মফস্বল শহরের একটি চায়ের রেস্তরাঁর নামে নাটকটির নামকরণ। নাট্যকার সুনিপুণ হাতে ঘটনা বিন্যাস করেছেন। নাটক দেখতে দেখতে মনে হয়েছে- শহরটির আনন্দ-উল্লাস, বেদনা-বিরহ সবকিছুই রেস্তরাঁকে স্পর্শ করেছে। তাই ‘দি জুবলী হোটেল’ নামক রেস্তরাঁর মধ্যে ধরা দিয়েছে পুরো শহরটা; কখনও পুরো সমাজ। টুকরো টুকরো ঘটনা গ্রন্থিত হয়ে রচিত হয়েছে নাটকটির শরীর। এর ছত্রে ছত্রে রয়েছে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, পুরুষতান্ত্রিকতা, বাণিজ্যায়নের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভ। নিরাশার মাঝেও ঝলকে ওঠে আশার আলো।
নাটকটির শুরুতে জুবলী হোটেলের ভোর। সূর্য ওঠার আগেই ঝাড়ূ হাতে মনোলোভা। রেস্তরাঁয় ঘুমিয়ে থাকা কিশোর কর্মী পটলের গাত্রোত্থান। হোটেল মালিক সুরেশ কুণ্ডুু, হোটেল কর্মী মমতা, নাট্যকার হারু মণ্ডল, সমাজসেবী বুলেটসহ নানাজনের আগমন। মালাই চা, আড্ডা, হট্টগোল। এটি নিত্যদিনের ঘটনা। এক সময়ে আড্ডায় যুক্ত হয় এক বাউল ও ম্যাজিক পার্টির নৃত্যশিল্পী হেমা মালিনী।
দি জুবলী হোটেল নাটকের কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে হারু মণ্ডল। মফস্বল শহরের নাট্যকার। সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে ২০ বছর ধরে ‘সুলতানা রাজিয়া’ নাটক মঞ্চায়নের চেষ্টা করছেন। কিন্তু সুলতানা রাজিয়া চরিত্রের জন্য কোনো অভিনেত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। তার দুঃখ- সব মেয়ে টিভি নাটকে ছুটছে। কিন্তু মঞ্চনাটকে সুলতানা রাজিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করতে কেউ এগিয়ে আসছে না। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। জুবলী হোটেলে নাট্যদলের নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। একদিন ম্যাজিক পার্টির নৃত্যশিল্পী হেমা মালিনীকে দেখে আশাবাদী হয়ে ওঠেন হারু মণ্ডল। হেমা মালিনীকে তার নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। বলেন, ‘সুলতানা রাজিয়া ছিলেন দিলি্লর প্রথম সম্র্রাজ্ঞী। আমরা মনে করি, সমাজে নারীর অধিকার, ক্ষমতা ও মর্যাদা দিলে সমাজ থেকে অন্যায়, ব্যভিচার দূর হবে। সে জন্য চাই একজন নারী, একজন অভিনেত্রী।’
বাধ্য হয়েই ম্যাজিক পার্টিতে এসেছেন শিল্পী হেমা মালিনী। তাকে অর্থের বিনিময়ে ম্যাজিক পার্টিতে অশ্লীল নৃত্য করতে হয়। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনে এ ছাড়া তার উপায় ছিল না। হারু মণ্ডলের সানি্নধ্যে হেমা মালিনীর মধ্যে শিল্পীসত্তা জাগ্রত হয়। সুলতানা রাজিয়ার চরিত্রে অভিনয়ে সম্মত হন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় ম্যাজিক পার্টির মালিকের লম্বা হাত- তিন বছরের চুক্তিপত্র। তাই পালিয়ে আসা হেমা মালিনীকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হলো। তার পাশে কেউ দাঁড়ায় না; এমনকি হারু মণ্ডলও না।
মনোলোভা এক পরিচ্ছন্নতা কর্মী। পরিচ্ছন্নতা কর্মী এ সময়ের পোশাকি নাম। শহরবাসী তাদের মেথর, ধাঙড়, ঝাড়ূদার, সুইপার নামেই ডেকে আসছে। ওসব নামের আড়ালে আছে অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য। তবে নাটকের শুরুতে এই সম্প্রদায়ের কিশোরী কন্যা মনোলোভাকে অবজ্ঞা করতে দেখা যায় না। বরং সমাজসেবী বুলেটের ছিল বিশেষ মনোযোগ। তার পেছনে যে অসৎ উদ্দেশ্য ছিল, সেটি নাটকের শেষাংশে বোঝা যায়। সবাই মনোলোভাকে ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে। তারপরও হাসি-খুশি মেয়েটির মধ্যে অজানা কষ্ট ছিল। আসলে সে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালিত পুঞ্জীভূত কষ্ট বহন করছিল। সেটির প্রকাশ ঘটল, বুলেট যখন তাকে রেস্তরাঁর কাপে চা খেতে পীড়াপীড়ি করছিল। তখন মনোলোভা বলেছিল- না না, না বাবু, কাপে চা খেলে ভদ্রলোকের মান যাবে। আমরা ছোট জাত …। উল্লেখ্য, মফস্বল শহরে বটেই, এমনকি ঢাকারও কেনো কোনো এলাকায় রেস্তরাঁর কাপে চা পান ও চেয়ারে বসার অধিকার নেই তাদের। কোমরে গুঁজে রাখা মগে দাঁড়িয়ে বা মেঝেতে বসে চা খেতে হয়। ‘মেথর’ নর-নারীদের হাত থেকে ‘ভদ্দরলোক’দের জাত সুরক্ষার জন্যই এ বিধান প্রচলিত।
