LIberationমুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। একাত্তর আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে, জাতির ললাটে পরিয়ে দিয়েছে বীরত্বের তকমা।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। গুটিকতক আলবদর-রাজাকার-শান্তি কমিটির সদস্য ছাড়া সমগ্র জনগোষ্ঠীই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। তবে যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধ সংঘটিত করেছেন, প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন_ তারা সূচনাতেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জনগণের কাছে সম্মানিত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করা হয় এবং তাদের মর্যাদা ও পুনর্বাসনের কতিপয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারীর অনন্য ত্যাগ রয়েছে, যারা পাকিস্তানি হানাদার-রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত-লাঞ্ছিত, তাদের বীরাঙ্গনা সম্মানে ভূষিত করা হয়। রাজধানীসহ কতিপয় জেলায় পুনর্বাসন কেন্দ্র করা হয়েছিল। সেখানে অসহায় বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা ও কাজের প্রশিক্ষণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অল্পদিনেই পুনর্বাসন কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলা হয়। তাছাড়া সমগ্র দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই বীর নারীদের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এমনকি যাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে ঠাঁই হয়েছিল, তাদের নাম-ধাম-পরিচয় সংরক্ষণ করা হয়নি। রাষ্ট্র তাদের পাশে থাকেনি। স্বাধীনতার ৪২ বছরে কেউ তাদের খবর রাখেনি।
বেশিরভাগ বীরাঙ্গনাই চরম দুরবস্থার শিকার। তাদের দু’মুঠো খাবার জুটছে না। চিকিৎসা মিলছে না। রোগ-শোকে, অবহেলা-অযত্নে দিন গুজার করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে হাইকোর্ট ডিভিশন থেকে একটি রুল জারি করা হয়েছে। জানতে চাওয়া হয়েছে_ আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে কেন বীরাঙ্গনাদের সমন্বিত তালিকা প্রস্তুত করে তা গেজেট আকারে প্রকাশ এবং তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। আদালতের এই ভূমিকা অভিনন্দনযোগ্য।
উল্লেখ্য, সমকালসহ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে সিরাজগঞ্জের সালেহা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সংগঠনের সভাপতি মিতালী হোসেন ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রুল জারি করা হয়েছে।
এটি সত্য, স্বাধীনতা-উত্তরকালে তালিকা করা ছিল কঠিন। সমাজের রক্ষণশীল মানসিকতা ছিল এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। সেদিন ‘বীরাঙ্গনা’ অভিধা তাদেরকে মর্যাদা দেয়নি, উপরন্তু দিয়েছে অনেক কষ্ট ও লাঞ্ছনা। তাই নির্যাতিত নারীরা সত্য আড়াল করে রেখেছেন।
৪২ বছরে সমাজ খানিকটা হলেও বদলেছে। সনাতনী মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন প্রজন্ম নির্যাতিত-ধর্ষিতাদের কলঙ্কিত মনে করে না, বরং নির্যাতক-ধর্ষকদের প্রতি ঘৃণা-ক্রোধ প্রকাশ করে। অনেকেই এখন বীরাঙ্গনাদের সম্মানের চোখে দেখছে। বীরাঙ্গনাদের অনেকেই সত্য প্রকাশে সংকোচহীন। মনে পড়ে, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গণআদালত এবং গণতদন্ত কমিশন গঠিত হলে তখন কুষ্টিয়াসহ আরও দুয়েক জায়গা থেকে কয়েকজন বীরাঙ্গনা এসেছিলেন, সাহস করে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, নির্যাতনের রোমহর্ষক কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন। তারপর থেকে সংবাদমাধ্যমে অনেকেই কথা বলছেন। তাদের দুঃখ-বেদনার কথাও প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র নির্বিকার।
সঙ্গতভাবেই প্রত্যাশা যে, আদালতের রুল জারির পর সরকারের নীরবতা ভাঙবে, বীরাঙ্গনাদের তালিকাভুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবে। তবে সঙ্গত কারণেই বীরাঙ্গনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা ঠিক হবে না। কারণ, রক্ষণশীলতা এখনও অনেকের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে করণীয় কী? উচিত হবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে যে তারা অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেনও তা বলাই বাহুল্য।
আরেক বঞ্চনার শিকার যুদ্ধশিশু। নির্যাতিত মায়ের এই শিশুরা যেসব শিশুর মতো নিষ্পাপ, তা কি আমরা কখনও উপলব্ধি করেছি? সেদিন অনেক যুদ্ধশিশুকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কোন দেশে কীভাবে কত শিশুকে তুলে দেওয়া হয়েছিল তা আমাদের জানা নেই। এর কোনো উত্তর রাষ্ট্রের কাছে আছে বলে মনে হয় না।
আজ সেই শিশুদের অনেকেই বিদেশি দম্পতির দত্তক পুত্র-কন্যা হিসেবে বেড়ে উঠেছে। উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে। তাদের কেউ কেউ জন্মভূমি বাংলাদেশে ছুটে আসছে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে বলছে_ বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। বাংলাদেশ কি তাদের সেই আবেগের কোনো মূল্য দিচ্ছে? বাংলাদেশ কি বলতে পারে না যে, তোমরা এই দেশমাতার সন্তান। বাংলাদেশ কি স্বাধীনতার সঙ্গে বাহুলগ্ন হয়ে ভূমিষ্ঠ এসব সন্তানকে নাগরিকের মর্যাদা দিতে পারে না? সেটি করা হলে তা হবে মানবতার ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত। এতে দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। একাত্তরের ইতিহাস হবে আরও মহিমান্বিত।
