আবু সাঈদ খান : নির্বাচনই এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, যানজট, জলজট, দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, সিনেমা, নাটক, আদালতের রায়- যে বিষয়ে কথা বলুন, অনিবার্যভাবেই নির্বাচন এসে যায়; এ থেকে দূরে থাকার সুযোগ নেই। নির্বাচনে কে জিতবে বা কে হারবে এটি অবশ্য এখন মূল আলোচনার বিষয় নয়; আলোচ্য হচ্ছে নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা। এর মানে নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও গৃহীত পদক্ষেপ। অনেকের মতো আমিও মনে করি, নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি। এ ব্যাপারে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থা নাটকে দেখা বৃদ্ধের মতো; বছরে দুই-তিনবার বাসগৃহ মেরামত করবেন; কিন্তু নতুন ভবনের কথা ভাববেন না। ওই বৃদ্ধের কথারও একটি যুক্তি ছিল যে, দালানের পরতে পরতে বাপ-দাদার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতির ক্ষেত্রে এমন নয়, এটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের রেখে যাওয়া। তা হচ্ছে এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব। আজকের দুনিয়ার প্রবণতা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। বাংলাদেশের বাস্তবতায় মিশ্র পদ্ধতি হতে পারে। এর রূপরেখা নিয়ে কিছুদিন আগে লিখেছি- আজ সে আলোচনায় যাব না। বরং টক শোর এক তরুণ উপস্থাপক বন্ধুর পরামর্শ অনুসরণ করি। তিনি বললেন, ওই স্বপ্নের কথা আজ থাক; বরং বলুন, বর্তমান অবস্থায় কী ব্যবস্থা নিতে হবে?

এখন বিতর্ক হচ্ছে_ ক্ষমতাসীন সরকার কি নির্বাচনকালীন সরকার থাকবে, না বিএনপির প্রস্তাবিত সহায়ক সরকার হবে। সহায়ক সরকারের চেহারা-সুরত সম্পর্কে বিএনপি এখনও কিছু বলেনি। কবে বলবে জানি না। প্রশ্ন হচ্ছে, সহায়ক সরকারের মোড়কে আবার কি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার হাজির করা হচ্ছে, না নতুন কিছু। আগে দেখা যাক, ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনকালীন দায়িত্বে থাকলে বাধা কোথায়! ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালনের রেওয়াজ আছে। কথাটি সত্য। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে যে ৬টি সংসদ নির্বাচন হয়েছে, কোনোটিই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৪টি নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক আছে। আওয়ামী লীগ ১৯৯১ ও ২০০১-এর নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিএনপির কাছে ১৯৯৬ ও ২০০৮-এর নির্বাচন সহি নয়। এমন অভিযোগের মূলে অবশ্য পরাজয় না মানার সংস্কৃতি। তবে জনগণ, মিডিয়া, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের ৪টি নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য। এসব নির্বাচন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতায় কোনো নির্বাচন একশ’ ভাগ সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়। তুলনামূলক সুষ্ঠু হওয়াই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সরকারের শাসনকাল অবসানের পর ওই সরকার অস্থায়ীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু আমাদের সংবিধানে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচনের বিধান আছে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকারকে নিয়মিত সরকার বলে প্রতীয়মান হতে পারে। তাই সঙ্গত কারণেই সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নির্বাচন করার কথা ভাবা যেতে পারে।

সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। সংবিধান পরিবর্তন না করেও সমাধানের পথ আছে। সেটি হলো_ গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময়ের বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদও গ্রহণের প্রস্তাব করেছিলেন। তখন বিএনপি সাড়া দিলে সেটি হতো নির্বাচনকালীন সরকারের আরেকটি মডেল। এই মডেলটিকে জাতীয় বা সর্বদলীয় সরকার বলা যায়। এবার সরকারের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হবে কি-না জানা নেই। তবে গত ১৩ জুলাই সমকালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা খুবই যুক্তিসঙ্গত। আগামী নির্বাচনেও প্রাসঙ্গিক।’ বিএনপি সংসদে নেই_ কীভাবে মন্ত্রী করা হবে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার যদি ৬০ সদস্যের হয়, সেখানে ৬ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী আসতে পারবেন। বিএনপির প্রতিনিধিদের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী করে আনা সম্ভব।’ প্রয়োজনে মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা করার কথাও বলেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, তথ্য, শিক্ষা এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সরাসরি নির্বাচনে সম্পৃক্ত। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ মন্ত্রণালয়গুলো ভাগাভাগি হতে পারে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর মধ্যে। যেমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিএনপি বা জাপাকে ছেড়ে দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। এর মাধ্যমে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।’ এই মডেল সময়োপযোগী সমাধান হতে পারে।

