আবু সাঈদ খান : নির্বাচনে যারা হেরে যান, তারা আর আলোচনায় থাকেন না। তবে ব্যতিক্রম যুক্তরাজ্যের জেরেমি করবিন। তার দল লেবার পার্টি নির্বাচনে হারলেও তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই।

পরাজয়ের মাঝেও লেবার পার্টির স্বস্তি_ ২০১৫ সালের নির্বাচনের চেয়ে এবার দলটি ৩২টি আসন বেশি পেয়েছে। এই বিজয়ের পেছনে করবিন। যিনি লেবার পার্টিকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করেছেন। তরুণদের দলে টেনেছেন। তরুণদের ভোটেই এই অগ্রগতি। বলা বাহুল্য, নির্বাচন-উত্তর জটিলতায় করবিনের কাছে সরকার গঠনের সুযোগ ধরাও দিতে পারে। সেটি ভিন্ন বিষয়।

করবিন একজন কট্টর বামপন্থি রাজনীতিবিদ বলে পরিচিত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তিনি মোটরসাইকেলেই কর্মস্থল, নির্বাচনী এলাকায় ছোটাছুটি করেন। তার সম্পর্কে প্রাক্তন প্রথম স্ত্রীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘করবিন অত্যন্ত সৎ মানুষ। তার সততার কারণেই আমি তার সঙ্গে পরিণয়াবদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু পাঁচ বছরে আমাকে নিয়ে একবারও রেস্তরাঁয় যাওয়ার সময় হলো না।’ সেটি স্বামী হিসেবে তার দায়িত্বহীনতা, না রাজনীতিকের জীবনের বাস্তবতা_ সে সিদ্ধান্তে পেঁৗছানো কঠিন।

