প্রধান বিরোধী দল ছাড়া অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। এ জন্য দেশের প্রধান দুই দল বা তাদের নেতৃত্বাধীন জোট ‘ব্লেম গেইম’ খেলছে। নির্বাচনের প্রশ্নে সমঝোতা না হওয়ায় একে অন্যকে দোষারোপ করছে। এ বিতর্ক আজ থাক।
প্রশ্ন হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনার পক্ষে ব্যাপক জনমত (যা বিভিন্ন সময়ের জরিপে উঠে এসেছে) থাকা সত্ত্বেও বিএনপি কেন আন্দোলন রচনা করতে পারল না, কেন সরকারের ওপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগে ব্যর্থ হলো? এ ক্ষেত্রে বিএনপি নেতারা সরকারের দমন-পীড়ন নীতিকেই দায়ী করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন। কিন্তু সেটি একমাত্র কারণ বলা যায় না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সে সময়ের দমন-পীড়নের মুখে আন্দোলন সফল করেছিল। তখন আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের সাহসী ভূমিকা। পুলিশের বেপরোয়া হামলায় নেতাকর্মীদের মাথা ফেটেছে, রক্ত ঝরেছে। কিন্তু রাজপথ ছাড়েনি তারা। তাদের লক্ষ্য ছিল স্থির। তবে ওই আন্দোলনের টার্গেট পুলিশ বা সাধারণ মানুষ ছিল না। এবারের বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের আন্দোলনে পুলিশ ও জনতাকে টার্গেট করা হয়েছে। পুলিশের ভ্যান, যাত্রীবাহী বাস- ট্যাক্সি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা, গ্যাস বোমা ছোড়া হয়েছে। এটি সবারই বোধগম্য যে, জনগণ যখন টার্গেট হয়, তখন আন্দোলন জনসমর্থন হারায়।
এবারের আন্দোলনে সবচেয়ে তৎপর ছিল জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। কিন্তু জামায়াতের লক্ষ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় নয়, তারা আন্দোলনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুলের আন্দোলনে পরিণত করতে চেয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত ১৮ দলের সমাবেশে দেখা গেছে, জামায়াত কর্মীরা মঞ্চের সামনে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত নেতাদের ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড ঊধর্ে্ব তুলে ধরেছে, গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী, মুজাহিদের মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিয়েছে। যা জনগণ তো বটে, বিএনপির মুক্তিযুদ্ধ-সপক্ষ অংশকেও ক্ষুব্ধ করেছে। বিএনপির মধ্যম সারির এক নেতা আমাকে বলেছেন, বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তার সন্তান হয়ে এটি মেনে নিতে পারি না। এটি একজনের কথা নয়, বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর উপলব্ধি। এ কারণে বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। দল হয়ে পড়েছে জনবিচ্ছিন্ন। কেবল তাই নয়, জামায়াত সৃষ্ট সব সহিংসতার দায় আজ বিএনপির কাঁধে এসে পড়েছে। মানুষ পুড়িয়ে মারা, রেললাইন উপড়ে ফেলা, বিদ্যুৎ অফিসে আগুন দেওয়াসহ নাশকতামূলক কার্যকলাপে জনগণ আন্দোলনকারীদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা, লুটপাট, আগুন লাগানোর ঘটনা জনগণকে একাত্তর স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আঁতকে উঠেছে একাত্তরের বিজয়ী জাতির অন্তরাত্মা।
এসব সরকারের কাজ বলে বিএনপি অপরাধ স্খলন করতে চাইছে। অথচ টেলিভিশনের পর্দায় সবাই তাদের চেহারা দেখেছে। আক্রান্ত হিন্দু নর-নারীর কণ্ঠে অপরাধীদের নাম শুনেছে। সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন তদন্ত দলের অনুসন্ধানেও দেখা গেছে_ বিএনপির ছত্রছায়ায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এসব অপকর্ম করেছে, কোথাও কোথাও বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা সঙ্গ নিয়েছে। সাঁথিয়াসহ কতিপয় স্থানে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ সত্য আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই।
জামায়াতের সঙ্গ বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল ও জনবিচ্ছিন্ন করেছে, দেশ-বিদেশে দলটির ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। উল্লেখ্য, আন্দোলন রচনায় অক্ষম বিএনপি হয়ে পড়েছে অতিমাত্রায় বিদেশমুখী। তারা হয়তো ধারণা করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরকারের ওপর চাপ দিয়ে তাদের দাবি আদায় করে দেবে। এতে তাদের ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি। বরং নিজেদের হেয় করেছে। জনগণ তাদের বিদেশিদের করুণাপ্রার্থী ভেবেছে। বিএনপি নেতারা বুঝতে পারেননি যে, দেশের মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয়। বিদেশিদের খবরদারিতে তারা নাখোশ হয়, ক্ষুব্ধ হয়। একই সঙ্গে বিবেচ্য, যাদের কাছে এত ধরনা দিল, তারাই এখন বিএনপিকে জামায়াত-হেফাজত ছাড়তে বলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেই প্রস্তাব দেওয়ায় বিএনপি নিরুপায়। সম্ভবত এ কারণেই গত ২০ জানুয়ারি জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপি এককভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেছে। এ সভায় অন্যান্য শরিক দলের নেতারা এমনকি জাতীয় পার্টি ছুট কাজী জাফর বক্তৃতা করেছেন, কিন্তু জামায়াত ও হেফাজতের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এখন ভাববার বিষয়, এটি বিএনপির উপলব্ধি, না সাময়িক কৌশল।
জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করার কারণে বিএনপি যেমনি বিপর্যস্ত, তেমনি দেশ-বিদেশে সমালোচিত। জনগণ ‘ভোটারবিহীন-প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন’ নির্বাচন মেনে নেয়নি। কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বে রাস্তায় নামতেও অনীহ। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করবে?
