congoদেশের অগ্রযাত্রায় ইতিবাচক ভাবমূর্তির গুরুত্ব সমধিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আত্মপরিচয় তুলে ধরেছিল। সমগ্র বিশ্ব বিস্ময়ের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার নবজাগ্রত জাতির দিকে তাকিয়েছিল। তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল জাতির বীরত্বগাথা।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেই ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পারেনি। বাংলাদেশ পরিচিত হয়ে ওঠে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-দুর্যোগের দেশ হিসেবে। তখন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়িসহ আরও কত কী শুনতে হয়েছে। বলা যায়, শত প্রতিকূলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে স্বাধীনতার এক দশকের মাথায় বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। প্রথম সাফল্যের বীর নায়ক বাংলার কৃষক। অক্লান্ত শ্রম, ধৈর্য আর লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা সোনালি ফসল ফলাতে শুরু করেন। আর সেই ত্যাগের বিনিময়ে দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। যুবকরা মধ্যপ্রাচ্যসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে শ্রম বিক্রি করে পাঠাচ্ছেন রেমিট্যান্স। কৃষির আধুনিকীকরণেও প্রাথমিক পুঁজি জুগিয়েছে প্রবাসী শ্রমিকের কষ্টার্জিত অর্থ।
অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গ্রামবাংলার কৃষক-সাধারণ মানুষ কেবল অক্লান্ত পরিশ্রমই করেনি, উদ্ভাবনী ক্ষমতারও পরিচয় দিয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা যে শ্যালো মেশিন সেচ কাজে ব্যবহার করা হয়, সেটি দিয়ে ধান মাড়াই করা হচ্ছে, গম পিষে আটা হচ্ছে। বর্ষার সময়ে সেটি ইঞ্জিন নৌকায় লাগিয়ে ‘ভটভটি’ তৈরি করা হচ্ছে। আর শুষ্ক মৌসুমে সেটি হচ্ছে ভ্যানগাড়ির ইঞ্জিন। যখন গরিব দেশের শহরে রাজনীতিক-আমলা-ব্যবসায়ীদের অত্যাধুনিক গাড়ি পাজেরো-প্রাডো-ল্যাকসাস-হামার চলছে, তখন গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তে ছুটে চলেছে সাধারণ মানুষের উদ্ভাবিত নছিমন-করিমন। যখন এক শ্রেণীর ধনিক রাজনীতিক-আমলা-ব্যবসায়ী বিদেশে অর্থ পাচার করছেন, তখন প্রবাসী শ্রমিক বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন। বাড়াচ্ছেন জাতীয় সঞ্চয়। কৃষক-প্রবাসী শ্রমিক-গার্মেন্ট কর্মীদের সৃষ্ট উজ্জ্বল ভাবমূর্তিতে নতুন মাত্রা দিয়েছে বাংলাদেশের সৈনিক। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে তারাও আজ আলোচিত, প্রশংসিত।
গত ২৮ নভেম্বর আমার লেখার প্রথম কিস্তিতে কঙ্গো সফর এবং সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছি।
বাংলাদেশ ২৫ বছর ধরে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে শরিক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন। সততা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে জাতিসংঘের ঊর্ধ্বর্তন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি কেড়েছেন। ইতিপূর্বে কম্বোডিয়া, মোজাম্বিক, সিয়েরালিয়ন, সুদান ও লাইবেরিয়াতে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এখন সেনাবাহিনীর পাশাপাশি লেবানন, আইভরি কোস্ট ও দক্ষিণ সুদানে নৌবাহিনীর সদস্য; কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকা ও শাদে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। কঙ্গো ও হাইতিতে বাংলাদেশি নারী পুলিশরাও শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত। বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। আগামীতে বাংলাদেশ থেকে আরও শান্তিরক্ষী নেওয়া হতে পারে।
অবস্থান ও সংখ্যা বিবেচনায় নয়, বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা কর্মনিষ্ঠ ও পেশাদারিত্বের যে পরিচয় দিচ্ছেন, সেটি আমাদেরও গর্বের বিষয়। সেই সঙ্গে আমাদের গর্বিত হওয়ার আরও কারণ, তারা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন। এর আগের কিস্তিতে কঙ্গোতে বাংলাদেশের সৈনিকদের অর্জনের কথা বলেছি। লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট, সিয়েরালিয়ন, সুদানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সুনাম অর্জন করেছেন। পেশাদারিত্বের পাশাপাশি সেসব দেশে বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে পরিচিত করেছেন। ওইসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের ভিত রচনা করে চলেছেন তারা।
আমরা জানি না, শান্তিরক্ষীরা যেসব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ রচনা করেছেন, বাংলাদেশ তা অব্যাহত রাখতে পেরেছে কি-না। বাংলাদেশের স্বার্থে এ সম্পর্ক রক্ষা করা যে জরুরি, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতা দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই উন্নতির মোক্ষম পথ। তাই শান্তিরক্ষীদের মাধ্যমে সৃষ্ট বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বাস্তবে তা কতটুকু করছে?