জুবলী হোটেলের কর্মী মমতা, যে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে নীরবে কাজ করে। প্রথম বিয়ের তিন মাসের মাথায় স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে বিরিয়ানি বিক্রেতা নাসির মোল্লার সঙ্গে; তবে দরগায়, গোপনে। নাসিরের শর্ত- পাঁচ বছর পর স্ত্রীকে স্বীকৃতি দেবে। দুই সন্তানের মা মমতা। সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে অপবাদ শুনতে হয় তাকে। তার পরও মমতা স্বপ্ন দেখে। অপেক্ষায় থাকে; একদিন গোপন বিয়ের বর প্রতিশ্রুতি পালন করবে। তার ঘর হবে, সন্তানের পিতৃপরিচয় মিলবে। অপেক্ষার পালা শেষ হয়। পাঁচ বছর পূর্ণ হলে মমতা বধূবেশে বিরিয়ানির দোকানে হাজির। তখন নাসির তার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এক পর্যায়ে মারতে উদ্যত হয়। তখন মমতাও রুখে দাঁড়ায়। বলে, ‘তুই কি মনে করিস, স্বামী মারলে অঙ্গ পবিত্র হয়- এ কথা মমতা মেনে নেবে?’ এর পর মমতা ক্ষোভে অপমানে চলে যায়। কিন্তু দর্শকদের মনে গেঁথে থাকে পুরুষতান্ত্রিকতার শিকল ছেঁড়া এক নারীমূর্তি।
এক সময় রেস্তরাঁটি হয়ে উঠল ধর্মান্ধদের নিশানা। তারা এ হোটেলে না আসার জন্য বাউল, হেমা মালিনীসহ অনেককে শাসাতে লাগল। এক পর্যায়ে মালিক সুরেশকে হুমকি দেওয়া হলো। বলা হলো, দেশটি তাদের নয়। এ ঘটনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সুরেশ ও রেস্তরাঁ কর্মী পটল হতাশ হয়ে পড়ে। সুরেশকে তখন বলতে শোনা যায়, ‘আমরা এই দেশটায় সুখেই ছিলাম। নানান বরণ, নানান সুবাস, নানান মানুষ। সেই দেশটারে আমরা তোমরা ভাগ করে দিলে।’
নাটকের শেষাংশে সমাজসেবী বলে পরিচিত বুলেট দান-খয়রাতে উদার হস্ত। বাবুই পাখির কষ্টও তাকে ব্যথিত করে। সেই ব্যক্তির দ্বারাই ধর্ষিত হয় মনোলোভা। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে শহর। হারু মণ্ডল, সুরেশ, মমতা, পটল সবাই একাট্টা। বাউলকে গুম করা হয়। কিন্তু বাউলের রেখে যাওয়া গেরুয়া পরে পটল বেরিয়ে পড়ে। গাইতে থাকে বাউলের সেই গান :আমি মরছি খুঁজে/ সেই দোকানের সহজ ঠিকানা/ যেথা আল্লা হরি গড ভগবান/ এক থালাতে খায় খানা।
একই সঙ্গে ধ্বনিত হয় নাট্যকারের স্বপ্ন সংলাপ, ‘কবর থেকে আমার পিতার ডাক শুনতে পাচ্ছি- সিপাহসালার। আমি সুলতানা রাজিয়া, মসনদ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করছি পিতা। আমি নারী বলে যারা আমার ভারতবর্ষ শাসনে বাধা সৃষ্টি করবে, আমার তরবারির আঘাতে তারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে।’ নাটক দেখে ফিরতে ফিরতে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের মনে হবে- সুলতানা রাজিয়ার তরবারির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে বৈষম্যের দেয়াল। গীত হচ্ছে মানবতার জয়গান।
মনোলোভার চরিত্রে নিকিতা নন্দিনীর অনবদ্য অভিনয়, হেমা মালিনীর চরিত্রে তমালিকা কর্মকারের অভিনয় নৈপুণ্য, মমতার (রুবলী চৌধুরী) অভিনয়শৈলী. হারু মণ্ডলের (মান্নান হীরা) আশা-নিরাশায় দোলায়মান মুখ, সুরেশ কুণ্ডুর (কামরুল হাসান) অসহায়ত্ববোধ, পটলের (কৌশিক সাহা) প্রাণচাঞ্চল্য, তৃতীয় লিঙ্গের তিন শিল্পীর অভিনয়দক্ষতা মুগ্ধ করেছে। যাদের কথা বলা হলো না, তাদের অভিনয়কে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
দি জুবলী হোটেল সময়ের কথা বলছে। যারা মানুষে মানুষে বিভাজন ঘোচাতে চাইছে, ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা-পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়ছে; সব মানুষের বাসযোগ্য সমাজের স্বপ্ন দেখছে; নাটকটি তাদের জন্যও প্রেরণার।
লেখক
আবু সাঈদ খান (সাংবাদিক)
দি জুবলী হোটেল :সময়ের মানচিত্র
আবু সাঈদ খান : নাটক কেবল বিনোদন নয়; সমাজ বদলের হাতিয়ার। আরণ্যক প্রযোজিত মান্নান হীরার নাটক ‘দি জুবলী হোটেল’ সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মান্নান হীরার নাটক খেলা খেলা, আগুনমুখা, ময়ূর সিংহাসন, ভাগের মানুষ, বিচারপতি ঘুমিয়ে গেছেন, এবং বিদ্যাসাগর, লালজমিন সাড়া জাগিয়েছে। ‘দি জুবলী হোটেল’ সেই ধারাবাহিকতায় নতুন সংযোজন।