জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সৈনিকদের কর্মতৎপরতা বহুল আলোচিত। নানা দেশের শান্তি মিশন থেকে ফিরে আসা কর্মকর্তা ও সেনাদের কাছ থেকে গল্প শুনেছি। সংবাদপত্রে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এবং বর্তমান মহাসচিব বান কি মুনের প্রশংসাসূচক বক্তব্য পড়েছি। এবার কাছ থেকে দেখার জন্য মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর শান্তিযুদ্ধের ময়দানে আমরা হাজির।
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ওরিয়েন্টাল প্রদেশ। সে প্রদেশের শহর বুনিয়া। শহর না বলে জনপদ বলাই যথার্থ। এখানে বাংলাদেশের কর্মরত ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের সামনে গাড়ি থামতেই দেখি_ দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন তরুণ-কিশোর। তাদের কথা শুনে চমকে উঠলাম। স্পষ্ট বাংলায় আমাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। বলল, কী খবর বন্ধু? বললাম, ভালো, তোমরা কেমন আছ? প্রায় সমস্বরেই জবাব এলো_আমরা ভালো না।
বিদেশের মাটিতে সে দেশের মানুষের মুখে মাতৃভাষায় কুশল বিনিময় করার আনন্দে উদ্বেলিত হলাম। কিন্তু সে আনন্দ নিমিষেই কেটে গেল। যখন শুনলাম, ওরা ভালো নেই। এটি এই ক’জন তরুণ-কিশোরের কথা নয়, যেন সমগ্র কঙ্গো জনগোষ্ঠীর যন্ত্রণাদগ্ধ কণ্ঠস্বর।
কঙ্গো এক ভূস্বর্গের নাম। আয়তনে বাংলাদেশের ১৮ গুণ। লোকসংখ্যা বড়জোর সাড়ে সাত কোটি। উর্বর জমি, বীজ ফেললেই ফসল ফলে। আর মাটির নিচে ছড়ানো আছে তাম্র, রৌপ্য, স্বর্ণ, হীরক, পেট্রোলিয়াম, ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম আরও কত কী! সেই দেশের মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও অশিক্ষার চরম শিকার। বুনিয়া, বোগোরোতে দারিদ্র্যপীড়িত নর-নারী দেখেছি। অনেকের নির্দিষ্ট কাজ নেই। কাসাবা নামক এক ধরনের আলু তাদের খাদ্য। সেগুলো চাষ বা সংগ্রহ করে ক্ষুধা নিবারণ করে বেঁচে আছে কায়ক্লেশে। স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার তেমন ব্যবস্থা নেই। শিশু-কিশোরদের লক্ষ্যহীনভাবে ছোটাছুটি। এর মধ্যে উদ্যমী তরুণদের দেখা যায়, মোটরসাইকেলের পেছনে নানা পণ্যের বোঝা নিয়ে ছুটছে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে বিক্রি করছে। বাইসাইকেল আছে। পাহাড়ি পথে সেটি উপযোগী নয়। মোটরসাইকেলই লাগসই। সড়ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। মাটির রাস্তাই ভরসা। তবে লাল মাটির এসব রাস্তা বেশ পোক্ত। এ রাস্তাতে মোটরসাইকেল, ট্রাক ও জিপ চলাচল করে।
আমোদপ্রিয় মানুষ। তরুণ-কিশোররা খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত। হাতে হাতে রেডিও। নানা খেলার ধারাবিবরণী শুনছে। সন্ধ্যায় পুরুষরা গান-বাজনা, সেই সঙ্গে মদ-মাদক নিয়ে মেতে ওঠে। ম্যালেরিয়া, ইউলো ফেভার, এইডস আর গৃহযুদ্ধে মানুষ সর্বস্বান্ত। মরণব্যাধি ও সংঘাত কেড়ে নিয়েছে বা নিচ্ছে অগণিত মানুষের জীবন। তাই এখানে বৃদ্ধ লোকের সাক্ষাৎ মেলা ভার। কঙ্গোতে নারীরা সর্বংসহা। সন্তানদের লালন-পালন, ভরণপোষণ, শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছু নিয়ে তাদের অষ্টপ্রহর সংগ্রাম।
সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও ষড়যন্ত্রের শিকার কঙ্গোবাসীদের চোখ-কান খোলা। তারাও এগিয়ে যেতে চায়। তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় মাটি ও সম্পদের ওপর তাদের অধিকার। কিন্তু কী করে সম্ভব? বর্তমান কঙ্গোবাসীর পূর্ব প্রজন্মের কমিউনিস্ট নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা_ যিনি জাগরণী গান গেয়েছিলেন, বেলজিয়াম ঔপনিবেশিকদের বিতাড়নের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে কঙ্গো স্বাধীন হলো। কিন্তু বন্ধ হলো না ষড়যন্ত্রের হাত। সেই অদৃশ্য হাতের থাবায় নিভে যায় সংগ্রামী নেতা লুমুম্বার প্রাণপ্রদীপ। যদিও তখন বিশ্ববাসী শুনেছিল যে, বিমান দুর্ঘটনায় লুমুম্বা মারা গেছেন। অচিরেই প্রকাশ পেয়েছিল, তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সুচতুর সামরিক স্বৈরশাসক সবকিছুই দীর্ঘকাল ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। আজ সেই মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে কথা হচ্ছে। লুমুম্বার মৃত্যুর পর তার অনুসারী লরেন্ট কাবিলা দেশান্তরী হতে বাধ্য হন। ১৯৯৭ সালে কাবিলার মিলিশিয়া বাহিনী এএফডিএল উগান্ডা, রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডির সেনাবাহিনীর সমর্থনে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বীরদর্পে কিনসাসায় পেঁৗছায়। অবস্থা বেগতিক দেখে পালিয়ে যান জেনারেল মবুতু। প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হন লরেন্ট কাবিলা। মবুতুর ৩২ বছরের শাসন আর লুণ্ঠনের অবসান হলো; কিন্তু স্বস্তি এলো না। প্রতিবেশীদের আধিপত্য বজায় রাখার চক্রান্ত রুখে দাঁড়ান কাবিলা। পরিণতিতে রহস্যজনকভাবে নিহত হন কাবিলা। এভাবে সমাপ্ত হয় কাবিলার বহুমুখী উদ্যোগ। এখন দেশের হাল ধরে আছেন তারই দত্তকপুত্র যোসেফ কাবিলা।
যোসেফ কাবিলার শাসন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে শান্তি ও স্বস্তি দিতে পারেনি। পারেনি উন্নত জীবনের পথে এগিয়ে দিতে। তদুপরি রয়েছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে জমি ও সম্পদ নিয়ে বিরোধ। দারিদ্র্যপীড়িত এ দেশে রয়েছে অনেক ধনকুবের। কিনসাসাতে তাদের প্রাসাদোপম বাড়ি। ছুটে চলে অত্যাধুনিক গাড়িতে। ইউরোপ-আমেরিকায় কাটে তাদের বিলাসবহুল জীবন। ধনী আর গরিব, শহর আর গ্রামের মধ্যে অনেক ব্যবধান। এটিও জুনিয়র কাবিলা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তা সত্ত্বেও লুমুম্বা-কাবিলার উত্তরসূরি হিসেবে প্রেসিডেন্ট যোসেফের গ্রহণযোগ্যতা আছে। তবে সক্রিয় ষড়যন্ত্রের অনেক লম্বা হাত। যাদের হাতের কারসাজিতে সংঘটিত হচ্ছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। বিঘি্নত হচ্ছে জনজীবন।
সবচেয়ে সংঘাত ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ওরিয়েন্টাল প্রদেশ। এখানে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হেমা জনগোষ্ঠী। পিছিয়ে থাকা লেন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে ফ্রন্ট ফর রেসিসট্যান্স অব ইতুরি (এফআরআই)_ এটি লেন্দু ন্যাশনালিস্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের সহযোগী। এর বাইরেও আছে আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র গ্রুপ। লেন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা যে সবাই এই ফ্রন্টের কর্মকাণ্ডের সমর্থক, তা নয়। তবে হেমাদের প্রতি শাসন-প্রশাসনের পক্ষপাতের অভিযোগ সবারই।
পরিস্থিতির নির্মম শিকার সাধারণ মানুষ। বিদ্রোহী মিলিশিয়া ও সেনাবাহিনী (এফএআরডিসি) উভয়ের বিরুদ্ধেই জনগণের অনেক অভিযোগ। বিদেশিরা তাদের চক্ষুশূল। বিদেশিদের সব কঙ্গোলীয় সন্দেহের চোখে দেখে। তাদের দুর্ভোগ ও দারিদ্র্যের জন্য বহিঃশক্তিকে দায়ী করে। তাই বিদেশি দেখলেই তারা গালি দেয়, বিদেশিদের গাড়িতে ঢিল ছোড়ে।
সেই জনপদের একাধিক স্থানে ‘কী খবর বন্ধু?’ সম্ভাষণ শুনতে পারার সৌভাগ্য আমাদের আপ্লুত করে। বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের কর্মকর্তা ও সৈনিকদের কাছে জানতে চাইলাম, তারা কী করে ক্ষুব্ধ কঙ্গোলীয়দের মন জয় করেছে। সবাই একই কথা বলেছেন, তারা ভালোবাসার অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। ২০০৫ সালের দুটি ঘটনায় বিদ্রোহী মিলিশিয়াদের হাতে ৯ বাংলাদেশি সেনা প্রাণ দেওয়ার পরও তারা শান্ত থেকেছে। ভালোবাসায় অস্ত্র গুটিয়ে মারণাস্ত্র দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করেনি, যা বাংলাদেশের সেনাদের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এফএআরডিসি ও এফআরআইর মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ভীকভাবে এগিয়ে যায় বাংলাদেশের শান্তি সেনারা। জনগণের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা করাই তাদের ব্রত।
