গত ২৩ জুন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অন্য এক ঢাকার কথা বলছিলেন। সেটি তার কৈশোরের ঢাকা। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাবার কর্মস্থল কলকাতা ছেড়ে তারা ঢাকায় চলে এলেন। তখন খরস্রোতা ধোলাই খাল নৌকায় পার হতে হতো। গাছপালায় শোভিত ঢাকার মায়াবী রূপ তাকে মুগ্ধ করত। এমন বর্ণনা আরও অনেক বিশিষ্টজনের লেখায় ও স্মৃতিচারণে পাই। অশীতিপর শিক্ষাবিদ ও লেখকের আক্ষেপ, সে ঢাকা বদলে গেছে! বদলে গেছে আমার দেখা ষাটের শেষার্ধের ঢাকাও।
একদা এ নগরের চারদিকে ছিল প্রবহমান নদী। খাল-ঝিল-জলাশয়ে শোভিত। ব্রিটিশ শাসনামলেও ৫২টি খাল ছিল। এখন কাগজে-কলমে ২৬টি। বাস্তবে তার অর্ধেকও নেই। সেগুলোরও মরণদশা, জীর্ণশীর্ণ। খেলার মাঠ, পার্ক, খোলা জায়গা দখল করে বহুতল ভবন, বিপণিবিতান, অপরিকল্পিত দালানকোঠায় ঢাকা ইটের জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু দখলদারদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত। পৃথিবীতে বাসের অযোগ্য শহরের দৃষ্টান্ত এখনকার ঢাকা। বৃষ্টি হলেই সড়কগুলোতে জল উপচে ওঠে। মনে হয়, এগুলো বুঝি সেই হারিয়ে যাওয়া খাল! জলাবদ্ধতা, যানজট, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণে জনজীবন অতিষ্ঠ। অধ্যাপক চৌধুরী প্রশ্ন করেন, উন্নয়নের নামে প্রকৃতিবিধ্বংসী কাজগুলো কি প্রয়োজনীয় ছিল?
এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, অবিকল সেই ঢাকাকে রেখে উন্নয়ন সম্ভব হতো না। তবে উন্নয়নের নামে সবুজ উজাড় করা, খালগুলোকে ভরাট করা যৌক্তিক ছিল না। অথচ এখানে খাল-ঝিল, সবুজের আচ্ছাদন বুকে নিয়েই গড়ে উঠতে পারত পরিকল্পিত সুশোভিত এক নগর। তা গড়ে না ওঠার পেছনে দূরদৃষ্টির অভাব, পরিকল্পনাহীনতা যে কাজ করেছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। নগরের যেখানে যার যেমন খুশি বাড়িঘর, দোকানপাট, কলকারখানা করার ‘স্বাধীনতা’ দেওয়া হয়েছে। বাধা দেওয়া হয়নি খাল-ঝিল-জলাশয় দখলবাজদেরও। এমন ‘স্বাধীনতা’ ভোগ করেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাজশাহী, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, খুলনাসহ সব শহরও একইভাবে সমস্যা সংকুল। অদূরদৃষ্টি ও পরিকল্পনাহীনতায় চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে গ্রাম-শহর, সমতল, হাওর, পাহাড়ের পরিবেশ ও জনজীবন।
আমাদের প্রকৃতি থেকে পাওয়া সম্পদ হলো_ জমি, নদী, বন, পাহাড় ও সমুদ্র। এসবের সদ্ব্যবহারের মাঝেই বাংলাদেশের উন্নতি। আমরা কি পরিকল্পিতভাবে এসব সম্পদের ব্যবহার করেছি? অধিক খাদ্য ফলাও অভিযানের নামে জমিতে যে হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়েছে; যা এখন জমি ও মানুষ উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। এতে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এই বিষ খালে-বিলে-নদীতে গিয়ে মাছসহ জলজ প্রাণীর জীবন সংহার করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেও একই পরিমাণ ফসল পাওয়া যায়। তাছাড়া জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত ধান, গম, সবজি, ফলমূল হবে নিরাপদ। কিন্তু এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সামান্যই।
কৃষি জমির জন্য আরেক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এর যথেচ্ছ ব্যবহার। অপরিকল্পিত আবাসন, নগরায়ন, শিল্পায়নের ফলে জমির পরিমাণ কমছে। আবাসন, নগরায়ন ও শিল্পায়ন প্রয়োজন; তবে তা পরিকল্পিতভাবে হতে হবে, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এমনও দেখা যায়, যে শিল্পের জন্য এক একর দরকার, সেখানে ১০ একর কিনে বাউন্ডারি করা হচ্ছে। এভাবে অতিরিক্ত জমি ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারি প্রকল্পেও। এখানে কৃষি জমি অন্য কাজে ব্যবহারে কোনো বাধা নেই। সরকারের উদ্যোগে রফতানি প্রক্রিয়াজাত এলাকা (ইপিজেড)সহ শিল্পের জন্য কিছু নির্দিষ্ট এলাকা আছে। তবে ৯০ শতাংশ কলকারখানা এর বাইরে। নগরায়ন ও শিল্পায়নে বনভূমিও গ্রাস করা হচ্ছে। এটি রোধে জরুরি হয়ে পড়েছে ভূমি ব্যবহার নীতির। কৃষি, বনভূমি, শহর ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। এমনকি গ্রামে গ্রামে কৃষি ও আবাসিক এলাকা নির্ধারণ করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কৃষি জমি থাকবে কৃষকের, অন্য কারও নয়। জমির যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করা না হলে তা পরিবেশ ও কৃষির জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
