politics-01রাজনীতিতে কৌশলের গুরুত্ব আছে। তবে যে কৌশল রাজনীতির ‘নীতি’ বিদীর্ণ করে, অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ করে_ সেটি অপকৌশল। এই অপকৌশল বা নীতিহীন কৌশল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতির বহুল ব্যবহার্য হাতিয়ার।
নীতিহীন কৌশল প্রয়োগে চমক দেখিয়েছেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ইতিপূর্বে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, একতরফা নির্বাচনে গেলে মানুষ তাকে থুথু দেবে। কিছুদিন ব্যবধানে তিনি ভোল পাল্টে বলেন, মানুষ নির্বাচনমুখী, তাই তার দল নির্বাচনে না গেলে জনগণ তাকে থুথু দেবে। সেই অনুযায়ী তার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা) নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিয়েছে, দলীয় প্রার্থীরা জমা দিয়েছেন মনোনয়নপত্র। এমন পরিস্থিতিতে তিনি নতুন চমক সৃষ্টি করেছেন। আবারও অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। ৩ ডিসেম্বর সংবাদ ব্রিফিংয়ে এরশাদ বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, এটিই তার শেষ কথা।’ অনেকে মনে করেন, এরশাদের শেষ কথারও শেষ কথা আছে। মোটেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার নয় যে, এরশাদ নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে অধিকতর সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন। অন্য খেলাও থাকতে পারে।
এরশাদের কাছে রাজনীতি নিছক ক্ষমতার খেলা। নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নেই। একদা বল প্রয়োগ করে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেছিলেন। এখন বল প্রয়োগের ক্ষমতা নেই। তাই তিনি এখন একের পর এক নীতিহীন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। নানা ছলনায় মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করছেন।
এরশাদ চিহ্নিত স্বৈরশাসক। তার ছলচাতুরীর কথা সবার জানা। তাই তাকে নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। তবে গণতন্ত্রের দাবিদাররা যে অপকৌশলের খেলা খেলছেন, সেটি আমার কাছে বেশি উদ্বেগের বিষয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি পতিত স্বৈরাচারকে নিয়ে টানাটানি করে তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। সব ফেলে আওয়ামী লীগ নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য’ করতে এরশাদকে ঘাড়ে চড়িয়ে এখন নাজেহাল হচ্ছে। আর বিএনপি জামায়াতকে পিঠে চড়িয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা ও সহিংসতার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষমতামুখী রাজনীতিকদের কোনো গ্গ্নানি নেই।
এরশাদ ‘নির্বাচনে যাবে না’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির নেতাদের কাছে ‘প্রাজ্ঞ’ রাজনীতিতে পরিণত হয়েছেন। হয়তো হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। এরশাদ সাড়া দিলে সাধু পুরুষ আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে স্বৈরাচারী। আবার এরশাদ বিএনপির জোটে বা আন্দোলনে শামিল হলে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের নেতারা তাকে স্বৈরাচারী বলে মুখে ফেনা তুলবেন। আর নির্বাচনে ফিরে গেলে এরশাদকে বলা হবে গণতন্ত্রের নিশান বরদার। যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঐক্য করার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে যখন আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল এটি কৌশলগত ঐক্য। মহাজোটে এরশাদের জাতীয় পার্টির যোগদানের ব্যাপারটাকেও কৌশলগত ঐক্য বলা হয়েছে। বিএনপিও জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে কৌশলগত ঐক্য বলছে। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের ভ্রান্ত কৌশল এসব অশুভ শক্তির আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে, শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ করে দিয়েছে; যা গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বড় হুমকি।
এ প্রসঙ্গে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ও নতুন বিষয় সংযোগের বিষয়টি উল্লেখ করতে হয়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলাটি জাতীয় ঐকমত্যের প্রতিফলন ঘটেছিল। ১৯৯১-উত্তর এ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। কিন্তু এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও দেখা দিয়েছিল। বিগত বিএনপি শাসনামলে বিচারপতি কেএম হাসানের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে তাকে এমন সময় অবসর করানো হয়, যাতে নির্বাচনকালে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বলে গণ্য হন। ফলে তার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার সূযোগ অবারিত হয়। এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। তাই সঙ্গত কারণেই বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অংশগ্রহণের সুযোগ রহিত করা প্রয়োজন ছিল। ১/১১-এর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সংকট ও আশঙ্কা দূর করার জন্য এর সময়সীমা নির্ধারণের দরকার ছিল। এমন কতিপয় কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। আইনের কয়েকটি ধারা পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল_ সেটি না করে আওয়ামী লীগ আদালতের রায়ের দোহাই পেড়ে, তড়িঘড়ি করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বাতিল করে এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করে। এটি নিঃসন্দেহে একটি অপকৌশল।
এ সংশোধনী আনার সময় পুরো রায়ও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি অবৈধ বলার পাশাপাশি ‘দুই মেয়াদের জন্য বহাল রাখা যেতে পারে’ বলে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তা অগ্রাহ্য করা হয়। এর পেছনে যে কেবল অসাধু উদ্দেশ্য কাজ করেছে তাই নয়, এ পদক্ষেপ অদূরদর্শিতারও পরিচায়ক।
যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো মহতী উদ্যোগকে সামনে রেখে প্রয়োজন দেখা দেয় মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বৃহত্তর ঐক্য গড়ার। সে ঐক্যে বিএনপিকে শামিল করানোর সার্বিক চেষ্টা করা উচিত ছিল; তা না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি করা হয়। এ কৌশল কি সমর্থনযোগ্য?
