jongibadজঙ্গি দমনে সরকারের অসামান্য সাফল্যের কথাই শুনে আসছি। বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের হাত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা তা প্রমাণ করে না। বরং প্রমাণিত হয় যে, জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এখনও সক্রিয় রয়েছে। তাদের অস্ত্র ও অর্থের উৎস বন্ধ হয়ে যায়নি। এই অপারেশনে তারা কয়েকটি মাইক্রোবাস, গাড়ি ও অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে এবং একজন পুলিশকে হত্যা ও অন্যদের গুলিবিদ্ধ করে জেএমবি ঊর্ধ্বতন নেতাদের ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। কেবল জেএমবিই নয়, দেশে অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতারও প্রমাণ মিলছে। মাঝে মধ্যে অস্ত্র ও পুস্তিকাসহ জঙ্গিদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে।
জঙ্গি দমনে পুলিশ-র‌্যাব কতটুকু তৎপর_ সে আলোচনা থাক। প্রশ্ন হচ্ছে, কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ভর করে জঙ্গি তৎপরতা নির্মূল করা কি আদৌ সম্ভব? বরং খতিয়ে দেখা দরকার_ জঙ্গিবাদের মতাদর্শিক ভিত্তি কী? কেন, কারা জঙ্গি সংগঠনগুলোতে নাম লেখাচ্ছে? কোথা থেকে মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে? এসব প্রশ্ন এড়িয়ে কেবল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবেলার সুযোগ নেই।
জঙ্গিবাদ হচ্ছে মৌলবাদী রাজনীতির সশস্ত্র রূপ। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনই মৌলবাদী রাজনীতির মূল লক্ষ্য। এই মৌলবাদী রাজনীতির ছত্রছায়ায় জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। বাংলাদেশেও ঘটছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, যেসব জঙ্গি নেতা গ্রেফতার হয়েছে বা যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে, তারা জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে তালিম নিয়েছে। বিভিন্ন সময় গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের আস্তানা থেকে মওদুদীর পুস্তকাদি পাওয়া গেছে। তা ছাড়া যারা আফগানিস্তানে নজিবুল্লাহ সরকারকে উৎখাতে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, তাদের অধিকাংশ এক সময়ের শিবির কর্মী। আফগানিস্তান থেকে ছবক নিয়ে আসা ব্যক্তিরা এখানে জঙ্গি সংগঠন গড়ে তুলেছে। আদালতের রায়েও জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম জঙ্গিদের প্রকাশ্য মঞ্চ, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ইত্যাদি তাদের মূল সংগঠন। কেবল ধর্মভিত্তিক দলগুলোই নয়, মূলধারার দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিও জঙ্গিবাদের ক্ষেত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। হীন স্বার্থে দলগুলো রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করছে। মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলেছে বা চলছে। ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করেছে। তবে বিএনপি এ ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন। তাদের বিগত শাসনামলে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াত নেতাদের মন্ত্রিত্ব দিয়েছিল। এখন দলটির এক কাঁধে জামায়াত, আরেক কাঁধে হেফাজত।
মৌলবাদীদের সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্রের সংগ্রাম হয় না_ তা এসব রাজনীতিক বোঝেন না তা নয়। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে তারা মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত মেলান। আর তাদের হাতের ওপর দিয়ে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে। এটি মনে রাখা দরকার, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জন্য রাজনীতির সুযোগ অবারিত রেখে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করা যাবে না। বরং এতে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করা হবে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর অধিকাংশের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ হচ্ছে নাপাক স্থান, তারা তাদের পবিত্র স্থান পাকিস্তানের স্বপ্নে এখনও বিভোর। এটি বুঝেও মুক্তিযুদ্ধের ধারার দলগুলো মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে।
এটি সবার জানা যে, মাদ্রাসাগুলোতে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীরা ঘাঁটি গেড়েছে। স্বাধীনতার ৪২ বছরে কওমি মাদ্রাসার আধুনিকায়ন হয়নি, সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়নি। এ সুযোগ নিয়ে ধর্মের নামে সেখানে মৌলবাদী রাজনীতির চর্চা হচ্ছে, কোথাও কোথাও শিক্ষার আড়ালে সশস্ত্র প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।
বহু স্থানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা এসব মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক। এসব রাজনৈতিক নেতা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চান, কখনও কখনও ব্যবহার করেছেনও। নির্বাচনে তাদের সমর্থন কাজে লাগিয়েছেন। আর এখন মৌলবাদীদের হাতে তারা ব্যবহৃত হচ্ছেন। দেখা যায়, ধর্মীয় জলসায় এসব রাজনৈতিক নেতাকে সভাপতি করে তাদের সামনেই জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছে। বিষোদ্গার করা হচ্ছে জুমার নামাজের খুতবার সময়ও। বলা হচ্ছে, ‘শহীদ মিনার-জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়া শেরেকি, ছেলেমেয়েদের একই প্রতিষ্ঠানে পড়া বেলেল্লাপনা। ধর্মস্থানগুলোতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মওলানা শাহ আহমদ শফীর বক্তৃতায় দেওয়া তেঁতুলতত্ত্ব বা ফুলতত্ত্ব ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে এমন অপব্যাখার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ হয়েছে। এখন তা হচ্ছে না। ষাটের দশকে এ ধরনের বক্তৃতার জন্য অনেককে ইমামতি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর আজ ইসলামী ফাউন্ডেশনের বেতনভুক্তরা নির্বিবাদে মৌলবাদ রাজনীতির চর্চা করে চলেছেন, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিকৃত করে প্রচার করছেন। এসব দেখার দায় কার?
