krishiএ এক অভিনব প্রতিবাদ! আলুচাষিরা বস্তা বস্তা আলু নদীতে ঢালছেন, রাস্তায় শুয়ে থাকছেন আলু ছড়িয়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আলুচাষিরা এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন। কিন্তু কেন_ তা কি ব্যাখা করার প্রয়োজন আছে?
কত স্বপ্ন নিয়ে চাষি আলু চাষ করেছেন। আলুর ফলন ভালো হলে তাদের দুঃখ ঘুচবে। আলু বিক্রি করে তারা ব্যাংকের ঋণ শোধ করবেন, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করবেন, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ দেবেন। সবই এখন মিথ্যা! উৎপাদন খরচ উঠছে না। আলুচাষিদের কথা শুনেছি। টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে প্রতিবেদন দেখেছি। সে অনুযায়ী, এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ৬ থেকে ৭ টাকা। আর তা বিক্রি করতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই টাকায়। তিন কেজি আলু বিক্রি করে এক কাপ চায়ের দাম হচ্ছে না। তাই দুঃখ-ক্ষোভ-অভিমানে দরিয়ায় আলু ফেলে, মহাসড়কে ছড়িয়ে দেশের হর্তাকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন চাষিরা।
কৃষকদের এ প্রতিবাদ সরকারের কানে পেঁৗছেছে। বিষয়টি গড়িয়েছে সংসদেও। জনৈক সংসদ সদস্যের জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ নোটিশের ওপর বক্তব্য দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। কৃষকবান্ধব দাবিদার সরকারের কৃষকদরদি মন্ত্রী কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘আলু নিয়ে এ সমস্যা সরকার গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমরা তাদের স্থানীয়ভাবে আলু সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছি।’ পরামর্শ দিয়েই তিনি কর্তব্য সমাধা করেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। এর বাইরে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখছি না। কৃষিমন্ত্রী তার বক্তৃতায় হেফাজতের প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গত বছর মে মাসে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ এবং জানুয়ারিতে বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধের পর থেকে আলু পরিবহনে সমস্যা দেখা দেয় … ঢাকা মেট্রোপলিটন শহরের হোটেল, ছাত্রাবাস বন্ধ থাকায় ভোক্তা পর্যায়ে আলুর ব্যবহার হ্রাস পায়। আলুর চপ, মাংসের সঙ্গে আলু, খাসির মাংসে আলু, বিরিয়ানিতে আলু, বিয়েবাড়িতে আলু এবং লাবড়ায় আলুর ব্যবহার কমে যায়।’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। এটি সত্য যে, আন্দোলন-অবরোধে পরিবহন সমস্যা দেখা দেয়। তখন ট্রাকের ভাড়া বেড়ে যায়। এখনও বাড়তি ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। সে চাপ গিয়ে পড়ছে আলুচাষিসহ তৃণমূলের বিক্রেতাদের ওপর। তবে সেটি কি একমাত্র কারণ?
অবরোধ-হরতালের ফলে রাজধানীতে আলুর চাহিদা কমে গেছে_ এটি ছেলে ভোলানো গপ্পো। হরতাল-অবরোধে শহরের ছাত্রাবাসগুলো কি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? বিয়ের অনুষ্ঠান কমেছিল সত্য; কিন্তু এখন তো অনুষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। তাহলে সমস্যা কী? মন্ত্রীর কথায় মনে হচ্ছে, অবরোধ-হরতালের প্রভাবে সবাই বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার কথা ভুলে গেছে!
এখনও রাজধানীতে ১০ থেকে ১৫ টাকা দরে আলু কিনতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে_ উৎপাদন কেন্দ্রের বিক্রয়মূল্য দুই টাকা, তার অতিরিক্ত কেজিপ্রতি ৭ থেকে ১২ টাকা কি মহাজন-ফড়িয়া-আড়তদার-পরিবহন মালিকদের প্রাপ্য? এ ক্ষেত্রে কি সরকারের করার কিছুই নেই?
গত বছর এই সময়ে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৭ থেকে ১০ টাকা ছিল। এবার কেন ততটুকু পাচ্ছেন না কৃষক? সরকার বলছে, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৫ লাখ টন, সেখানে ৮৬ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে বড় ব্যবধান নেই।
সরকার কৃষককে আলু চাষে উৎসাহ দিয়েছে সত্য, কিন্তু আলু বাজারজাতকরণসহ অন্যান্য কোনো পরিকল্পনা নেই। রফতানির কথা বলা হচ্ছে, তবে এর পরিমাণ কত? গড়ে বছরে যেখানে ৮০ লাখ টন আলু উৎপাদিত হচ্ছে, সেখানে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন রফতানি হচ্ছে। আসলে বহির্বিশ্বে এখন কাঁচা আলু নয়, আলুজাত পাউডারের চাহিদাই অধিক, যা ফাস্টফুডের বড় উপকরণ। আর আলুজাত পাউডার করার ব্যবস্থা থাকলে হিমাগার ছাড়াই তা সাধারণ গুদামে সংরক্ষণ করা যায়; কিন্তু সে উদ্যোগও নেই। আলু সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে সরকার নির্বিকার। আলু সংরক্ষণে শুধু ব্যক্তিমালিকানাধীন হিমাগারের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে হিমাগার করা কিংবা কৃষক সমবায়ের মাধ্যমে হিমাগার পরিচালনা কি কঠিন কিছু? আমি দূরের উদাহরণ টানতে চাই না। প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে ব্যক্তিমালিকানাধীন গুদাম ও হিমাগারের পাশাপাশি সরকার ও কৃষক সমবায়ের গুদাম ও হিমাগার আছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সমবায়গুলো নিজস্ব পরিবহনও পরিচালনা করছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও কৃষক সমবায় ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে কৃষক সমবায়গুলো গুদাম, হিমাগার ও ট্রাক-ভ্যানের অধিকারী হয়েছে। এভাবে সেখানে কৃষক স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে। মহাজন-আড়তদার-ফড়িয়া-পরিবহন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হচ্ছেন না কৃষক। এমন পদক্ষেপের কথা কি আমরা ভাবতে পারি না?
