আমাদের দেশে সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিন মাধ্যম, অনলাইন, ফেসবুক, চায়ের রেস্তোরাঁর আড্ডা, বাস-ট্রেনের কথাবার্তায় রাজনীতিই প্রাধান্য পায়। তবে হাওরের বন্যা, উপকূলে মোরার আঘাত, পাহাড়ধস, শহরের জলাবদ্ধতা, চালসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি সবাইকে কিছুদিনের জন্য রাজনীতি ভুলিয়ে রেখেছিল। এত প্রতিকূল অবস্থায় তা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বিএনপি মহাসচিবের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গেঞ্জি পরা, হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছবি।
পাহাড় ধসে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিএনপি নেতারা রাজধানীতে বসে সমালোচনা করছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের নেতারা, এমনকি সাধারণ মানুষও বিএনপির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করছিলেন, আপনারা দুর্গত এলাকায় যাচ্ছেন না কেন। মির্জা ফখরুলের গাড়িবহরে হামলার আগের রাতে একটি টিভি চ্যানেলে আমি ১৯৭০ সালের ভোলা-হাতিয়ায় জলোচ্ছ্বাসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেছিলাম, মওলানা ভাসানী সবার আগে দুর্গত এলাকায় ছুটে গিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে বিবৃতিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ওরা কেউ আসেনি। এটিই পরদিন পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী সফর স্থগিত করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ছুটে গিয়েছিলেন। সে যাই হোক, ১৮ জুন মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে বিএনপির নেতারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা রাঙামাটি যাচ্ছিলেন। সকাল ১০টায় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় সেই গাড়িবহরে হামলা হয়। একদল লোক হকিস্টিক, লাঠি, রামদা, রড, পাথর ইত্যাদি নিয়ে গাড়িবহরে চড়াও হয়, ভাংচুর করে। এতে মির্জা ফখরুল, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান শামীমসহ কয়েকজন নেতা আহত হন। ঘটনাটি কে বা কারা ঘটিয়েছে তা কারও না বোঝার কথা নয়। রাঙ্গুনিয়ার সংসদ সদস্য হাছান মাহমুদ একটি গল্প ফেঁদেছেন। সেটি হলো_ কোনো পথচারী গাড়ির ধাক্কায় আহত হওয়ায় বিক্ষুব্ধ লোকজন এটি ঘটিয়েছে। এভাবে গল্প বা নাটক ফাঁদানোর ঘটনা নতুন নয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর ‘জজ মিয়া’ নাটক বানানো হয়েছিল। তা কেউ বিশ্বাস করেনি। হাছান মাহমুদও গল্পের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। ঘটনা ফাঁস করার পর হামলাকারীদের সঙ্গে তিনি যে ফটোসেশন করেছিলেন, তা বেরসিক সাংবাদিকরা ফাঁস করে দিয়েছেন।
এই হামলা নিয়ে একটি বিতর্ক উঠেছে যে, হাছান মাহমুদ এটি কি নিজ দায়িত্বে ঘটিয়েছেন, না দলের নির্দেশ পালন করেছেন। এ বিতর্ক অবান্তর। যেভাবেই ঘটুক_ এ দায় আওয়ামী লীগের, সরকারের। এ ঘটনার সঙ্গে পেছনের ঘটনার মিল আছে। ক’দিন আগে দলটির কার্যালয়ে পুলিশের ‘তল্লাশি’ হয়েছে। তল্লাশি না বলে অভিযান বলাই সঙ্গত। এক বছরের অধিক সময় ধরে দলটিকে সভা করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। নানা সময়ে মিছিল বাধা হয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও বিএনপিকে ইফতার মাহফিলও করতে দেওয়া হয়নি। এসব ঘটনা বিবেচনায় আনলে মির্জা ফখরুলের গাড়িবহরে হামলাকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার সুযোগ নেই।
এমন আচরণ কি কেবল বিএনপির বেলায় ঘটছে? সেটিও বলা যাবে না। ক’দিন আগেও সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য অপসারণের মিছিলে পুলিশ বিনা উস্কানিতে জলকামান দেগেছে। মিথ্যা অভিযোগে আন্দোলনকারীদের আটক করেছে। সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের মিছিলে বারংবার হামলা হয়েছে। আনু মুহাম্মদসহ অনেকে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এসব কিছু রাজনৈতিক অসহিষুষ্ণতার পরিচায়ক।
এসব করে সরকার কী হাসিল করতে চাইছে, জানি না। তবে কিছুদিন ধরে সরকারি ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা একটি তত্ত্ব প্রচার করছেন। সেটি হলো_ কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন। উদাহরণ হিসেবে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের কথা বলা হচ্ছে। শত বছরের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ঐতিহ্যের ধারক বাংলাদেশের জন্য এমন মডেল কতটুকু প্রযোজ্য? একটি দেশের রাজনীতি সে দেশের বাস্তবতা ও জনআকাঙ্ক্ষায় নির্ধারিত হবে, বাইরে থেকে আমদানি সম্ভব নয়।
এখন গণতন্ত্রের সংকোচনের ভাবনার আগে দেশে কতটুকু গণতন্ত্র আছে, তা খতিয়ে দেখা যাক। এখানে ভাতের গণতন্ত্র, কাজের গণতন্ত্র, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের বেলায় গণতন্ত্র কায়েম হয়নি। এসব মৌলিক অধিকারের দায় রাষ্ট্র গ্রহণ করে না। এসব ক্ষেত্রে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকে না। এখানে প্রশাসনেও গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। ব্রিটিশের রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্রকেই আমরা সযত্নে লালন করে চলেছি। যদিও ব্রিটিশের দেশে এখন আর আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন নেই। এর খোলনলচে বদলে ফেলেছে। আমাদের কাছে জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রশাসন এখনও স্বপ্ন।