শুধু মাদ্রাসায় নয়, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদ চর্চা হচ্ছে। এর কারণ বহুবিধ। দীর্ঘদিন ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। এ কারণে সভা-সেমিনার-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও মন্থর হয়ে পড়েছে। এর পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা বড় দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনের চাঁদাবাজি, দখলবাজি দেখছে। এ পরিস্থিতিতে শিবির কিংবা জঙ্গিরা সহজেই শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হচ্ছে।
সর্বোপরি জামায়াত-শিবিরের রয়েছে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত। তারা অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিয়েও বশ করছে। বিএনপির শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক জামায়াতি শিক্ষকতার চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হাত ধরে অনেক জামায়াত কর্মী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীর চাকরি পেয়েছেন। এর কারণ সবারই বোধগম্য। এসব স্থানে টাকা ছাড়া চাকরি হয় না । জামায়াত দলীয় ফান্ড থেকে টাকা দিয়ে কর্মীদের চাকরি দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কর্মীরা এমন সুযোগ পাননি। এক আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা আমাকে বলেছেন, ‘আমার ছেলেটার মাস্টারির চাকরি হলো না। এমপি সাহেব আমার কাছ থেকে টাকাও চাইতে পারলেন না, চাকরিও দিলেন না।’ এভাবে তৃণমূলে জাল বিস্তার করেছে জামায়াত-শিবির। আর সে ছায়াতলে জঙ্গিবাদের চর্চা হচ্ছে।
জামায়াত-শিবির যে জঙ্গিবাদের ধারক-বাহক, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলও ওয়াকিবহাল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক তথ্য ও মতামত সংস্থা ‘আইএইচএম জেনসের’ বিশ্বের সন্ত্রাসী তালিকায় ছাত্রশিবির তৃতীয়। তালেবানের পরেই এর স্থান। কোনো বিবেচনায়ই জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও জামায়াতকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।
ইতিমধ্যে জামায়াত গড়ে তুলেছে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যে অর্থ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই জঙ্গিবাদ নির্মূলে জামায়াতের রাজনীতি ও আর্থিক জোগান দুই-ই বন্ধ হওয়া জরুরি। তবে জামায়াত ও জঙ্গিদের নিষিদ্ধই শেষ কথা নয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। সে সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে ঢেলে সাজানো দরকার, যাতে ভ্রান্ত দর্শনে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করতে না পারে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষার গ্যারান্টি দিতে হবে_ যাতে মৌলবাদীরা তাদের দারিদ্র্যের সুযোগ না নিতে পারে। আসলে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় দরকার সমন্বিত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সেটি গ্রহণ না করে কেবল পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ মোকাবেলার চেষ্টা হচ্ছে। সমন্বিত পদক্ষেপ না গ্রহণ করলে এটি বুমেরাং হতে পারে।
জঙ্গি দমনে পুলিশি অভিযানও কতখানি সুচারুরূপে হচ্ছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন করা যায়। ২৩ ফেব্রুয়ারির জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা পর্যালোচনা করলে পুলিশের ঢিলেঢালা অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। দণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের স্থানান্তর করতে মাত্র চারজন পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কী করেই-বা তারা পুলিশের যাত্রার দিনক্ষণ জানতে পারল? তবে কি পুলিশের মধ্যে তাদের ‘লোক’ রয়েছে, না পুলিশকে বশ করেছে? এসব কিছুই জঙ্গিদের মোকাবেলায় পুলিশের দুর্বলতারই প্রমাণ দেয়। জানি না সে দুর্বলতা ঢাকতেই উদ্ধার করা জঙ্গি রাকিব হাসান ‘বন্দুকযুদ্ধে’র শিকার হলো কি-না।
জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস মোকাবেলায় এ ধরনের পদক্ষেপের পরিণতি চূড়ান্ত বিচারে ভয়াবহ। সমাজের ব্যাধি ছাড়াতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়লে তা হবে অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
আমরা শান্তি চাই, মুক্তি চাই, কঠোর হস্তে জঙ্গিদের দমন চাই, কোনো মানুষ হোক জঙ্গি বা সন্ত্রাসী_ তার মানবাধিকারের লঙ্ঘন চাই না।