প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য যা করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে তা নিয়ে হীন রাজনীতি। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়েও চলেছে বাণিজ্য। এক সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সনদ বেচাকেনা হয়েছে। অমুক্তিযোদ্ধারা তা কিনে চাকরি-বাকরি বাগিয়ে নিয়েছে। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। পাশাপাশি ৪২ বছর ধরে যাচাই-বাছাই করে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও সুযোগ-সন্ধানীরা মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়ে সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে। আর অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্যে স্বীকৃতি মিলছে না। তালিকাভুক্ত হচ্ছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানরা_ যাদের অনেকেই একাত্তরে ছিল শিশু। শুধু তাই নয়, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় রাজাকাররাও ঢুকে পড়েছে। ফরিদপুরে গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে এমনই একটি ঘটনা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জোর প্রতিবাদ করেছেন। শহরের কামরুজ্জামান জাসু নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেদার অভিযোগ_ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে, পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর দিয়েছে। তার ভূমিকার কথা মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসেছে। আমার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর’ বইয়ে তার ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কী করে যে তার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো তা বিস্ময়কর। ক’দিন আগে অপর এক জেলায় এক রাজাকারের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা-জনগণ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদলিপি দিয়েছেন। এমন তথ্য আরও পাওয়া যাবে।
বলা যায়, সব সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধা হীন স্বার্থে ব্যবহৃতও হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের নামে বিভিন্ন সময়ে যা করা হয়েছে তা অমাননাকর। একদা মুক্তিযোদ্ধাদের হাটবাজার-ঘাটের তোলা উঠানোর কাজে নিয়োজিত করে বিতর্কিত করা হয়েছে। অনেক স্থানে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের নামে জুয়া খেলার ব্যবস্থা করে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনের আড়ালে সংঘটিত হয়েছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ।
এটি অবশ্যই ধন্যবাদযোগ্য যে, বর্তমান সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। এখন তা বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগে ছিল কেবল অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা, এখন সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য সম্মানী হিসেবে এটি প্রদান করা হচ্ছে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘটা করে কম্বল বা ছাতা বিতরণ করা হয়। সেটি দেওয়ার যে ব্যবস্থা তা দেখে মনে হয় দান-খয়রাত বা ত্রাণসামগ্রী বিলির অনুষ্ঠান। যদি মুক্তিযোদ্ধাদের শীতবস্ত্র বা ছাতা দিতে হয়, তা তাদের বাড়িতে পেঁৗছে দেওয়াই উচিত। তা না করে যেভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তা করুণা প্রদর্শনের শামিল।
কথা হচ্ছে_ অনুষ্ঠানের মাঝে দেওয়ায় আপত্তি নেই, তবে তা দিতে হবে ত্রাণ নয়, উপহার হিসেবে। জনপ্রতিনিধি বা সবকারি কর্মকর্তাদের বলনে-কথনে যেন তা সেটি প্রতীয়মান হয়।
অর্থনৈতিক সহযোগিতাই শেষ কথা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে তাদের আমন্ত্রণ বা অতিথি হিসেবে মর্যাদা প্রদানের মধ্য দিয়ে সম্মানিত করা যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অন্য সব প্রতিষ্ঠানের সদস্য বা উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তাতে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত বোধ করবেন এবং ওই সব প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রাধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা ছিলেন। সেখানে অন্যদের সঙ্গে সম্মানিত অতিথি হিসেবে ছিলেন ওই হলের চতুর্থ শ্রেণীর এক কর্মচারী, যিনি একাত্তরের রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন। ওই পরিচয় নিয়ে তিনি কথাও বলতেন না। হলের ছাত্ররা আবিষ্কার করল, তাদের হলের দায়িত্বশীল ও সদালাপী ব্যক্তিটি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই ওই অনুষ্ঠানে তাকে অতিথি হিসেবে সম্মানিত করা হয়। যখন তার নাম ঘোষণা করা হলো, তখন উপাচার্য, প্রাধ্যক্ষ, শিক্ষক-ছাত্রসহ সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন। সম্মান প্রদানের ক্ষেত্রে এটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে এমন কিছু করা উচিত নয়, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের যখন চাকরিতে সুযোগ করে দেওয়া হয়, তা নিয়ে কারও কথা ছিল না। বরং সেটি প্রশংসিতই হয়েছিল। কিন্তু এবার বিসিএস পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।
মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের জন্য শতকরা ৩০ ভাগ কোটা রাখা অযৌক্তিক মনে হয়েছে। সেটি সন্তানদের পর তাদের সন্তান অর্থাৎ নাতি-পুতিদের পর্যন্ত বহাল রাখার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয়। মেধার প্রতিযোগিতা অবারিত রাখতেই কোটা প্রথা কমিয়ে আনা এবং তা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পর আর তা বহাল না রাখাই হবে যুক্তিযুক্ত। ইতিপূর্বে এ নিয়ে লিখেছি। এখানে বিস্তারিত বলার কিছু নেই। শুধু বলব_ মুক্তিযোদ্ধাদের এমন কোনো সুযোগ নেওয়া বা দাবি করা উচিত নয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তিতে কালো ছায়া পড়তে পারে।
পরিশেষে আবারও উল্লেখ করতে চাই_ বীরাঙ্গনাদের প্রতি অবহেলার অবসান হওয়া দরকার। তাদের অবদানের কথা স্মরণ রেখে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করে অনুরূপ সুযোগ দেওয়াই হবে বীরাঙ্গনাদের প্রতি যৌক্তিক সম্মান প্রদর্শন।