গণতন্ত্র নেই রাজনৈতিক দলগুলোতেও। মূলধারার দলগুলো নেতানির্ভর। সদস্যদের ভোটে নীতিনির্ধারণ ও কমিটি কোনোটাই হয় না। দলের শীর্ষ নেতা কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটি ঘোষণা করেন। তিনি ঠিক করেন, কে কোন পদ পাবেন। এমনকি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের কমিটি ঘোষণা করেন। কাউন্সিল থেকে শীর্ষ নেতার ওপর সব ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। অতীতে নেতারা বসে কমিটি করতেন; তবে সেটি কাউন্সিলে পাস করিয়ে নিতে হতো। এখন শীর্ষ নেতার কাছে ক্ষমতা দিয়ে কাউন্সিলররা বাড়ি চলে যান। তার ৬ মাস বা এক বছর পর কমিটি ঘোষণা করা হয়। এটি একধাপ পশ্চাদপসরণ। বিএনপির দলপ্রধান গঠনতান্ত্রিকভাবেই একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে দলীয় প্রধানের কাছে এমন ক্ষমতা নেই। তবে দুই দলের চর্চা প্রায় একই রকম। আর সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি _ যার নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি তো বলেন, আমিই জাতীয় পার্টি। তবে তার একটা সাবেক পরিচয় আছে, সিএমএলএ। লোকে ব্যঙ্গ করে বলত_ ‘ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট’। কমিটির পদ বণ্টনে এটি প্রযোজ্য। তাই তিনি খুশিমতো কখনও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে, কখনও রুহুল আমীন হাওলাদারকে মহাসচিব করেন। একইভাবে রওশন এরশাদের ওপরে জিএম কাদের, আবার জিএম কাদেরের ওপরে রওশনকে পদোন্নতি দেন।
মূলধারার দলগুলোতে গণতন্ত্র চর্চার বিপরীতে পেশিতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মেধা ও সততার মূল্য নেই। পেশি এখন মানদণ্ড। এ পেশির দাপটে বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছে, আবার জীবন বলিও হচ্ছে। দলে খুনোখুনি হচ্ছে।
প্রশাসন বা দলে গণতন্ত্র রাজনীতিতে কোনো ইস্যু নয়। আমাদের রাজনৈতিক অভিধানে গণতন্ত্র মানে ভোটতন্ত্র (ইলেকটোক্রেসি)। এই ভোটের অধিকারের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ভোটের অধিকারের দাবিও মিলেছিল। এই ভোটতন্ত্রের সঙ্গে জনগণের এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দেশের মানুষের চাওয়া_ তারা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে, সংসদ বসবে, সরকার গড়বে, সংসদে তর্ক-বিতর্ক হবে। ‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নির্বাচনে জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণও হয়েছিল। বিশ্ববাসী বিস্ময়ভরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন দেখেছিল। আমরা অনেক প্রশংসাও পেয়েছিলাম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলোপের পর ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই একতরফা প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনের জন্য বিএনপি সরকারের অগণতান্ত্রিক নীতিকেই দায়ী করছে। আওয়ামী লীগ বিএনপির নির্বাচনে না আসাকে দায়ী করছে। তবে এমন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন সরকারও আর চাইছে না। আর বিএনপিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। সহায়ক সরকারের কথা বলছে। যদিও এখনও সেটি স্পষ্ট করেনি। বর্তমান সাংবিধানিক পদ্ধতির মধ্যেই সমঝোতার সুযোগ রয়েছে। গত নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিতে বলেছেন। এবার এমন কোনো প্রস্তাব দেবেন কি-না জানি না। তবে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। এমন প্রেক্ষাপটে মনে হয়েছিল_ নির্বাচন প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী পক্ষ রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হবে।
বিএনপির কার্যক্রমে একের পর এক বাধা সব হিসাব তছনছ করে দিচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তবে কি বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? আর সেটি হলে দেশ হবে উল্টো পথের যাত্রী। দেশের সামগ্রিক কল্যাণেই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জরুরি। আর সেটি অনুষ্ঠানে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সরকারের দায়িত্ব বেশি। সরকারকেই একটি গণতান্ত্রিক আবহ বজায় রাখতে হবে। গণতন্ত্রের রাস্তা খোলা রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের রাস্তা বন্ধ হলে রাজনীতি সন্ত্রাসের পথে ধাবিত হবে, পেশির দাপট বাড়বে।
লেখক
আবু সাঈদ খান
সাংবাদিক
রুগ্ণ গণতন্ত্র বলিষ্ঠ পেশিতন্ত্র
আবু সাঈদ খান : বিএনপির কার্যক্রমে একের পর এক বাধা সব হিসাব তছনছ করে দিচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তবে কি বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? আর সেটি হলে দেশ হবে উল্টো পথের যাত্রী। দেশের সামগ্রিক কল্যাণেই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জরুরি। আর সেটি অনুষ্ঠানে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সরকারের দায়িত্ব বেশি। সরকারকেই একটি গণতান্ত্রিক আবহ বজায় রাখতে হবে। গণতন্ত্রের রাস্তা খোলা রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের রাস্তা বন্ধ হলে রাজনীতি সন্ত্রাসের পথে ধাবিত হবে, পেশির দাপট বাড়বে