am admi partyজনগণের ইচ্ছাই রাজনীতির শেষ কথা। জনতার সমর্থনে, ভালোবাসায় ছোট দল বড় হয়। আবার জনতার ঘৃণায়-প্রত্যাখ্যানে বড় দল ক্ষয়ে যায়। প্রয়োজনে নতুন রাজনৈতিক ধারাও তৈরি করে জনগণ।
রাষ্ট্র ও ক্ষমতা থেকে দূরে অবস্থানকারী সাধারণ মানুষ, যাদের আমরা আমজনতা বলি। হিন্দি-উর্দুতে তাদের বলা হয়, আম আদমি। সেই আম আদমির সংগঠন ‘আম আদমি পার্টি’ দিলি্লর বিধানসভা নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে রাজনীতির পুরনো হিসাব-নিকাশ।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল এক সময়ের আয়কর বিভাগের কর্মচারী। আয়কর বিভাগে দুর্নীতির উৎসব দেখে ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ হয়ে চাকরি ছেড়ে নাগরিক আন্দোলনে যোগ দেন। বিগত বছরগুলোতে আন্না হাজারে যে শক্তিশালী নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলেন, তাতে শরিক হন কেজরিওয়াল। এক পর্যায়ে দিলি্লতে প্রতিষ্ঠা করেন আম আদমি পার্টি (এএপি)। দুুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন শীলা দীক্ষিত সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল এএপি। এবার অবিশ্বাস্য সাফল্য দেখাল নির্বাচনেও। এএপি নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে পেয়েছে ২৮টি, সেখানে বিজেপির আসন ৩১টি। কংগ্রেসের আসন মাত্র ৮টি। কংগ্রেসের সমর্থনে দিলি্লতে সরকার গঠনের সুযোগ এখন কেজরিওয়ালের মুঠিতে। তবে তিনি রাজি নন। তিনি আগামী সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারিতে উৎসাহী।
এএপির লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী। ভারতজুড়েই দলের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে। আসন্ন লোকসভার নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে লড়বে এএপি।
এএপি দিলি্লতে ফ্যাক্টর, তা আগেই শুনেছিলাম। গত সেপ্টেম্বর দিলি্ল ভ্রমণকালে সেখানে প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে ভারতের রাজনীতি নিয়ে কথা হয়। কেউ কেউ নরেন্দ্র মোদির আগমনী বার্তা শোনাচ্ছিলেন। তবে এমন মতও ছিল যে, কংগ্রেস ও ধর্মনিরপেক্ষ আঞ্চলিক দলগুলো মিলে মোদিকে ঠেকিয়ে দিতে পারে। কিংবা কংগ্রেস ও বিজেপির বাইরে বাম ও আঞ্চলিক দলগুলো মিলে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে উঠল এএপির কথা। দুয়েকজন মত দিলেন, এএপি বেশ ক’টি আসন পাবে। দিলি্লতে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস বা বিজেপির জন্য তাদের সমর্থন লাগবে। কিন্তু দুই মাসের ব্যবধানে নির্বাচনের রায়ে দেখছি, এএপির দিলি্লর সরকার গঠনের হিসাবে চলে এলো।
ভারতের রাজনীতিতে এএপি কতদূর এগোতে পারে_ সেটি আমার এখন আলোচ্য বিষয় নয়। আমার কাছে অনন্য শিক্ষা যে, রাজনৈতিক দলগুলো নয়, জনগণই কেবল শেষ কথা বলতে পারে। তা শাসক দলগুলোর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দিলি্লর আম আদমি।
বাংলাদেশের জনগণও নানাভাবে শাসক দলগুলোর কাছে সতর্কবার্তা পাঠাচ্ছে। কিন্তু নেতারা এতই ঊর্ধ্বমুখী যে, জনতার উত্থিত তর্জনী তাদের চোখে পড়ে না। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে হরতালের আগুনে দগ্ধ গীতা সেন প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে শুনিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনারা আমাদের তৈরি করেননি, আমরাই আপনাদের তৈরি করেছি।’ সেই অধিকার নিয়ে বলেছেন, আপনারা এক হয়ে মানুষ পোড়ানোর খেলা বন্ধ করেন। তার স্পষ্ট উচ্চারণ, আমরা অসুস্থ রাজনীতি চাই না, ভালো রাজনীতি চাই। এটি হচ্ছে বাংলার আমজনতার কণ্ঠস্বর। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর শুনতে নারাজ ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল। জনতার ভালোবাসা, সমর্থনে নয়_ জনগণকে জিম্মি করে ক্ষমতা ধরে রাখতে বা ক্ষমতা দখল করতে চাইছেন তারা।
ভোটের মালিক জনগণ, কিন্তু ক্ষমতার মালিক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তার চেয়ে সত্য, দুই দলের দুই নেত্রী। জনগণ কোথায় যাবে_ হয় আওয়ামী লীগে, না হয় বিএনপিতে। আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই বলে নেতারা মনে করছেন। ভাবখানা এমন_ আমরা আর মামুরা; এর বাইরে কেউ নেই। জনগণ এমনই দ্বিদলীয় ব্যবস্থার বৃত্তে এখন বন্দি।
দল দুটির চক্ষুশূল নাগরিক সমাজ। বিভিন্ন সময়ে নেতা-নেত্রীদের মুখে দেশের বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কেও কটূক্তি শুনছি। বলা হচ্ছে, যারা টক শো করেন, তারা কত ভোট পাবেন; পারলে ভোট করে ক্ষমতায় আসুন, তারপর কথা বলুন। পরমতঅসহিষ্ণু মানসিকতায় রাজনীতি জর্জরিত।