পার্বত্য এলাকায় যা ঘটেছে তা ভয়াবহ। দেদারসে পাহাড় কাটা হয়েছে। গাছ কেটে পাহাড়গুলোকে ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে। পাহাড় খুঁড়ে পাথর ও বালু অপসারণ করা হয়েছে। এখনও এসব হচ্ছে। দুর্বৃত্তদের এসব অপতৎপরতায় অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনও সহযোগী। আর রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে এসব ধ্বংসযজ্ঞ তো চলছে। এর বাইরে যেটি ঘটেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। চার লাখ মানুষের বসতি এই তিন জেলায় সমতলের চরাঞ্চলসহ নানা স্থান থেকে চার লাখ ছিন্নমূল নর-নারীর বসতি স্থাপন করা হয়েছে। তারা পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানেও বাড়িঘর করেছে। পাহাড়ে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল, বাগানসহ নানা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রেও তেমন চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। তাই পাহাড় ধসের ক্ষেত্রে যোগ হয়েছে এসব মানবসৃষ্ট কারণ। এত চাপ পাহাড়গুলো সইতে পারছে না।
নদী, খাল, বিল, ঝিলের ক্ষেত্রে দখলবাজদের দৌরাত্ম্য শেষ কথা নয়। অপরিকল্পিত উন্নয়নও নদী ও জলাশয় ধ্বংসের জন্য দায়ী। অধিক খাদ্য ফলাও নীতি কার্যকর করতে বিল-ঝিলে ফসলের ক্ষেত করা হয়েছে। এমন ঘটনার আমিও সাক্ষী। আমার গ্রামের চারপাশেই বিল ছিল_ শীতবিলা, গজারিয়া ও মাটিয়াদহ। কলমিলতা ও কচুরিপানায় আচ্ছাদিত বিলগুলো সারা বছরই জলমগ্ন থাকত। আজও চোখে ভাসে পানিতে মাছের লুকোচুরি আর ওপরে পাখির ওড়াউড়ির দৃশ্য। ষাটের দশকে শ্যালো মেশিনে পানি সেচে বিলের চারপাশের জমি কৃষি জমিতে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন পুরো বিলই কৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। কোথাও পানি নেই। গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তুলে সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়। এতে প্রতিবছরই পানির স্তর নামছে। নামতে নামতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে কারও দুর্ভাবনা নেই।
বাঁধ, সড়ক, ব্রিজ সবকিছু নদীকে বিদীর্ণ করছে। সড়ক আমাদের দরকার আছে। কিন্তু এত সড়ক কি দরকার? দেশের ভূপ্রাকৃতিক কারণে নৌপথই ছিল চলাচল ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যম। সুলভে ও নিরাপদে চলাচল ও পণ্য পরিবহনে রেলপথ হতে পারত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নৌপথ ও রেলপথের দিকে গুরুত্ব দেইনি। ক্রমেই রাশ টেনে ধরেছি। দাতাদের পরামর্শে বা পরিবহন ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সড়কপথকে প্রধানতম যাতায়াতের মাধ্যম করেছি। অপ্রয়োজনীয় রাস্তা, কালভার্ট, সেতু করা হয়েছে; যা জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ বিপর্যয়েরও কারণ।
এ প্রসঙ্গে আমার জানা একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। আশির দশকের কথা। ফরিদপুরের কানাইপুর-বিভাগদী সড়কের জয়কালীতে একটি খালের ওপর বাঁশের সাঁকো ছিল। সেখানে একটা কালভার্ট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আমাকে পেয়ে এলাকাবাসী বলল, এখানে কালভার্ট হলে নৌকা চলাচল করতে পারবে না। আমরা বলেছি, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরা আমাদের কথা শুনতে চায় না। তাদের অনুরোধে আমি এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীকে বললাম। তিনি বললেন, বাজেট হয়ে গেছে। এটি দাতা সংস্থার অনুমোদিত ডিজাইন। চেঞ্জ করা যাবে না। ওপরওয়ালাদের অনুমোদিত ডিজাইনে কালভার্ট হলো। বর্ষার পর আবার বাড়ি যাচ্ছি। দেখি, কালভার্টের দুই পাশ ভেঙে গেছে। সেখানে দুই পাশে দুই সাঁকো। সাঁকোর উন্নয়ন; একটি থেকে দুটি।
এমন উন্নয়নকে কী বলা যায়? প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একবার বলেছিলেন_ দেশে এখন দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ক্ষমতাবাজি ইত্যাদি চলছে; দেশ বাজিকরদের হাতে জিম্মি। তিনি অবশ্য উন্নয়নবাজির কথা বলেননি। উন্নয়নবাজিতেও দেশ আক্রান্ত। উন্নয়নের থাবা এখন সুন্দরবনের দিকে। যদি সত্যি সত্যি রামপাল বিদ্যুৎকেদ্র হয়, তবে ওটি অনেক আলো দেবে। সে আলোয় আমরা সুন্দরবন দেখতে পাব কি-না সেটিই আজ বড় প্রশ্ন।
আমরা প্রকৃত উন্নয়ন চাই, উন্নয়নবাজি চাই না। চাই প্রকৃতি ও মানববান্ধব উন্নয়ন।
লেখক
আবু সাঈদ খান
সাংবাদিক
Emaill: ask_bangla71@yahoo.com
চাই প্রকৃতি ও মানববান্ধব উন্নয়ন
আবু সাঈদ খান