি অপকর্মে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এ সবকিছু জিয়াউর রহমান শুরু করেছিলেন আর তার উত্তরসূরি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নির্বাচন ও রাজনীতিতে সব অনিয়ম যে সামরিক সরকারের অপসৃষ্টি তা বলা যাবে না। তবে তারা রেকর্ড গড়েছেন। যেমন পাকিস্তান আমলে নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতি ছিল, স্বাধীনতার পর এসবের সঙ্গে যুক্ত হলো বুথ দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, প্রার্থী অপহরণ ইত্যাদি। আর নীলনকশার বা পাতানো নির্বাচন বা মিডিয়া ক্যুর নির্বাচন সামরিক শাসকের অবদান! শোনা যায়, ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য আসন বরাদ্দ করে রাখা হয়েছিল। আলাদা ছিল না ‘৮৬ ও ‘৮৮ সালের নির্বাচন। ১৯৯৬-এর মধ্য ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সামরিক শাসকদের আমদানিকৃত ‘ইলেকশন ইঞ্জিয়ারিং’-এর প্রভাবমুক্ত ছিল না।
সামরিক শাসকরা রাজনীতিকদের মাথা ক্রয়ে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। তারা নেতাদের খরিদ করে দলের নেতা বানিয়েছেন। অন্য দলের নেতাদেরও বশ করে তাদেরকে দিয়ে নিজেদের গুণকীর্তন করিয়েছেন। আবার কাউকে বশ করে আন্দোলনের রাজপথ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। রাজনীতি তখন থেকে লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছিল। ওই আমলেই রাজনীতিতে সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটল। তারা অর্থ বিনিয়োগও শুরু করলেন। এর আগে রাজনীতিতে দমন-পীড়ন ছিল, জেল-জুলুম ছিল; তবে এমন কেনাবেচা ছিল না।
রাজনীতির বাণিজ্যিকায়ন ও দুর্বৃত্তায়নে যুব সমাজও বিপথগামী হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে বেকার যুবকরা অস্ত্র হাতে রাজনৈতিক ক্যাডার হলো। এ সবকিছুই তরুণ সমাজের ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এ প্রসঙ্গে একজন অধ্যাপকের কথা বলতে চাই। তিনি তার অব্যক্ত মনোকষ্টের কথা বলতে আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন তার ৬-৭ ভাইবোনের মধ্যে মেধাবী। মাস্টার্সে ভালো ফল করে কলেজের শিক্ষক হয়েছিলেন। ভাইবোনসহ সবাই তাকে মানতেন। ছেলেমেয়েদের বলতেন, চাচার মতো ভালো রেজাল্ট করো। এর মধ্যে কয়েকবার ইন্টারমিডিয়েট ফেল করা তার বখাটে ভাই ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার হলো। রাতারাতি মোটরসাইকেল কিনল। দুই বছরের মাথায় প্রাইভেট গাড়ি। সে বড় ঠিকাদারে পরিণত হলো। প্রাসাদোপম বাড়ি করল। পরিবারের কাছে সে তখন গুরুত্বপূর্ণ। তার ছেলেমেয়েরা চাচার গাড়িতে এখানে-সেখানে যায়। দামি দামি পোশাক গিফট পায়। অধ্যাপক সাহেবের ছেলেমেয়ে বলে, বাবা ব্যর্থ। চাচা সফল। তিনি কান্না চেপে বললেন, আমার ছেলেমেয়ে দুটি যদি ওই সাফল্যের পথ ধরে, তখন সে ব্যর্থতা কী করে মানব! সামরিক শাসকরা এভাবেই তরুণ সমাজকে বিপথগামী করে, নৈতিক অবক্ষয়ের কিনারায় নিয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, তারা যে সর্বনাশের খাল কেটেছিল, গণতন্ত্রের দাবিদাররা সেই খালেই এখন হাবুডুবু খাচ্ছে।
