কলকাতার সাংবাদিক অমিত বসু ৩ জুলাই ভোরে চলে গেলেন। তিনি ছিলেন ভারতের নাগরিক। তার হৃদয়ে ছিল আরেকটি দেশ- বাংলাদেশ। তিনি দু’দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দিতেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে নৈকট্যের কথা বলতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মনে করতেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাজধানী হবে ঢাকা। অতিমাত্রায় বাংলাদেশপ্রীতির জন্য তাকে উপহাস শুনতে হতো। পাত্তা দিতেন না। তিনি তার বিশ্বাসে ছিলেন অটুট।
অমিত দীর্ঘদিন দৈনিক জনকণ্ঠের কলকাতা প্রতিনিধি ছিলেন। লিখতেন সমকাল ও কালের কণ্ঠে। তারা বাংলা নিউজের বাংলাদেশ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কলকাতার ‘এইমুহূর্তের ডডকম’-এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন। তিনি দৈনিক আনন্দবাজার অনলাইনে নিয়মিত বাংলাদেশ বিষয়ক বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখতেন।
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের ইতিবাচক খবরে উদ্বেলিত হতেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে তার আশাবাদ ছিল। যখন বাংলাদেশ খারাপ খেলছিল, বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে আমরা তখন হতাশ। অমিত বসু বলতেন, হতাশ হবেন না। ওরা বিশ্ব জয় করবে। তার আশাবাদের কথা লিখেছেনও। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের প্রশংসা করে একাধিক নিবন্ধ লিখেছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ভালোবাসা লেখার মধ্যেই ফুটে উঠত। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে লেখার শিরোনাম ছিল- ‘বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ’। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প নিয়ে তার লেখার শিরোনাম -“প্রত্যাখ্যানের ‘বদলা’! এখন দুনিয়া দাপাচ্ছে বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প।” এই লেখা শুরু করেছেন স্বাধীনতা-উত্তর ঔষধ সংকট নিয়ে। তখন বাংলাদেশকে ওষুধ দিয়ে সাহায্যের প্রস্তাব অনেক দেশই প্রত্যাখ্যান করেছে। আর আজ বাংলাদেশ বিশ্বের ঔষধ রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘ধীরে ধীরে ঔষধ উৎপাদন বাংলাদেশে। বিদেশি সংস্থার মাথায় হাত। বাংলাদেশের বাজার হারালে যে বিরাট ক্ষতি …কুঁড়ি থেকে ফুল হওয়ার মতো পাপড়ি মেলল বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প।’ এ লেখা থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের প্রতি তার মমত্ববোধ।
অমিত বসু মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক মানুষ। বিশ্বাসী ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতায়। ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনার বিরোধী ছিলেন। যখন উপমহাদেশজুড়ে সমাজ ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, ধর্ম বিভেদের দেয়াল তুলেছে; তখন তার এভাবে চলে যাওয়া মানা যায় না। বছর দেড়েক আগেও ঢাকা এসে একাধিক টিভি চ্যানেলে ঐক্যবদ্ধভাবে এসব অপশক্তি মোকাবেলা করার কথা বলেছিলেন।
শুধু সাংবাদিকতায় নয়, ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান। তার উপন্যাস মরমিয়া, বিহান, উজান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তার সর্বশেষ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকার দৈনিক মানবজমিনের ২০১৬-এর ঈদসংখ্যায়। বইটি প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। তিনি দেখে যেতে পারলেন না।
২০০৮ সালে কবি নাসির আহমেদের মাধ্যমে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি তখন থেকে সমকালে লিখতে শুরু করেন। প্রায়ই ঢাকা আসতেন। আড্ডার মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব। ঢাকাতেই আমার বই ‘বোবা পাহাড়ের কান্না ও অন্যান্য গল্প’ তাকে দিলাম। রাতে হোটেলে ফিরে বইটি পড়েন। সকালে ফোন করে প্রতিক্রিয়া জানালেন। কলকাতার পাঁচ বিশিষ্টজনের জন্য পাঁচটি বই নিয়ে গেলেন। একদিন ফোনে জানালেন দুই-একজনের মন্তব্য এবং দৈনিক আজকালে বইটির ওপর প্রকাশিত রিভিউয়ের খবর।