এটি লক্ষণীয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বিএনপির মধ্যে দুটি মতই ছিল। দলটি বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান ও স্বচ্ছতার কথা বলে একটি মাঝামাঝি অবস্থানে ছিল। জামায়াতকে দূরে রেখে কতিপয় কর্মসূচিও পালন করেছিল। এ পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল এবং বিএনপির জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধাদানের মাধ্যমে বিএনপিকে জামায়াতের মতো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে ঐক্য গড়ার দিকেই ঠেলে দিয়েছে, যা কোনো বিবেচনায়ই সমর্থনযোগ্য নয়।
এর মানে এই নয় যে, বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য গড়ায় বিএনপির কোনো দায় নেই। এটি বিএনপির সুবিধাবাদী ও নীতিহীন রাজনীতিরই পরিচায়ক। সাবেক জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাছাউনিতে থেকে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের এক ছাতার নিচে শামিল করেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশ গড়ার ব্যর্থতা, একদলীয় ব্যবস্থা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্তির কারণে তা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু দেশ সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। অবস্থা অনেক বদলেছে। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেদের শাণিত করেছে। ‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় বিএনপির মিছিল থেকে তরুণদের স্লোগান শুনেছি_ মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। এখন মনে হয়েছে যে, জিয়ার সৃষ্ট জগাখিচুড়ি মার্কা দলটি গণতন্ত্রের পথে, মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে আসছে। কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সব অর্জন বিএনপি ধরে রাখতে পারেনি। এরশাদের শাসনামলে বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উস্কানির বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া কেবল বিবৃতিই দেননি, রাজপথের মিছিলেও শামিল হয়েছিলেন। সেই খালেদা জিয়া ২০০৮ সালে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগে ভোট দিলে ‘আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে’ বলে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেন। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জামায়াত ও হেফাজতিদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিএনপির ঘাড়ে চড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। বলা প্রয়োজন, জিয়াউর রহমান মুসলিম লীগ-পিডিপি-জামায়াতের নেতাদের দলে ভিড়িয়েছিলেন। রাজাকার শাহ আজিজুর রহমান, আবদুল আলীমকে মন্ত্রী করেছিলেন সত্য, তবে তারা জিয়াউর রহমানের কাছে নতজানু হয়ে থাকতেন। আর এখন জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তাদের ওপর খবরদারি করছে। সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছে, বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে, রেললাইন উপড়ে ফেলছে, পুলিশের গাড়িতে আগুন দিচ্ছে, সারাদেশে অরাজক অবস্থা তৈরি করেছে_ যা আমাদের একাত্তরে পাকিস্তানি হামলা ও রাজাকারদের সৃষ্ট নৃশংসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
অপরদিকে সরকার বিরোধী দলের নেতাদের ধরপাকড়, অফিস তছনছসহ বল প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তুলছে। অথচ জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার_ সেদিকে নজর দিচ্ছে না। ক্ষমতায় থাকা আর যাওয়ার প্রতিযোগিতাই হয়ে উঠছে মুখ্য।
কোনো রাজনৈতিক দলের এমন কৌশল বা পদক্ষেপ নেওয়া সঙ্গত নয়_ যা তাদের দলের ঘোষিত নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, দলকে পশ্চাৎমুখী করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে পরিচালনার কথা বলছে, গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েমের অঙ্গীকার করছে। তা বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে সত্য। কিন্তু বিতর্কিত একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে সে লক্ষ্যে কি অগ্রসর হওয়া আদৌ সম্ভব? বলা বাহুল্য, বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারই কেবল বিতর্কিত হবে না, তার কার্যক্রমও বিতর্কিত হবে।
অন্যদিকে বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করার নামে বিএনপি যে সহিংস ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে তার কী জবাব আছে?
এভাবেই ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর কৌশলের জাঁতাকলে রাজনীতি ও সুশাসন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, জননিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে_ যা মেনে নেওয়া যায় না। রাজনীতির নামে নীতিহীন খেলা বন্ধ হোক, সমঝোতা ও সহমর্মিতার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সব সমস্যার সমাধান হোক_ দেশবাসী সেটিই আশা করে।