অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ৮২-তে পা রাখলেন। ভাবছি, তার কোন পরিচয়টি বড়- শিক্ষক, লেখক, না সমাজ চিন্তক? এ নিয়ে আগেও ভেবেছি। তবে এই তিনের মাঝে বিভাজন করতে পারিনি। এটি করা যায় না। এই ত্রিধারা একরেখায় মিলে একজন আলোকিত মানুষ, তিনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
১৯৫৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৪৪ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়িয়েছেন। অবসরের পর মঞ্জুরি কমিশনের অধ্যাপক ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি ইমেরিটাস অধ্যাপক। শিক্ষকতাকালে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে তার কার্যক্রম কেবল ইংরেজি বিভাগে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি কলা অনুষদের ডিন, সিন্ডিকেট ও সিনেট সদস্য ছিলেন। দু’বার উপাচার্য মনোনয়ন প্যানেলে নির্বাচিত হন। দীর্ঘ সময় ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, উচ্চতর মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতিসহ নানা দায়িত্ব পালন করেছেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি। শ্রেণিকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে তিনি সমান জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয়তা, মননশীলতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে দেশজুড়ে; দেশের বাইরেও। এই বৃহত্তর ক্ষেত্রে তিনি লেখক ও বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তার শিক্ষকতা ও লেখালেখি দুই-ই সমানতালে এগিয়েছে। লিখিত ও সম্পাদিত বই শতাধিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে বেরিয়েছে তার গ্রন্থ- পলিটিকস অ্যান্ড কালচার, এসেস ইন অনার অব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তার লেখা বাঙালির জাতীয়তাবাদ, ছত্রভঙ্গের পূর্বাপর, দুই যাত্রায় এক যাত্রী, বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি; জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি- গ্রন্থগুলো ইতিহাস-আশ্রয়ী বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ, পরিবর্তনকামীদের জন্য পথনির্দেশ।
তিনি প্রধানত প্রাবন্ধিক। স্বাধীনতার আগে ও পরে মিলে দেশের হাতেগোনা শীর্ষ প্রাবন্ধিকদের অন্যতম। তিনি লেখায় সমাজ বিশ্লেষণ করেন, পরিবর্তনের কথা বলেন। পাণ্ডিত্য ও সমাজ ভাবনা দুই-ই তার রচনায় যুগলবন্দি।
প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আশির দশকে। তখন আমি জাসদের একজন সার্বক্ষণিক কর্মী। এর আগে দৈনিক সংবাদে গাছপাথর ছদ্মনামে কলাম ‘সময় বহিয়া যায়’ পড়ার মাধ্যমে তার প্রথম সানি্নধ্য। কলামটি ছিল সমাজ, রাজনীতি ও সাহিত্যে একাকার। মনে পড়ে, বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে তখন দুই দিকপাল। দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- বাংলার আহমদ শরীফ ও ইংরেজির সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। দেশের সংকটে তাদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচিত হতো। এই দুই ব্যক্তিই সমাজ রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেছেন। যে কারণেই বাম দলগুলোর সঙ্গে তাদের সখ্য। উভয়েই অভিন্ন লক্ষ্যের যাত্রী। এই দুই বিদ্বজ্জনের সানি্নধ্য আমার কাছে বড় পাওয়া। আহমদ শরীফ নেই; সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার লক্ষ্যে এখনও অবিচল।
তিনি কোনো রাজনৈতিক দল করেন না। ছাত্রজীবনেও রাজনীতি করেছেন বলে শুনিনি। তবে তার বিশ্বাসের মধ্যে আছে রাজনীতি, যা তার নানা লেখায় ফুটে উঠেছে। তিনি মনে করেন, শ্রেণি-বৈষম্যই সমাজের আসল সমস্যা। এটিকে পাশ কাটিয়ে সামগ্রিক মুক্তি নেই, কল্যাণ নেই। আর সেই মুক্তির সংগ্রাম থেকে তিনি কখনও দূরে ছিলেন না। এখনও সেই সংগ্রামে আছেন, থাকবেন- কলম হাতে। তিনি সর্বদাই সমাজ বদলের আকাঙ্ক্ষায় একজন কলমযোদ্ধা।