যে সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক না কেন, কমিশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটি করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে অতীতের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। আমরা আজিজ কমিশন ও রকিব কমিশন দেখেছি। তারা সরকারের আজ্ঞাবহ বলে প্রতীয়মান হতো। এটি বলতেই হয়, এ ক্ষেত্রে হুদা কমিশন ব্যতিক্রম। বর্তমান কমিশন সম্পর্কে এখনই মন্তব্য করা যুক্তিযুক্ত নয়। কমিশনের পদক্ষেপগুলো আরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই কমিশনের অধীনে কুমিল্লা নির্বাচন হয়েছে, সেখানে পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়নি। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে. এম. নুরুল হুদার কথাবার্তা শুনে হতাশ হই। গত ১৬ আগস্ট বিভিন্ন মিডিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনার জন্য সমঝোতা, বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা রাজনৈতিক দলের মধ্যস্থতা ইসির কাজ নয়’ (সমকাল, ১৭ আগস্ট ২০১৭)। প্রশ্ন হচ্ছে_ এটি করায় আপত্তি কী? সংবিধানে লেখা নেই_ এমন কিছু কি করা যাবে না? আমার মনে হয়, সূষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এমন ভূমিকা নেওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই বরং গৌরব আছে। তবে এই মুহূর্তে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকেই ঐকমত্য হওয়া জরুরি মনে করি। কিন্তু ইসির কাজ নয়_ এমন মন্তব্যকে সঠিক মনে করি না। তিনি আরও বলেছেন, ‘নির্বাচনের সময় কী ধরনের সরকার থাকবে_ সে ব্যাপারে কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। ইসি একটি টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান। সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেবে, নির্বাচন কমিশনকে সেভাবে নির্বাচন করতে হবে’ (সমকাল, ১৭ আগস্ট ২০১৭)। আমার মনে হয়, হুদা সাহেবের এই দেখবার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই গলদ। ইসি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান নির্দেশিত পথে এটি চলবে, সরকারের নির্ধারণ করা পথে নয়। এর কার্যক্রমের একটি টেকনিক্যাল দিক আছে। ইসিকে টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠানে বিশেষিত করে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশন কোনোক্রমেই টিঅ্যান্ডটি বা আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নয়। ইসিকে নির্বাচন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা উন্নয়নেই কাজ করতে হবে। সেটি করতে হবে রাজনৈতিক দল ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। কেবল ভোট গ্রহণ ও গণনা ইসির কাজ নয়। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। যখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিতর্ক চলছে, তখন এমন বক্তব্য পক্ষপাতমূলক বলেই প্রতীয়মান হতে পারে, যা কাম্য নয়।

ইসির কাজ সংবিধান ও নির্বাচনী আইনেই আছে। সে আলোকেই ইসিকে চলতে হবে। এটি মনে রাখতে হবে_ নির্বাচন চলাকালে সরকার ইসিকে চালাবে না, বরং ইসিই সরকার ও প্রশাসনকে খানিকটা চালাবে। দেশবাসীর চাওয়া অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। আর সেটি করার জন্য যে আইন আছে, তার বাইরে নতুন আইন ও বিধির চিন্তাও ইসির কাছ থেকে আসতে হবে। যে সরকারই থাকুক, নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে ইসির ভূমিকাই মুখ্য। তবে নির্বাচনকালে রাজনৈতিক সরকার থাকলে ইসির দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। তখন মন্ত্রী সরকারি গাড়িতে যাবেন কি-না, সার্কিট হাউস ব্যবহার করতে পারবেন কি-না সব সিদ্ধান্ত কমিশনকে দিতে হবে। সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা কমিশনের কাজ। আর এ ব্যাপারে নতুন বিধির প্রয়োজন হলে সে উদ্যোগও নিতে হবে। নির্বাচনে পেশিশক্তি, টাকার খেলা, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা ও ধর্মের ব্যবহার বন্ধের কথা এখন থেকেই ভাবতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আগের বিধান অনুসরণই শেষ কথা নয়।

আবু সাঈদ খান : লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : ask_bangla71@yahoo.com