করবিনের যে বক্তব্য সাড়া জাগিয়েছে, তরুণদের কাছে টেনেছে তা হলো :শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাতিল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রের অধিকতর দায়িত্ব গ্রহণ, রেলওয়ে ও ডাকঘর জাতীয়করণ, আবাসনের নিশ্চয়তা, সামাজিক নিরাপত্তা জাল সুদৃঢ় করা ইত্যাদি। সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় খাত পুনর্গঠনের দাবিও তুলেছেন। একাধিক জঙ্গি হামলার জন্য মুসলিম বিদ্বেষ ফেনিয়ে উঠছে_ এমন প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, এটি যুক্তরাজ্যের ভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতির ফসল। তিনি শুরু থেকেই ইরাক আক্রমণসহ ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির সমালোচনা করে আসছেন। ন্যাটোর কার্যক্রমের কট্টর সমালোচক তিনি। সে যাই হোক, করবিন রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব পালনের বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি নতুন নয়। এক সময় যুক্তরাজ্য রাষ্ট্রীয় নীতি অনুযায়ীই এসব দায়িত্ব পালন করছিল। সেখানে জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ ছিল। সব মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিল। যুক্তরাজ্য এ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে কল্যাণকর রাষ্ট্রে সংজ্ঞায়িত হয়। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক স্টেটও বলা হতো।
আশির দশকে জেমস কালাহান যখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তখন নয়া উদারতাবাদের (নিয়ো-লিবারালিজম) তত্ত্ব আবির্ভূত হয়। সেটির মর্মবাণী_ রাষ্ট্রের ভূমিকা সংকোচন এবং ব্যক্তিমালিকানায় উৎসাহদান। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এটি ফেরি করতে তৎপর হয়। তবে এর পুরোদস্তুর বাস্তবায়িত হয় যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রিগ্যান প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাজ্যে মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। এ অনুযায়ী থ্যাচার সরকার জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, সামাজিক নিরাপত্তার দায় সংকোচন শুরু করে ্এবং ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করে। অপরদিকে ধনীদের কর রেয়াত দেওয়া হয়। ক্রোধ ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও নিম্ন-আয়ের মানুষ। ‘লৌহমানবী’ লৌহহস্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। লড়াকু নাগরিক সমাজ বলেছিল, থ্যাচারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানেও তারা ধিক্কার জানাবে। জানিয়েছিলও। যখন থ্যাচারের শবদেহ বহনকারী গাড়ি যাচ্ছিল, তখন হাজার হাজার নর-নারী পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ঘৃণা প্রকাশ করেছিলেন।
আমাদের দেশেও এ তত্ত্ব তখনই আমদানি হয়। প্রচলিত ধারার রাজনীতিবিদ, বড় বড় অর্থনীতিবিদ নয়া উদারতাবাদ, মুক্তবাজারের মাহাত্ম্য প্রচারে প্রতিযোগিতা শুরু করেন। এটি বাস্তবায়নে বামদের প্রতিবাদ ছিল। তবে তা আন্দোলনে রূপ নেয়নি। ফলে সরকার চোখ-কান বন্ধ রেখে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে তা দ্রুত বাস্তবায়নও শুরু করে। বিরাষ্ট্রীয়করণ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতে ব্যয় সংকোচন, কৃষির ভর্তুকি কমিয়ে আনাসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বিদেশি পণ্যের জন্য দ্বার খুলে দেওয়া হয়।
১৯৮৩ সালে করবিন ও টনি ব্লেয়ার প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে এলেন। করবিন মানুষের অধিকারের পক্ষে সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু লেবার পার্টি পথ হারাল। নয়া উদারতাবাদের নীতি গ্রহণ করল। এতে ঘুচে গেল লেবার ও টরির দূরত্ব। যারা লেবার পার্টিকে ডানে ঘোরালেন, ব্লেয়ার সঙ্গেই গা ভাসালেন। হাওয়ার টানে প্রধানমন্ত্রীও হলেন। আর করবিন বছরের পর বছর দল ও পার্লামেন্টে মানুষের অধিকার হরণকারী নীতির প্রতিবাদ করে চলেছেন। একজন ক্ষেপাটে মানুষ হিসেবে দল, পার্লামেন্ট, মিডিয়াতে চিহ্নিত হয়ে আছেন। দল ও পার্লামেন্টে গৃহীত নীতির ওপর শত শতবার আপত্তি করেছেন। তিনিই এখন যুক্তরাজ্যের তরুণদের প্রিয় কমরেড। নির্বাচনের পরও দলে তরুণদের সদস্য হওয়ার হিড়িক পড়েছে। এই কয়েক দিনে দেড় লাখ লোক সদস্য হয়েছেন। এটি আমাদের দেশের দলগুলোতে নাম লেখানোর মতো নয়। সদস্যদের অন্যান্য দায়িত্বের সঙ্গে নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। উল্লেখ্য, যেখানে লেবার পার্টির সদস্য ছিল ৮ লাখ, তা ১০ লাখে উন্নীত হতে চলেছে। তবে ২০১৫ সালে তার নেতৃত্ব গ্রহণে দলের প্রভাবশালী নেতাদের প্রবল বিরোধিতা ছিল। এখনও তা বহাল আছে। তখন তরুণদের সমর্থনে নেতা হয়েছিলেন। এখন তরুণরা যে হারে লেবার পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, তাতে করবিনের আর পেছনে তাকানোর প্রয়োজন নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে রিগ্যানের হাত ধরে নয়া উদারতাবাদ নীতি কার্যকর হয়। তখন প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি। তবে তরুণরা গর্জে ওঠে ২০১১ সালে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনে। তারা বলল, আমরা পরিবর্তন চাই। সেই রাষ্ট্র, সেই পৃথিবী চাই না, যেখানে আমরা ১০০ জনের ৯৯ জন, কিন্তু আমাদের হাতে ১% সম্পদ নেই। আর ১০০ জনের একজনের কাছে ৯৯%। এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে; মার্কিনের বাইরে নানা দেশে। আমার মনে হয়, এতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিও খানিকটা প্রভাবিত হয়। সেই ঢেউ বামপন্থি খ্যাত বার্নি স্যান্ডার্সকে এগিয়ে দিল। করবিনের চেয়ে ১০ বছরের বড় স্যান্ডার্স মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হওয়ার প্রতিযোগিতায় এগিয়েও গেলেন। হিলারি পরাজয়ের মুখে নানা নোংরা খেলা শুরু করেন। স্যান্ডার্সকে নাস্তিক বলে বিপাকে ফেলতে চাইলেন। তারপরও প্রাইমারিতে স্যান্ডার্সের জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে চলছিল, তখন ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে স্যান্ডার্সকে সরিয়ে দেওয়া হলো। হিলারিকে মনোনয়ন দেওয়া হলো। স্যান্ডার্সের সমর্থকদের একাংশ বলল, তারা এ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ভোটদানে বিরত থাকবে। ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর অনেকে মনে করেন, স্যান্ডার্স প্রার্থী হলে ডেমোক্র্যাটদের জয়ের সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
সাধারণ মানুষ ট্রাম্প ও হিলারিকে একই পথের পথিক ভেবেছে। আর স্যান্ডার্সকে ভেবেছে ভিন্নমাত্রার রাজনীতিক হিসেবে। তিনি নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্র একেবারে বদলে যেত_ এমন কিছু আমিও ভাবি না। যেটি ভাবছি, যুুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ পরিবর্তন চাইছে। নীতি ও ব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা বলছে। পরিবর্তনের হাওয়া আজ সারা দুনিয়ায় বইছে। ফ্রান্সেও প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক বর্ণবাদী লো পেনকে পরাজিত করলেন মাক্রোন, যার মূলধারার রাজনীতিতে কোনো অবস্থান ছিল না।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর ইঙ্গ-মার্কিন রাজনীতিবিদ, মিডিয়া তারস্বরে চিৎকার করত_ পুঁজিবাদই শেষ কথা। কিন্তু তিন দশক পার না হতেই পুঁজিবাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো থেকে ভাঙনের আওয়াজ আসছে। এর মানে এই নয় যে, ওসব দেশে সমাজতন্ত্রের পালে হাওয়া লেগেছে। সেটি না হলেও তারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে; প্রকৃতি বিধ্বংসী নীতি ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে; শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে, মানুষের অধিকারের পক্ষে, সবার জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার পক্ষে। ট্রাম্প-তেরেসাদের কাছে এসবের সমাধান নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, ট্রাম্প_ কোনোটাই শেষ কথা নয়। শেষ কথা_ মানুষ। দুনিয়াজোড়া মানুষ। নানা বর্ণ, নানা ধর্মের মানুষ। সেই মানুষের জন্য চাই কল্যাণমুখী রাজনীতি, যোগ্য নেতৃত্ব। আমরা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে, যুদ্ধ বাধিয়ে অস্ত্র ব্যবসা করে_ এমন নেতৃত্ব চাই না। আমরা চাই সেই নেতৃত্ব, যারা মানুষের অধিকারের কথা বলে; শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলে; বিশ্বশান্তির কথা বলে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলে, প্রকৃতি রক্ষার কথা বলে। তাই একজন লড়াকু করবিনের জন্য আমাদের অভিনন্দন।

লেখক
আবু সাঈদ খান
সাংবাদিক