আমি যখন পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ-কলাম লিখতে শুরু করলাম, তিনি আমাকে উৎসাহ দিতেন। দেখা হলে জানতে চাইতেন লেখালেখির কথা। আমার প্রথম বই ‘বিকল্প চিন্তা বিকল্প রাজনীতি’র ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘এই বইয়ের প্রবন্ধগুলো বলে দিচ্ছে সাঈদ সমাজতন্ত্রের স্বপ্নটি লালন করেন। তিনি আওয়ামী লীগে যাবেন না, বিএনপিতে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তার লক্ষ্য বিকল্প ধারা। সেই রাজনীতির পক্ষে লিখেছেন তিনি। আগামী দিনে আরো লিখবেন।’
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছি। ১৯৯৬ সালে বাম সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি ও কামাল লোহানীকে সমন্বয়ক করে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটি করা হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপর্যয়ের পর সমাজতান্ত্রিক শিবিরে যখন ভাঙনের সুর, তখন ‘সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ’ গঠন করে বাম রাজনীতির ধারাকে বেগবান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আহমদ শরীফ এটির মুখবন্ধ লিখেছিলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছিলেন ঘোষণাপত্র। আমাকে গঠনতন্ত্রের খসড়া তৈরি করতে বলা হয়েছিল। করেছিলামও। নানা জটিলতায় সংগঠনটি আর এগোয়নি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কেবল একজন নিভৃতচারী লেখকই নন; প্রতিবাদী মানুষও। স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, পশ্চাৎপদতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি কেবল কলম ধরেননি; রাজপথের আন্দোলনেও শামিল হয়েছেন। দৃঢ়তাও দেখিয়েছেন। তার দৃঢ়তা দেখেছি ওসমানী উদ্যানে গাছ রক্ষা ও লালনের আখড়া রক্ষার আন্দোলনে। এ আন্দোলন দুটিতে সাংগঠনিক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পরিণত হন ভিন্ন এক মানুষে। দেখা গেছে, তিনি সবাইকে আন্দোলনে উদ্বুুদ্ধ করছেন। গণসংযোগ করছেন। সাংবাদিকদের কাছে কর্মসূচি ব্যাখা করছেন। সরকারের মতিগতিও বুঝতে চেষ্টা করছেন। পুরোদস্তুর সংগঠক। এই নাগরিক আন্দোলনে কবি শামসুর রাহমান শরিক হয়ে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে সরকারের রাগ-বিরাগ কোনো ব্যাপার ছিল না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আরেকটি পরিচয় অনেকের জানা নেই। তিনি একজন একনিষ্ঠ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সাময়িকী-সাহিত্যপত্রের বাইরেও এক সময় সাপ্তাহিক সচিত্র সময়, সাপ্তাহিক সময় সম্পাদনা করেছেন। তিনি বর্তমানে ‘ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত’ সম্পাদনা করছেন, যেটি এখন ১৫ বছর পেরিয়েছে। এ পত্রিকায় তিনি কী নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন, সংশোধন করেন। যে লেখা ছাপতে পারবেন না, সেটি মনোযোগ দিয়ে পড়ে লেখককে পরামর্শ দেন।
গত ৩০ বছরেরও অধিক সময় ধরে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দেখে আসছি। নানা বিষয়ে আলাপ করেছি, ভিন্নমতও পোষণ করেছি। নিজের মতে দৃঢ়, অন্যের মতের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। যুক্তিবাদী মানুষ। অনেক খ্যাতি, পুরস্কার ও জাতীয় সম্মাননায় ভূষিত হয়েও তিনি নিরহঙ্কার, বিনয়ী। তার চরিত্রের বড় দিক পরিমিতিবোধ। তার আলোচনা, বক্তৃতা, প্রবন্ধে তা লক্ষণীয়। এমনকি আনন্দ-উল্লাস, দুঃখবোধ- সবকিছুই যেন পরিমিতির ছকে বাঁধা।
তিনি কঠিন কথা সহজ করে বলেন। তত্ত্বকথাও প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেন। তার বলা ও লেখার একটি আলাদা স্টাইল আছে। লেখা পড়ে বলে দেওয়া যায়- এটি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা। ভাষারীতি ও বিষয়বস্তু- দুয়েই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অক্লান্ত পরিশ্রমী। নিয়মিত পড়ছেন, লিখছেন, পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, সভা-সেমিনারে যাচ্ছেন। সমাজ রূপান্তরের স্বপ্ন নিয়েই তার পথচলা।
২৩ জুন, ৮২তম জন্মদিনে এই সমাজ চিন্তকের প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
লেখক
আবু সাঈদ খান
সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
সমাজ রূপান্তরের অভিযাত্রী
আবু সাঈদ খান