constituent assemblyআইনের কোনো চিরায়ত রূপ নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশের ধারায় তা সদা পরিবর্তনশীল। সেটি বিবেচনায় রেখে আইনের উদারনৈতিক ব্যাখ্যাই সর্বোত্তম। তবে বিশ্লেষণের জন্যও আইন প্রণয়নের পটভূমি ও প্রণেতাদের দৃষ্টিভঙ্গিও খতিয়ে দেখা দরকার। তাই ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত তথ্যাদি (hansard) পর্যালোচনা করেই আইনি ব্যাখ্যা করা হয়। এটি আমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য।
সংবিধান প্রণয়নকালে গণপরিষদে যে আলোচনা-সমালোচনা (গণপরিষদ বিতর্ক) হয়েছিল, সেটিকে এক ধরনের হ্যানসার্ড হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এমন চিন্তা মাথায় রেখে গণপরিষদ বিতর্কের (১৯৭২) কার্যবিবরণীতে চোখ বুলিয়েছি। বুঝতে চেয়েছি, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি সংবিধান প্রণেতারা কীভাবে দেখেছিলেন?
এ নিয়ে গণপরিষদ অধিবেশনে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। সে সময় সংবিধান প্রণেতারা বক্তব্যের পক্ষে নানা যুক্তি দিয়েছিলেন। ভিন্নমতও পোষণ করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে গণপরিষদ সদস্য মো. আবদুল আজিজ চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের মধ্যে সম্পর্ক ও ক্ষমতার পরিধি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। এর একটি অংশ_ ‘৫৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সংসদের নিকট মন্ত্রিসভা দায়ী থাকবেন। কিন্তু ৫৭ নম্বর অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা এক ব্যক্তিকে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে।’
অন্য দলের জনৈক মাননীয় সাংসদ বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করার জন্য এটা করা হয়েছে।
মাননীয় স্পিকার স্যার, বঙ্গবন্ধু সবসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্য না-ও হতে পারেন। তখন যদি এমন কোনো সদস্যের হাতে ক্ষমতা অর্পিত হয় যিনি ক্ষমতালোভী, তাহলে ৫৭ নম্বর অনুচ্ছেদের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সেই ব্যক্তির হাতে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটবে। তাই আমার বক্তব্য হলো, এই ৫৭ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতার অপপ্রয়োগের ফলে সুষ্ঠু গণতন্ত্র বিকাশের পথে এই ব্যবস্থা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
জনাব স্পিকার সাহেব, এতে সংসদের অধিকার এবং গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এক ব্যক্তির শাসনকে সুনিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এই সংবিধানে।
৫৭ নম্বর অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার অবস্থায় যে কোনো সময় প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। এটি অগণতান্ত্রিক।
আবার এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে গেলেও প্রধানমন্ত্রীরা স্ব-স্ব পদে বহাল থাকবেন। এর অর্থ : ‘গাছের গোড়া থাকবে না, অথচ গাছ থেকে যাবে। এটি কোনো গণতান্ত্রিক দেশে থাকতে পারে না।’ (পরিষদ বিতর্ক ৪১৬-১৭ পৃষ্ঠা)। এ বক্তৃতায় মো. আবদুল আজিজ চৌধুরী সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। সে আলোচনা আজ থাক। বরং আলোচনার প্রয়োজনে জনাব চৌধুরীর বক্তব্য থেকে আরও কিছুটা উদৃব্দত করা যায়_ ‘আগামী দিনে যে সদস্য আসবেন, সংসদে যে মাননীয় প্রতিনিধিরা আসবেন সেই পরিপ্রেক্ষিতে যদি কোনো যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে বা বিভিন্ন দলের মাধ্যমে কোনো মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে এমন হতে পারে। ফলে যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনি হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হবেন। হয়তো তিনি নিজে ব্যক্তিত্বের বলেও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় এমন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। যার ফলে নির্দেশ থাকার পরও অন্যান্য মন্ত্রী নিয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। যেখানে অন্যান্য দল যদি যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে সনি্নবেশিত থাকে, সেই অবস্থায় দলের সদস্য হয়তো মন্ত্রী থাকতে পারেন।
পরিষদে সেই অবস্থায় এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হবে যে, যে উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে, তা সফল হবে না। তাই সংসদ সদস্যদের আবার অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সদস্যপদ বহাল থাকার যে ব্যবস্থা করা হচ্ছে তাতে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দেওয়া হবে।
সে জন্য আমি আমার বক্তব্যের সমর্থনে বলতে চাই যে, দফাটি [৫৬ অনুচ্ছেদের (৪)] বর্জন করা হোক। (পরিষদ বিতর্ক ৫১২-১৩ পৃষ্ঠা)। এ বক্তব্যের জবাবে সে সময়ের আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন যে বক্তব্য দেন তা প্রণিধানযোগ্য। মাননীয় সদস্য আবদুল আজিজ চৌধুরী সঠিক ব্যাখ্যা দেননি এই দফার। কেননা, কোন পরিস্থিতিতে এই দফা এসেছে, তা তার জানা নেই। তিনি এটা বুঝতে পারবেন যদি ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফা তিনি দেখেন। এখানে সুস্পষ্ট করে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আমি উক্ত দফাটি আপনার অনুমতি নিয়ে পড়ে শোনাচ্ছি : “(৩) সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে
(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং (খ) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে_; তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ উক্ত উপ-দফায় উলি্লখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ-সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।”
এই ৯০ দিনের যে কথা এখানে বলা হয়েছে, সেই ৯০ দিনের মধ্যে যদি প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে যায়, তাহলে ওই ৯০ দিনের জন্য যারা সংসদ সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে একজনকে নেওয়ার বিধান করা হয়েছে। সেই ৯০ দিনের জন্য একটি বিধান করা হয়েছে এবং ওই ৯০ দিন পরে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ সময়ের জন্য কোনো একজন উপযুক্ত লোককে নিযুক্ত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যদি পদে ইস্তফা দেন অথবা মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তখনও প্রেসিডেন্টকে কোথাও থেকে একজনকে নিযুক্ত করতে হচ্ছে।
সেই ৯০ দিনের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, যে সংসদ ভেঙে গিয়েছে, সেই সংসদের মধ্য থেকে একজনকে ৯০ দিনের মেয়াদে অথবা ৫০ দিন, ৩০ দিন_ যাই হোক, নিযুক্ত করা সাময়িক ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটাকে caretaker government বলা হয়। এই ৯০ দিনের মধ্যে এই শাসনভার কোনো একজনকে নিতে হবে। এখানে বলা হয়েছে যে, সংসদ সদস্যের মধ্য থেকে একজনকে নিতে হবে। এখানে অগণতান্ত্রিক কিছু নেই এবং সন্দেহেরও কিছু নেই।
আমার মনে হয়, তিনি যদি প্রস্তাবটিকে ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন ভালোভাবে। সংশোধনীটির প্রয়োজন এখানে আছে বলে মনে হয় না। অতএব এই সংশোধনী গ্রহণ করতে পারছি না। (পরিষদ বিতর্ক ৫১৩ পৃষ্ঠা)। এ ক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেনের আরেকটি বক্তব্য প্রাসঙ্গিক। সেটি হচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্রে এটাই নিয়ম যে, caretaker government
হিসেবে বা caretaker government হিসেবে ৯০ দিন কাজ চালিয়ে যাবেন। কিন্তু তারপর ৯০ দিনের মধ্যে ভোট হয়ে গেলে যারা আসবেন, তারা শাসনভার গ্রহণ করবেন। আর তিনি যেটা করতে বলছেন, সেটা কোনো দেশেই যে পাওয়া যাবে না, কোনো সংসদীয় গণতন্ত্রেই যে পাওয়া যাবে না, আমি তা জোর গলায় বলতে পারি। ব্যতিক্রম যেখানে দুই-একটা আছে, সেখানেও এটা পাওয়া যায় না। কেননা, সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম হলো যে, মন্ত্রিসভা ভেঙে যাওয়ার ফলে ৯০ দিনের জন্য যে caretaker government-এর নিয়ম আছে, সেই caretaker government
সেই ৯০ দিনের মধ্যে কোনো রকম মৌলিক নীতির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। সব দেশেই এই নিয়ম পাওয়া যাবে। (পরিষদ বিতর্ক ৫৫৯ পৃষ্ঠা)।
উল্লেখ্য, ড. কামাল হোসেনের এই ব্যাখ্যা তার একক চিন্তার প্রতিফলন নয়, এটি খসড়া সংবিধান কমিটির বক্তব্য, যা গণপরিষদ সদস্যদের দ্বারা সমর্থিতও বটে। এই ব্যাখ্যার আলোকে কতিপয় সিদ্ধান্তে স্থির হওয়া যায়। প্রথমত, নির্বাচনকালীন সরকার চেতনাগতভাবে নির্বাচিত সদস্যদের কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফলে এ সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তাই সাময়িক সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর অর্পিত সব ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে না।
দ্বিতীয়ত, ১২৩-এর (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সময়কাল সীমায়িত। তাই ৫৭ অনুচ্ছেদের (৩) অনুযায়ী উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বপদে বহাল থাকার বিষয়টি অনির্দিষ্টকাল বলে পরিগণিত হবে না। তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী ইস্তফা দিলে সংসদ সদস্যদের থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রী করার ক্ষেত্রে সংবিধান বাধা নয়।
সংবিধানের ৫৬, ৫৭, ৭২ এবং ১২৩-এর (৩) অনুচ্ছেদ এবং সংবিধান প্রণেতাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী সংবিধান বর্ণিত সব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন না। একই সঙ্গে এ বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী ইস্তফা দিলে সাংবিধানিক সংকট তৈরির যে কথা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়।
তাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংবিধান সংশোধন না করেও সর্বদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা বিবেচনা করা যেতে পারে। সেটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্বে রেখে না অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে করা হবে_ সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতায় আসা প্রয়োজন।
আমার এ অভিমতের মানে এই নয় যে, আমি বিরোধী দলের দলনিরপেক্ষ সরকারের প্রস্তাব নাকচ করছি। আজকের বাস্তবতায় এটি বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনাযোগ্য বলে মনে করছি।
সব ফর্মুলার ক্ষেত্রেই মনে রাখা দরকার, স্থায়ী সমাধানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর ক্ষমতায়ন এবং নির্বাচনকালীন সরকারের ক্ষমতা যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।