২০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় খালেদা জিয়া শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের কথা বলেছেন, সংলাপের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে দলটি। জনবিচ্ছিন্নতা দূর করতে এসব বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসনের একটি মন্তব্য জনগণকে হতবাক করেছে। ঢাকায় হেফাজতদের অবস্থান থেকে হটানো এবং সাতক্ষীরায় যৌথ বাহিনীর অভিযান দেশীয় বাহিনীর পরিচালিত কিনা_ তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এটি বাংলাদেশের পুলিশ-বিজিবি-সেনাবাহিনীর কাজ বলে তার মনে হয়নি। প্রতিবেশী দেশের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়েছেন। দোষারোপের রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি দেশের আত্মমর্যাদা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টিও বিস্মৃত হয়েছেন। তাই জামায়াত ছেড়ে সভা করা, সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণের বিষয়টি ছাপিয়ে আলোচিত হচ্ছে তার এই অশোভন ও লাগামহীন উক্তি। প্রশ্ন এসে যায় যে, বিএনপি কি আবার নতুন করে ভারত কার্ড খেলতে চাইছে?
বলা আবশ্যক, পঁচাত্তরে পটপরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের গড়া দলটি শুরুতেই আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকেই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের হাত ধরাধরির নীতি অবলম্বন করে। সংবিধানে ধর্মীয় বিধান সনি্নবেশের পাশাপাশি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ স্লোগানের আড়ালে ধর্মকার্ড, ভারত বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িক ভেদনীতিকে পুঁজি করে। জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ছিল ক্যান্টনমেন্টমুখী। আদর্শিক দিক থেকে সেটিকে বলা যায়, পাকিস্তান ভাবাদর্শের বাংলাদেশি সংস্করণ, জগাখিচুড়ি মার্কা দল।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি গণমুখী দলে পরিণত হয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বের সাহসী ভূমিকা বিএনপিকে দেয় নতুন লাইফ টাইম। গড়ে ওঠে গণভিত্তি। দলের মুক্তিযোদ্ধা নেতারা একাত্তরের গৌরবগাথা প্রচার শুরু করেন। তরুণরা একাত্তরের ধ্বনিগুলো কণ্ঠে ধারণ করে। ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, নববর্ষ পালন করে। নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ দল হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে একাত্তরের চেতনায় জাগরণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেশে একটি নতুন আবহ তৈরি করেছে। সেই আবহে ধীরলয়ে হলেও আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় খানিকটা ফিরে এসেছে। কিন্তু ভোটের রাজনীতির অন্ধ মোহে বিএনপি মুখ ঘুরিয়ে পেছনে ছুটছে। ফলে একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির বিকশিত হওয়ার যে সুযোগ ছিল, তা ক্রমেই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এই পশ্চাদমুখিতা বিএনপির অস্তিত্বের জন্যও বড় হুমকি।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে, বিভিন্ন সূত্রের তথ্য থেকে মনে হচ্ছে, খালেদা জিয়ার চেয়ে তার ছেলে তারেক রহমান অসাম্প্রদায়িক-উদারনৈতিক বিএনপি গড়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়_ প্রবাদ এখানে সত্য। জানা যায়, জামায়াত ও অপরাপর জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে এই তরুণ নেতার আঁতাত গড়ে উঠেছে। অতীতে খালেদাতনয়ের হাওয়া ভবনের কাণ্ডকারখানা ও ভ্রান্তনীতি দলটির ভাবমূর্তির অনেক ক্ষতি করেছে। এ নিয়ে দলের মধ্যে চাপা ক্ষোভও আছে। কিন্তু কে তা সাহস করে বলবেন? দল যখন ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়, তখন দলের সিনিয়র নেতারাও হয়ে পড়েন কর্মচারী। কথাটি আওয়ামী লীগের জন্যও সত্য।
বিএনপি এখন রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। কোন দিকে পা ফেলবে? জামায়াত-হেফাজত ছেড়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথে অগ্রসর হবে, না জামায়াত-হেফাজতকে নিয়ে সহিংসতার আগুন জ্বালাতে থাকবে? গণতন্ত্র-সমঝোতা, না নাশকতার পথে চলবে? তার ওপর নির্ভর করছে বিএনপির ভবিষ্যৎ।