কেমন নির্বাচন চাই_ প্রশ্ন করা হলে প্রায় সবাই বলবেন, নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। বিগত দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা হচ্ছে_ তা হতে হবে কালো টাকা-সাম্প্রদায়িকতা-আঞ্চলিকতা-ধর্মের প্রভাবমুক্ত ও প্রশাসনের পক্ষপাতমুক্ত। সাম্প্রতিক সংযোজন_ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এখানে জনগণ ও জনসমর্থনপুষ্ট দলগুলোর অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এ গেল প্রত্যাশার দিক।
এমন নির্বাচনের স্বপ্ন এখনও শিকেয় বন্দি। তাই প্রত্যাশার কাছাকাছি হলেই গ্রহণযোগ্য। সেদিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য। এ নির্বাচনগুলোকে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বলা হয়েছে যে, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন কিংবা নির্বাচনী উৎসব। এর বাইরে বিভিন্ন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো কারচুপির নির্বাচন, ভোট ডাকাতির নির্বাচন, প্রার্থী হাইজ্যাকের নির্বাচন, নীলনকশার নির্বাচন, মিডিয়া ক্যুর নির্বাচন বলে পরিচিত হয়ে আছে।
এরশাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দল ও জামায়াত অংশ নিলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বাম ৫ দল তা বর্জন করে। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তিন জোট (৮ দল, ৭ দল ও ৫ দল) ও জামায়াতকে বাইরে রেখেই আরেকটি নির্বাচন হয়। ১৯৮৬ ও ‘৮৮ সালের নির্বাচন দুটি বিরোধী দলের অংশগ্রহণমূলক নয় বলেই তা সমালোচিত হয়েছিল। তাছাড়া নির্বাচন দুটি নানা রকম নেতিবাচকতায় ভরপুর ছিল। ফলে সংসদ দুটি পূর্ণতা পায়নি। আন্দোলনের মুখে দুই বছরের মধ্যেই তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ ভেঙে দিতে হয়েছিল। তবে সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী হচ্ছে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ষষ্ঠ সংসদ। বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাসের পর সংসদটি বিলুপ্ত করা হয়। বলা যায়, আঁতুড়ঘরেই মৃত্যু। ভোটারবিহীন, বিরোধী দলগুলোর বর্জন করা নির্বাচনটি সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এটি ছিল সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান অপরিহার্য ছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও বাম দলগুলো অংশগ্রহণে সম্মত হয়নি। তাই সেদিন বিরোধী দলের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রবর্তনের জন্য নির্বাচন হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। যদিও বিরোধী দলগুলো ওই নির্বাচন প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছিল। সে যাই হোক, আগামী ৫ জানুয়ারি আবারও বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ করা ছাড়াই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বিরোধী দল প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান যে, নির্বাচন হয়তো হয়ে যাবে।
এ নির্বাচন আগেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। প্রথমত, নির্বাচনটি বিরোধী দলের অংশগ্রহণমূলক নয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল, গণফোরাম, সিপিবি-বাসদ জোটসহ বিভিন্ন দল এটি বর্জন করেছে। কেবল ক্ষমতাসীন মহাজোট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বিরোধী দল বর্জন করায় তা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। যে কারণে এটি ইতিমধ্যে একতরফা নির্বাচন বলে সমালোচিত হচ্ছে। মহাজোটের শরিক জেনারেল (অব.) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির ‘অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে নাটক’ নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করেছে। তবে সবচেয়ে আলোচিত ব্যাপার_ ১৫৪ আসনে একক প্রার্থী। সেখানে নির্বাচন হবে না। এর অর্থ হচ্ছে, দেশের অর্ধেকের বেশি ভোটারের ভোটদানের সুযোগ থাকছে না। তাই এ নির্বাচন হবে ভোটারবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। ইতিপূর্বে এত সংখ্যক একক প্রার্থিতার আর নজির নেই। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে একক প্রার্থিতা ছিল ৪৯ আসনে। সে তুলনায় এটি নতুন রেকর্ড। আর যেসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে, সেগুলোতেও মহাজোটের শরিকদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। পার্থক্য, একজন দলের ঘোষিত আর অপরজন বিদ্রোহী। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর জন্য পার্টির দ্বার কখনও রুদ্ধ হয় না। বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে বিজয়ী হলে ফুলের তোড়া হাতে নেতা-নেত্রীর সামনে হাজির হন। তখন মহাসমারোহে তাকে বরণ করে নেওয়া হয়। এবারের নির্বাচন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছেও পরিত্যাজ্য। ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে রাজনীতির বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের যে ধরনের ভিড় দেখা যেত, এবারও এমন উৎসাহী মুখ দেখা গেল না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করছে না, জনগণ ভোট দিতে পারবে না, জনমতের প্রতিফলও ঘটবে না_ সেটিকে গণতন্ত্রের মানদণ্ডে কি সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায়?
ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কেউ না খেললে গোল তো হবেই। দোষের কী আছে? এতে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না। এটিকে সংবিধানসম্মত ও আইনসিদ্ধ দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু আইনসিদ্ধ হলেও তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, এমনকি বৈধ হয় না। ‘৮৬, ‘৮৮ ও ‘৯৬-এর নির্বাচনের রায় কার্যকর হলেও জনগণের বিবেকের কাছে বৈধতা পায়নি। এ ক্ষেত্রে বৈধতার বড় মানদণ্ড জনগণের অভিব্যক্তি।
এ সত্য ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব বোঝেন না, তা নয়। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ‘এ নির্বাচন তাদের কাছে সুখকর নয়’ বলেছেন। তবে তাদের করতে হচ্ছে। প্রশ্ন এসে যায়, এটি কি ১৯৯৬-এর মধ্য ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মতো ‘সংবিধান রক্ষার’ নির্বাচন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়ও অনুরূপ আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে নয়, বিরোধী দলের সঙ্গে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপ হতে পারে। তার কথা অনুযায়ী_ সমঝোতা হলে দশম সংসদ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু একাদশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমঝোতা হলে দশম নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা কেন সম্ভব নয়? সংসদ বিলুপ্ত করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে কি কোনো আইনগত বাধা আছে? এ পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সংবিধান না মানসিকতা_ কোনটা বাধা?
সমঝোতার ক্ষেত্রে কেবল সরকারের একগুঁয়েমি নয়। বিরোধী দলের ভূমিকাও আমাদের হতাশ করেছে। বিএনপি সমঝোতার কথা বলছে। ২৪ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সমঝোতার কথা বলেছেন। বলেছেন, রাজনীতি হচ্ছে আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। অথচ আগের তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলায় অনড় রয়েছেন। বর্তমানের বাস্তবতায় সমাধানের কথা স্পষ্ট করে বলাই কি যৌক্তিক নয়?
বিরোধী দল কি খতিয়ে দেখছে, তাদের আন্দোলন কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে? ১৮ দলের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে জনগণ সম্পৃক্ত হয়নি। নেতারাও মাঠে নামার সাহস দেখায়নি। কেবল জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা গ্যাস বোম, পেট্রোল বোম ছুড়ে মানুষ মারছে, গাড়ি পোড়াচ্ছে, বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজ করছে। বিএনপি কর্মীদের একাংশ তাদের অনুসরণ করছে। এ ধরনের নির্মম ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে কি তারা অব্যাহতি পেতে পারে? আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েমের আন্দোলনকে জামায়াতিরা যুদ্ধাপরাধী বিচার ভণ্ডুলের আন্দোলনে পরিণত করার যে কৌশল নিয়েছে, তা কি বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক?
বিলম্বে হলেও বিএনপি খানিকটা উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে নতুন করে অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি দেননি। বরং ২৯ ডিসেম্বর লাল-সবুজের পতাকা হাতে গণতন্ত্রের অভিযাত্রার কথা বলেছেন। সমঝোতার ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমঝোতা-সংলাপ করতে চাইছেন_ তবে দশম নয়, একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে। এমন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে যে, সংলাপের এজেন্ডা কি দশম সংসদ, না একাদশ সংসদ? সেটিও আলোচনার টেবিলে সমাধান হতে পারে। যদি উভয়ের উদার গণতান্ত্রিক মানসিকতা থাকে, তবে আইন কোনো বাধা নয়। সবারই মনে রাখতে হবে যে, একতরফা নির্বাচন ও আন্দোলনের নামে সহিংসতা_ কোনোটাই দেশবাসীর কাম্য নয়।