বাংলাদেশের সেনারা কঙ্গোলীয়দের বলেছে_ সুদীর্ঘ বিদেশি শাসন-শোষণ বাংলাদেশকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। তাই তাদের ব্যথায় তারাও সমব্যথী। বাংলাদেশি সেনারা কঙ্গোলীয়দের কণ্ঠে গান শুনে তা নিজেদের কণ্ঠে ধারণ করেছে। আর কঙ্গোলীয়রা শিখেছে বাংলা গান ও বুলি। এইভাবে বাংলাদেশি সেনাদের কাছ থেকে সিয়েরালিয়নের মানুষ বাংলা ভাষা রপ্ত করেছে। এখন বাংলা সে দেশের অন্যতম সরকারি ভাষা।
ভাষা ও সংস্কৃতির এই লেনদেনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে দুই দেশের মানুষের বন্ধুত্ব। বুনিয়া, বোগোরো ও মাহালিতে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে পানির রিজার্ভার তৈরি করে দিয়েছে। স্কুলঘর নির্মাণ করেছে। ছেলেদের উপহার দিয়েছে ফুটবলসহ খেলার সরঞ্জাম। বুনিয়াতে ২০১২ সালে কঙ্গোর ৫০তম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরাও উদযাপন করেছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ বাহিনী বুনিয়ার কেন্দ্রস্থলে পাথর ও সিমেন্ট দিয়ে গড়ে দিয়েছে কঙ্গোর স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য। পাথরের ফলকের ওপর ডানা মেলা দুটি কবুতর। স্থানটি এখন পায়রা চত্বর বলে পরিচিত।
মাহালিতে একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক গড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন। এ ছাড়া মাঝে মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় মেডিকেল ক্যাম্প। সেখানে নারী ও পুরুষের লম্বা লাইন। দিন গড়িয়ে যায়, শেষ হয় না। পরদিনও আবার ক্যাম্প করতে হয়। তাই বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের কাছে সৈনিকদের নিজস্ব কোনো চাওয়া-পাওয়ার কথা বলতে শুনিনি। বরং তারা স্থানীয়দের জন্য আরও বেশি ওষুধ ও উন্নয়নমূলক সহযোগিতার আবেদন করেছে।
এ ক্ষেত্রে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নগুলোর নিজস্ব উদ্যোগ। নিজেদের খরচ কমিয়ে তারা সেবাধর্মী কাজ করছে। বিস্কুটসহ খাবারসামগ্রী বাঁচিয়ে তা দুস্থ শিশুদের মুখে তুলে দিচ্ছে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্পের মতো। ভিন দেশের এক শিশুকন্যার মধ্যে নিজের কন্যাকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনা।
কেবল ইতুরিতে নয়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সদস্যরা বুনিয়া ও কিনসাগানি বিমানবন্দরের পরিচালনা ও নিরাপত্তা বিধানে মোতায়েন রয়েছে। রাজধানী কিনসাসাতেও রয়েছে নারী সদস্যের একটি দলসহ পুলিশ সদস্যরা। অন্যান্য ব্রিগেডেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত।
এমন প্রশ্ন_ বাংলাদেশসহ নানা জাতির শান্তি তৎপরতা কঙ্গোর জনজীবনে কতটুকু শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে? যারা গৃহযুদ্ধ জিইয়ে রেখে কঙ্গোর মূল্যবান খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন অব্যাহত রেখেছে_লুটেরাদের সেই লম্বা হাত কীভাবে নিষ্ক্রিয় হতে পারে_ সেটি আজ বড় প্রশ্ন। সে জবাব কঙ্গোর রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই খুঁজতে হবে। বলা বাহুল্য, বহিঃশক্তির লুণ্ঠনের হাতগুলো নিষ্ক্রিয় না হলে কঙ্গোতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সুদূরপরাহত। এ ক্ষেত্রে কঙ্গোর সমব্যথী হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো অভিপ্রায় নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তে স্নাত বাংলাদেশের পতাকাবাহী সেনারা মানবিক চেতনায় সেবা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমে নিবেদিত হতে পারে।
কম্বোডিয়া, মোজাম্বিক, সিয়েরালিয়ন, সুদান, লাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করার মধ্য দিয়ে সৈনিকরা বাংলাদেশের যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, সংস্কৃতির যে সেতুবন্ধ রচনা করেছে এবং করছে_ সেটিই আমাদের বড় অর্জন।
কঙ্গো থেকে ফিরেcongo