pakiযুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যখন একাত্তরের কলঙ্কমোচনে এক ধাপ এগিয়ে গেল, উৎসবমুখর পরিবেশে বিজয়ের ৪২তম বার্ষিকী উদযাপন করল, তখন নতুন করে সেই কালিমা লেপটে নিল পাকিস্তান।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও ১১ ডিসেম্বর পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসির জন্য নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। প্রস্তাবে বাংলাদেশকে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিকদের না বোঝার ব্যাপার নয় যে, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এতে তাদের নাক গলানোর কোনো অধিকার নেই। তা সত্ত্বেও জামায়াত-মুসলিম লীগ আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে জাতীয় পরিষদে এমন প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। সমর্থন দিয়েছে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম) ও জমিয়তে উলামা ইসলাম। তবে এ ব্যাপারে সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপকর্মের অন্যতম সহযোগী পাকিস্তান পিপলস পার্টি। দলটির প্রতিনিধি জাতীয় পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছেন, এটি বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী কাদের মোল্লার জন্য গায়েবানা জানাজা ও সভা-সমাবেশ করে শোক জানিয়েছে। তাকে ‘শহীদ-ই-পাকিস্তান’ আখ্যায়িত করেছে এবং বলেছে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য কাদের মোল্লা ভূমিকা রেখেছিলেন। কথাটি সত্য। তার চেয়ে বেশি সত্য, পাকিস্তান রক্ষার নামে গণহত্যা-ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। সেই সুনির্দিষ্ট অপরাধেই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ অপরাপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সমগ্র জাতি একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ। বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য আছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে কোনো ভিন্ন মত নেই। এ ব্যাপারে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ছাড়া কোনো সংগঠন আপত্তি জানায়নি। তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও মানোন্নয়নের দাবি জানিয়ে আসছে, কিন্তু বিচারের বিরুদ্ধে নয় দলটি। অথচ যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের জন্য পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর দরদ উগলে পড়ছে। কিন্তু কেন?
আসলে পাকিস্তানের এসব রাজনীতিক একাত্তরের পরাজয় ভুলতে পারেননি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তারা হয়তো ভেবেছিলেন, তাদের দোসর জামায়াতে ইসলামী একদিন শক্তি সঞ্চয় করে বাংলাদেশকে ‘মিনি পাকিস্তান’ বানাবে, একাত্তরের পরাজয়ের বদলা নেবে। সে আশায় জামায়াতকে পাকিস্তান সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসি হলো। গোলাম আযমসহ অন্য নেতারাও দণ্ডিত। তাই পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো বেসামাল হয়ে জাতীয় সংসদে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।
এমন বেসামাল হওয়ার বড় কারণ এই যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগীদের বিচারের মধ্য দিয়ে সেদিনের সব কুকীর্তি আজ বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকায় উঠে আসছে, আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। তাদেরকে মানবতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে, যা পাকিস্তানের জন্য গ্গ্নানিকর। এ গ্গ্নানি চাপা দিতে গিয়েই তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাংলাদেশকে উপদেশ দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। জামায়াতের সমাবেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ আক্রমণ করার আহ্বানও করেছে।
বলা আবশ্যক, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চাপে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও ৪২ বছর আগের অপকর্মের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। ১৯৭৪ সালের জুনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুলস্তবক দিয়ে সম্মান জানালেও প্রথা অনুযায়ী সেখানে সংরক্ষিত বইয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। অপর সামরিক শাসক জিয়াউল হক ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সফর করে সাভারে স্মৃতিফলকে মাল্যদান করেছেন। কিন্তু একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাননি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০২ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে একাত্তরের ঘটনা ভুলে যেতে বলেছিলেন। তবে পাকিস্তানের লেখক-সাংবাদিক-নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকেই ক্ষমা চেয়েছেন এবং পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার নীরব। এবার তারা জাতীয় পরিষদে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করে সরব হয়েছেন ।