গত ২০১৪ সালে কলকাতা গিয়ে তার সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। একসঙ্গে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। তিনি শান্তিনিকেতনের অনেক অজানা গল্প শুনিয়েছিলেন। এমনকি কোন গাছের নিচে, কোন কুঠিতে রবীন্দ্রনাথ কখন বসতেন, কী মন্তব্য করতেন! বললাম, আপনিও তো ওখানে ছিলেন। তখন আর তার হাসি থামে না। প্রাণ খুলে হাসতেন। তাকে আমার মনে হয়েছিল শান্তিনিকেতন বিশেষজ্ঞ। সে সময়ে আর্থিক কষ্টে ছিলেন। তা সত্ত্বেও আমাকে একটি ফতুয়া ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সোহরাব হাসানকে একটি লুঙ্গি গিফ্ট করেছিলেন।
আমার সঙ্গে তার প্রায়ই ফোনে কথা হতো। ফোন করলেই আমাকে উপন্যাসে হাত দিতে বলতেন। নতুন বছরসহ নানা দিবসে ছড়া আকারে মেসেজ পাঠাতেন। আমি জবাব দিতাম নিরেট গদ্যে। তবে নববর্ষের মেসেজের জবাব আমিও ছড়াতে দিলাম। গত পহেলা বৈশাখ তার এসএমএসের ভাষা ছিল- নববর্ষের আনন্দ গান/ এক সুর এক তান/ বারো মাস কাটুক সুখে/ হাসি ফুটুক তিরিশ কোটি বাঙালির মুখে। আমি লিখলাম; এখানে ওখানে একই গান/ ঐতিহ্য সদা অম্লান/ মাটি নদী অভিন্ন/ তবু বাঁধ- কাঁটাতারের চিহ্ন! আসলে এটিও ছিল অমিত বসুর দুঃখবোধ।
একবার ঢাকায় এসে ফোন দিলেন। অফিসে এসে দেখি, আমার কক্ষে মন খারাপ করে বসে আছেন। বললেন, বনানী গোরস্তানে গিয়েছিলেন। সব কথা শুনে আমি অমিত বসুকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম।
সাংবাদিক তোয়াব খানের প্রতি ছিল তার অপরিসীম শ্রদ্ধা। তার স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গেও ছিল হৃদ্যতা। তোয়াব খানের এক মেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলেন। সেখানে অমিত বসুর কাছে তোয়াব-কন্যা বলেছিলেন, আমার দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। একদিন সবাই ভুলে যাবে। অমিত বসু বারবার চোখ মুছছিলেন, কিছুই বলতে পারছিলেন না। তবে মনে মনে বলেছিলেন, না, না, ভুলব না। তার মৃত্যুর খবর শুনে ঢাকা এসে বনানী গোরস্তানের কবরে মোমবাতি জ্বেলে দিয়েছিলেন। অনেক দিন সেখানে অমিতের যাওয়া হয়নি। তাই সেদিন আবার বনানী কবরে গিয়ে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে এসেছেন। নির্মম পরিহাস! অমিত বসুও সেই মরণব্যাধি ক্যান্সারে মারা গেলেন।
অমিত ছিলেন কোমল হৃদয়ের মানুষ, স্নেহশীল বাবা। তিনি যখন ঢাকা আসতেন, সঙ্গে থাকত তার ছেলেটা। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছেলেটিই ছিল তার সব। তিনি ছিলেন ছেলেটির বাবা ও মা। ছেলেটির কোনো আবদার ফেলতে পারতেন না। মৃত্যুতে অন্তর্মুখী ছেলেটি আবার মা ও বাবা দুই-ই হারাল। ছেলেটি বড্ড একা হয়ে গেল।
ঢাকায় তার অনেক বন্ধু ছিল। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল। একবার তিনি ঢাকার বিশিষ্ট লোকদের একটা মূল্যায়ন আমাকে শোনালেন। আমি বিস্মিত। আমার মূল্যায়নের সঙ্গে ফারাক নেই। ঢাকার পথঘাট, মানুষ সবই ছিল তার চেনা। তিনি কলকাতাবাসী হয়েও ঢাকার লোক। ঢাকা ছিল তার সেকেন্ড হোম। তার মৃত্যুতে কেবল স্বজন, কলকাতার সাংবাদিক-সাহিত্যিকরা নন, আমরাও শোকবিহ্বল।
মাসখানেক আগে ফোন করেছিলেন অমিত বসু। বলেছিলেন, একবার কলকাতায় আসুন। এর আগে কলকাতায় এলেন, তখন আপনার তেমন যত্ন নিতে পারিনি। এবার আপনাকে কয়েকটি স্থানে নিয়ে যাব। যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি। কলকাতায় গেলে অমিতদার কথা মনে পড়বে, কিন্তু দেখা হবে না। এটি কি মানা যায়!
লেখক
আবু সাঈদ খান
সাংবাদিক
তার হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশ
আবু সাঈদ খান