সামরিক শাসকদের কারসাজির মধ্যে ছিল ভুঁইফোড় দল ও ভুঁইফোড় রাজনীতিক। জিয়া ও এরশাদের আমলের রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে একদল ভুঁইফোড় রাজনীতিক অংশ নিয়েছিলেন। তখন ছক্কু মিয়া মার্কা রাষ্ট্রপতি প্রার্থীরা লোক হাসিয়েছেন। ভুঁইফোড় নেতাদের মন্ত্রী বা এমপি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতো না। তবে নগদ নারায়ণ মিলত। তারা সরকারের গৃহীত নীতি ও পদক্ষেপের সমর্থনে বিবৃতি দিতেন। লোক ভাড়া করে মিছিল করাতেন। এটি ছিল রাজনীতির আরেক রূপ।
এসব রাজনীতির প্রকৌশলীদের অন্যতম এরশাদ। তবে জিয়া-এরশাদের কৃতিত্ব- আজ যারা তাদের শাসনামলের সমালোচনা করছেন, দেশের অধঃপতনের জন্য ওই জেনারেলদের দায়ী করছেন। তারাও আজ তাদের অনুসরণ করছেন। এরশাদ নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ করেছিলেন। এসব সশস্ত্র ক্যাডার দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনকারীদের হটাতে চেয়েছিলেন। সেটি পারেননি। ‘৯০-এর ২৭ নভেম্বর ডা. শামসুল আলম খান মিলনের রক্তে বাংলা জ্বলে উঠেছিল। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা স্বৈরশাসক এরশাদকে হটিয়েছিল। স্বৈরাচারের পতনের পর এরশাদের পথ অনুসরণ করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তার প্রতিপক্ষকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়া করেছিল। এখন ছাত্রলীগও প্রতিপক্ষকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিচ্ছে না। সামরিক শাসকরা রাজনীতি ও নির্বাচনে যেসব প্রযুক্তির প্রয়োগ করেছিলেন, গণতন্ত্রের ‘পথযাত্রীরা’ তা পরিহার করতে পারছেন না। জিয়া নেই। তিনি বেঁচে থাকলে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে খাপ খাওয়াতে পারতেন কি-না. জানি না। তবে এরশাদ পেরেছেন। এরশাদ সামরিক শাসক হয়েও রাজনীতিকদের টেক্কা দিচ্ছেন। একাধিকবার ভানুমতির খেলা দেখিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি একবার আওয়ামী লীগের দিকে আবার বিএনপির দিকে ঝুঁকেছেন, এভাবেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। ২০০৭-এ যখন নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তখন একবার বিএনপি, আরেকবার আওয়ামী লীগ করে দাম বাড়িয়েছিলেন। আর ২০১৪ সালে অবশ্য নতুন খেলা দেখাতে গিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। বলা যায়, সেটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র। তা কাটিয়ে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে তিনি একই সঙ্গে সরকারে, আবার বিরোধী দলেও। তিনি মন্ত্রীর মর্যাদায়, দলে মন্ত্রী আছেন কয়েকজন। আর দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ সংসদে বিরোধী দলের নেতা। এমন দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় দ্বিতীয়টা আছে বলে জানি না।
এখানেই শেষ নয়, মহাজোটে থেকেও তিনি ৫৮ দলের জোট করেছেন। এ যেন ঘরের ভেতরে ঘর, জোটের ভেতরে জোট। কেন এই জোট- আওয়ামী লীগের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য, না বিএনপির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য? সে যাই হোক, একই খেলা বারবার খেলা যায় না। সব খেলার শেষ আছে। এরশাদের খেলাও প্রায় খতম। তাই মনে হয়, এতদিন এরশাদ রাজনীতিকদের নিয়ে খেলেছেন। এবার তিনিই হয়তো খেলার পাত্রে পরিণত হবেন।
লেখাটি ৩০ আগস্ট ২০১৭ তারিখে সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত।
আবু সাঈদ খান : লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com