দুঃখজনক হলেও সত্য, পাকিস্তান সরকারকে ক্ষমা প্রার্থনায় বাধ্য করতে যে কূটনৈতিক তৎপরতার প্রয়োজন, বাংলাদেশ তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বলা যায়, বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন থেকেছে। কখনও কখনও মনে করেছে, এতে দুই দেশের বন্ধুত্ব বিঘ্ন হবে। এটি স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, একাত্তরে পাকিস্তানের জনগণ কোনো অপরাধ করেনি। অপকর্ম করেছিল ইয়াহিয়া-ভুট্টো এবং তাদের আজ্ঞাবহ সামরিক বাহিনী। তাই সঙ্গতভাবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা-উত্তরকালে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে দিলি্লতে সম্পাদিত তিন দেশের চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানি বন্দি সৈনিকদের সঙ্গে অভিযুক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানে প্রত্যর্পণ করে। তখন পাকিস্তান সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাদের বিচার করা হবে। সে অনুযায়ী পাকিস্তান সরকার বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। সে কমিশনের রিপোর্টে তাদের কৃত অপরাধের অনেক তথ্য প্রকাশিত হয়। তখন পাকিস্তান সরকার তা ধামাচাপা দেয়। কেবল তাই নয়, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পাকিস্তান সরকার তাদের নাগরিকদের (যেসব বিহারি অধিবাসী পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিল) ফেরত নেয়নি এবং বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদের ভাগ দেয়নি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা হতাশাব্যঞ্জক। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান সরকারের ভারতের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থ আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়েছিল। সেই ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে অনশন করেছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। ভারত সরকার সেদিন পাকিস্তানকে সমুদয় প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানে মহাত্মা গান্ধীর মতো এ ন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ কেন সোচ্চার হবে না, সেটিই আজ বড় প্রশ্ন।
বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের বিচার শুরু করেছে। কাদের মোল্লার রায় কার্যকর করেছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আবদুুল আলীমের মামলা চলছে। রায়ের অপেক্ষায় আছে মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা। অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাও চলছে।
এটি বাংলাদেশের জনগণের একাত্তরের দায়মুক্তির নবঅধ্যায়, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার নতুন সংগ্রাম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সংগ্রাম কি এখানেই থেমে থাকবে? না, তা থামতে পারে না। আমাদের বহুদূর যেতে হবে। যারা লাখ লাখ নর-নারীর রক্তে হাত রঞ্জিত করেছে, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ করেছে; সেই অপকর্মের হোতা ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তার বিচারে পাকিস্তানকে বাধ্য করা, একই সঙ্গে একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, পাকিস্তানের কাছে আমাদের প্রাপ্য সম্পত্তি আদায় করা এবং এখানে চিহ্নিত পাকিস্তানিদের ফেরত পাঠানোই হবে এই সংগ্রামের অঙ্গীকার।
এটি স্পষ্ট করা দরকার, সেদিন যেসব বিহারি বাংলাদেশের নাগরিক বলে এখানে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে, কিংবা বাংলাদেশি বিহারি বংশোদ্ভূতরা যারা বাংলাদেশের প্রতি অনুগত; তারা সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের বাঙালি বা অন্য জাতিসত্তার মানুষের মতো বাংলাদেশের সমমর্যাদার নাগরিক। তাদের নিয়ে কথা নেই। কিন্তু সেদিন যারা পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে জেনেভা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের ফিরিয়ে নেওয়া পাকিস্তান সরকারের কর্তব্য।
পাকিস্তানের এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের পর কারও কারও মুখে শুনছি _ওদের কথায় কী আসে-যায়? আমাদের কাজ হবে এটিকে গুরুত্ব না দেওয়া। এ ধরনের উদাসীনতা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে ডেকে এনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবকে দুঃখজনক ও নিন্দনীয় বলেছে। এটি যথেষ্ট নয়। বরং পাকিস্তানকে জানিয়ে দিতে হবে যে, নিন্দা প্রস্তাব প্রত্যাহার ও এজন্য ক্ষমা চাইতে হবে এবং একাত্তরের অমীমাংসিত সব ইস্যুর নিষ্পত্তি করতে হবে। উভয় দেশের বন্ধুুত্বের স্বার্থেই তা জরুরি। পাকিস্তানের শাসক ও জান্তা একাত্তরে যে অপরাধ করেছে, সেজন্য বাংলাদেশ পাকিস্তানের জনগণকে দায়ী করে না। বরং আশা করে যে, উভয় দেশের বন্ধুত্বের স্বার্থে পাকিস্তানের জনগণ আমাদের ন্যায্য অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানাবে। একাত্তরে পাকিস্তানের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করেছে যে ঘাতক বাহিনী, তাদের বিচারসহ অমীমাংসিত ইস্যুতে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে পাকিস্তান নিজেকে কলঙ্কমুক্ত করবে সেটিই আজ প্রত্যাশিত।