শাসকের দম্ভোক্তির জবাব বাংলাদেশের ইতিহাসেও আছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ ধরাকে সরা জ্ঞান করেনি। তারা ভেবেছিল, মুসলিম লীগের লয় নেই, ক্ষয় নেই। রোজ কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম লীগ থাকবে_ এমন আস্ফালনও শোনা যেত। কিন্তু ভাষা আন্দোলন সব উল্টেপাল্টে দেয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে নবগঠিত যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগ ধরাশায়ী হয়। তরুণদের কাছে মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতারা পরাজিত হন। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন হেরে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল খালেক নেওয়াজের কাছে।
আমজনতার শক্তির প্রাবল্য দেখেছি ‘৬৯ ও ‘৭১ সালে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন সমাজের নলচে ও খোল বদলে দিয়েছিল। আন্দোলনের ঢেউ কেবল শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, গ্রামবাংলায় নবজাগরণ ঘটিয়েছিল। মনে পড়ে, তখন শহরে মিছিলে মিছিলে দিন কাটে। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখি ভিন্ন এক চিত্র। গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা মাতবরদের কথায় উঠতে-বসতে হতো। ‘৬৯ সালের গণআন্দোলনের ঢেউ আমজনতার সম্মানবোধ জাগিয়ে দেয়। মাতবরকে বয়কট করে তারা। তাদের সনাতনী ক্ষমতা খর্ব করতে আমজনতা গড়ল পাবলিক পার্টি। গ্রাম-গ্রামান্তরে পাবলিক পার্টি ছড়িয়ে পড়ল। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সব পাবলিক পার্টিগুলো একত্র হয়ে ১৯৭১ গড়েছে বাংলাদেশ রিপাবলিক (পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ) অর্থাৎ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
১৯৯০ সালের কথাই ধরা যাক। পুলিশ-বিডিআর-মিলিটারি সবই এরশাদের আজ্ঞাবহ ছিল, বিদেশি শক্তির সমর্থন ছিল। সে সময়ে তিন জোট (৮ দল, ৭ দল ও ৫ দল) লড়েছিল আমজনতার বলে বলীয়ান হয়ে। যে জনতা স্বৈরাচারী এরশাদকে হটিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা তৈরি করেছে_ তারা আজ দুই দলের হানাহানির নির্মম শিকার। কখনও হরতালের আগুনে, কখনও হরতাল প্রতিরোধকারীদের চাপাতিতে প্রাণ হারাচ্ছে অসহায় মানুষ। যত্রতত্র গ্যাস বোমা-পেট্রোল বোমা ফুটছে। আগুনে ঝলসে যাচ্ছে নিরপরাধ নারী-পুরুষ ও শিশু। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে আহতদের আর্ত চিৎকার ভেসে আসছে। সেই কান্না-চিৎকার নেতা-নেত্রীদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। তারা ভারতে আম আদমির উত্থান শুনে হয়তো ভাবছে_ সেখানে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আম আদমি ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের আমজনতার সে সুযোগ নেই।
সরকার এখন একতরফা নির্বাচনের স্বপ্নে বিভোর। বিরোধী দল জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের নামে সহিংস কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও এ খেলা বন্ধ হবে না। নতুন করে শুরু হবে না সংসদ বর্জন ও হরতালের রাজনীতি _তার গ্যারান্টি কোথায়!
আসলে গোড়ায় গলদ। রাজনীতি এখানে কেবলই ক্ষমতামুখী। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সামনে কোনো আদর্শ নেই, নীতি নেই, নেই ত্যাগের মনোভাব। রাজনীতি এখন ক্ষমতালিপ্সু এক শ্রেণীর সামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীর বাণিজ্য। অধিক ক্ষমতা আর লাভের জন্য নির্বাচন বা কথিত আন্দোলনে বিনিয়োগ করছেন রাজনীতি-ব্যবসায়ীরা।
যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের বৈধতা দিতে স্বৈরাচারী এরশাদকে বশ করছে, তখন বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বাসে আগুন দিচ্ছে, রেললাইন উপড়ে ফেলছে, পুলিশের ওপর হামলা করছে। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল_ উভয় দলের নেতা-নেত্রীরা বনানী-গুলশানে বসে, নিরাপদ দূরত্বে থেকে টেলিভিশনের পর্দায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা দেখছেন।
তারা নিশ্চিত যে, ক্ষমতার এ খেলায় তাদের পরিবারের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। অনেক নেতা-নেত্রীর পরিবার-পরিজন মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, টরন্টোর ‘বেগম পাড়া’ বা সিঙ্গাপুর, লন্ডন, সিডনি, নিউইয়র্ক প্রভৃতি শহরে বাস করছে। মরছে তৃণমূলের কর্মী, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি মরছে হকার, অটোরিকশা-বাসচালক, গার্মেন্ট কর্মীসহ আমজনতা।
ক্ষমতার নীতিহীন খেলায় তারা এতই বিভোর যে, তারা বুঝতে পারছেন না_ কীভাবে জনতার অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে, সমাজদেহে নতুন জাগরণের শক্তি বিকশিত হচ্ছে।
কেউ কি জানত, কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে নতুন প্রজন্ম শাহবাগ চত্বরে ইতিহাস রচনা করবে, তাদের ডাকে সমগ্র জাতি একাত্তরের চেতনায় জেগে উঠবে। একাত্তরের চেতনায় নতুন প্রজন্ম আর আমজনতা একই পথের যাত্রী, একই স্বপ্নের সারথী। জানি না, তারুণ্যদীপ্ত আমজনতা কবে, কখন রাজনীতির নীতিহীন কুশীলবদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠবে_ সমগ্র জাতি সে জন্য অপেক্ষমাণ।