স্থানীয়ভাবেও আলুর চাহিদা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ বা প্রচার দেখছি না। আলু বিভিন্ন দেশে অন্যতম প্রধান খাদ্য; চাল, গম, ভুট্টার মতোই আলু জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন। আমাদের দেশে এটি কেবল সবজি বা তরকারি হিসেবেই ব্যবহার হতো। এখন অবশ্য চপ, শিঙ্গাড়া, ফাস্টফুড, বিরিয়ানিতে আলু ব্যবহৃত হচ্ছে। আলু দিয়ে আলুপরোটা, আলুপুরি, আলুপুস্তা ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে।
আলুর চাহিদা বাড়াতে এসব খাদ্য তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আলুজাত টিফিন সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া যায়। সারাদেশে সম্ভব না হোক, কিছু স্কুলে এমন উদ্যোগ নেওয়া কঠিন কিছু নয়। একসময় আটাও ছিল শখের খাবার কিংবা দুর্ভিক্ষের অবলম্বন। সেটি এখন অন্যতম প্রধান খাদ্য। আলু হতে পারে চাল ও গমের মতো অন্যতম প্রধান খাদ্য।
আসলে কৃষি নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার। কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে হলে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকতে হবে, মুক্তবাজারের ওপর হাত-পা ছেড়ে দিয়ে লাভ নেই। বরং রাষ্ট্রীয় ও কৃষক সমবায়গুলোর মাধ্যমে গুদাম, হিমাগার, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তিমালিকানায় কৃষিভিত্তিক শিল্পোদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে। আর কৃষককে মাঠে ফসল বপন-রোপণের আগেই বলে দিতে হবে, কোন ফসলের কী দাম হবে। সরকার সে দামে কৃষকের কাছ থেকে ফসল কিনবে। দেশে প্রয়োজনীয় গুদাম-হিমাগার ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে উঠলে কেবল আলুই নয়, বিপুল পরিমাণ আনারস, পেয়ারা, টমেটো, শাকসবজিসহ মৌসুমি ফলফলাদি সংরক্ষণ করা যাবে। এভাবে কৃষক স্বার্থ রক্ষিত হতে পারে। কৃষি হতে পারে নতুন মাত্রায় উন্নীত।
প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শ্রেণী সংগঠন না হলেও অতীতে তার শিকড় ছিল কৃষকের মধ্যে, শ্রমিকের মধ্যে। দলটি কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে এক সময়। তখন নেতাদের সঙ্গে কৃষক-শ্রমিকের সম্পর্ক ছিল। এখন বেশিরভাগ নেতাই উপরতলার মানুষ, কৃষক-শ্রমিকের সঙ্গে তাদের যোজন যোজন দূরত্ব। যে কারণে কৃষকের সমস্যা নিয়ে দল কিংবা সরকারের মধ্যে তেমন অনুরণন হয় না, যেটি আগে হতো।
সংসদে বিরোধী দলেরও কৃষকের সুখ-দুঃখ নিয়ে কথা নেই। কী কথাইবা বলবেন সরকারের অনুগত বিরোধী দল? বিরোধী দলইবা বলি কী করে? স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পত্নী রওশন এরশাদের বিরোধী দলের অবস্থা সুকুমার রায়ের ‘হাঁসজারু’ অভিধার মতো। হাঁসজারু যেমন না হাঁস না সজারু। তেমনি রওশনের বিরোধী দল না বিরোধী দল, না সরকারি দল। আসলে সেটি স্ববিরোধী দল। সে দল দিয়ে কৃষকের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হতে পারে!
প্রশ্ন হচ্ছে, মাঠের বিরোধী দল বিএনপি আলুচাষিদের দুর্দিনে কী করছে? বিএনপিও উপরতলার মানুষের দল। ধনিক-বণিকের স্বার্থে দলটি যতটুকু সোচ্চার, তার কিয়দংশও কৃষকের কথা ভাবে না। বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেই তাদের কৃষকদরদ সীমাবদ্ধ।
মানুষের প্রত্যাশা বামদের কাছে বেশি; কিন্তু তারাও আজ হীনবল, কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থে তাদের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেই। এক সময় ছাত্রসমাজ কৃষক স্বার্থে সোচ্চার হতো, এখন বড় দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলো টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত। তারা আজ রাজনৈতিক দলের লাঠিতে পরিণত, বিভ্রান্ত।
কৃষকের ফরিয়াদ কে শুনবে? কৃষক কার কাছে যাবেন? তাই নিরুপায় হয়ে কষ্টের ফসল নদী-রাস্তায় ছড়াচ্ছেন।
সরকার আর না হোক, দুটি পদক্ষেপ কি নিতে পারে না? প্রথমত, কৃষিমন্ত্রীর কথায় আসা যাক। তিনি স্থানীয়ভাবে আলু সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন। এটি সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সরকার ন্যায্যমূল্যে আলু কিনে কৃষকের ঘরেই দু’তিন মাস তা সংরক্ষণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আলুচাষিদের কৃষি ঋণের সুদ মওকুফ করে দিতে পারে। এ দুটি কাজ করলে তা হবে কৃষকদের জন্য বড় উপশম।
পরিশেষে বলব- দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে কৃষকবান্ধব নীতি ও পদক্ষেপের বিকল্প নেই।