সংশ্লিষ্ট দেশগুলো অর্থাৎ যেসব দেশে শান্তিরক্ষীরা কাজ করেছেন বা এখন করছেন, সেখানে নতুন কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সুযোগ আছে কিনা_ তা খতিয়ে দেখা দরকার। এ প্রসঙ্গে কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসার কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে শান্তি মিশনে কর্মরত সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনা কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশের বেশ কিছু শ্রমিক কাজ করছেন। কর্মসংস্থান ছাড়াও কৃষি ও গার্মেন্টসহ অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ আছে বলে অনুমিত হচ্ছে। যে কারণে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা কিনসাসায় সফর করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো তৎপরতা আছে বলে শোনা যায়নি।
আফ্রিকায় বিস্তর জমি আছে। কিন্তু সেখানে কৃষির আধুনিকায়ন ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে সমকালে গত বছরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আশার আলো দেখেছিলাম। ২১ নভেম্বর ২০১২ প্রকাশিত ‘আফ্রিকায় কৃষিকাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, “আফ্রিকা মহাদেশের তাঞ্জানিয়ায় কৃষিকাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ। ‘ভাটি বাংলা এগ্রোটিক’ নামে বাংলাদেশি একটি কোম্পানি দেশটিতে পরীক্ষামূলকভাবে চাষাবাদ শুরু করেছে। সেখানে ৩০০ একর জমিতে তরমুজ, রসুন, কাসাবা, গম প্রভৃতি চাষ করা হচ্ছে। দক্ষিণ সুদান, উগান্ডা, লাইবেরিয়া, ঘানা, সেনেগাল, আইভরি কোস্ট, কেনিয়া প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশ কৃষিকাজ শুরু করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে দক্ষিণ সুদানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কৃষিকাজ করবে বাংলাদেশ। অন্য দেশগুলোতে কৃষিকাজ পরিচালনা করবে বেসরকারি কোম্পানি।” ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ আছে, ‘বেসরকারি খাতের নিটল-নিলয় গ্রুপ উগান্ডায় ১০ হাজার হেক্টর জমি লিজ পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছে দেশটির কাছ থেকে। তার জন্য আগামী তিন বছর ১০ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছে তারা। এই অর্থ ট্রাক্টর ক্রয়, জমি নিড়ানি, বীজ ক্রয় ও সার ক্রয় খাতে কাজে লাগানো হবে। প্রস্তাবটি বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যালোচনা করে দেখছে।’
বলা আবশ্যক, বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে আইনি বাধা আছে আজকের বাস্তবতায় সেটি দূর হওয়া দরকার। স্বাধীনতার পর তখনকার বাস্তবতায় দেশের পুনর্গঠনের স্বার্থে বিদেশে বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। আজ বাংলাদেশে গার্মেন্ট, ওষুধ, সিরামিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে। সংশ্লিষ্টদের জন্য সুস্পষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হলে সেটি হবে মঙ্গলজনক।
কঙ্গোর ওরিয়েন্টাল প্রদেশের বুনিয়া ও বোগরোতে দেখলাম, কৃষি এখনও পুরনো পদ্ধতিতে রয়েছে। অন্যান্য আফ্রিকান দেশেও পিছিয়ে আছে কৃষি। তাই মনে হয়_ বাংলাদেশের কৃষকের অভিজ্ঞতা আফ্রিকায় নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে পারে।
আমরা আনন্দিত, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক কর্মকর্তারা ভেবেছেন। তবে সমস্যা হচ্ছে, ভাবতে ভাবতে সময় চলে যায়। শুরু করলে তার ফলোআপ থাকে না। এ ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে কেনিয়ায় নিযুক্ত হাইকমিশনার ওয়াহিদুর রহমানকে উদ্বুদ্ধ করে সে তৎপরতার কথা শোনানো হয়েছিল, তা খুব একটা এগোয়নি বলে শুনেছি। কেবল আফ্রিকা নয়, মিয়ানমারে কৃষিতে বিনিয়োগের সুযোগ আছে। আফ্রিকার ব্যবসা-বাণিজ্যেও বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সুযোগ আছে। কিনসাসায় ভালো রেস্তোরাঁ মানে ভারতীয় রেস্তোরাঁ। কঙ্গো নদীর তীরে হ্যারি রেস্তোরাঁয় বসেই শুনলাম, ভাগ্যান্বষণে আসা এক ভারতীয়ের এটি গড়ে তোলার গল্প। কিনসাসায় বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিক ভারতীয়। উগান্ডার সুবৃহৎ ‘ক্রাউন ব্যাংকে’র মালিক ভারতীয়। কঙ্গো, উগান্ডাসহ গোটা আফ্রিকাজুড়ে ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের নানা ব্যবসা-বাণিজ্য। চীন পণ্য, পুঁজি ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ার মধ্য দিয়ে আফ্রিকায় দাপটের সঙ্গে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের অবস্থান চীন ও ভারতীয়দের পর্যায়ে নয়। তবে আফ্রিকায় বাংলাদেশের জনবল রফতানি ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্র স্থান করে নিতে পারে, সে উদ্যোগ গ্রহণের এখনই উপযুক্ত সময়।
সংশ্লিষ্ট দেশের বন্ধুত্বকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক যোগাযোগের বিষয়টি ভাবা দরকার। বাংলাদেশের যেসব শান্তিরক্ষী কাজ করছেন, তারা তাদের মতো করে বাংলাদেশের সংস্কৃতি তুলে ধরছেন। সেখানে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দল সফর করতে পারে, বাংলাদেশের ছবি দেখানো যেতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক, সিয়েরালিয়ন বাংলাকে সরকারি ভাষা করেছে। সেক্ষেত্রে আমাদের কি করণীয় নেই? বাংলাদেশ সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সিয়েরালিয়নের দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য অনুদান দিতে পারে। সেখানকার কিছু শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়ে বাংলাদেশে এনে বাংলাভাষা রপ্ত করার সুযোগ দিতে পারে।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীসহ প্রবাসীরা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছেন, ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন_ তা এগিয়ে নেওয়ার জন্য কূটনৈতিক-সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। এভাবেই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও ভাবমূর্তি হতে পারে আরও দ্যুতিময়। [সমাপ্ত]
কঙ্গো থেকে ফিরে