sonkhaloghuআমরা দাবি করি, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশেরই ঘটনা। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার কারণে দশম শ্রেণীর ছাত্র রাজীব সাহা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীর টার্গেট। এখন জন্মভূমিই তার কাছে সবচেয়ে অনিরাপদ স্থান।
২ নভেম্বর একদল লোক পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে রাজীবের বাবা বাবলু সাহার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তার ছেলেকে হাজির করতে বলে। কী অপরাধ রাজীবের?
রাজীবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে ফেসবুকে মহানবীর (সা.) নামে কটূক্তি করেছে। বাবলু সাহা তার ছেলেকে হাজির না করায় এ উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা ঢাকা-পাবনা সড়কের ওপর গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ তৈরি করে। ফেসবুকে মহানবীর (সা.) বিকৃত কার্টুন দেখিয়ে স্থানীয় জনগণকে উত্তেজিত করে। এক পর্যায়ে তারা বাবলু সাহার দোকান ভাংচুর করে। সাহাপাড়ায় তার বাড়িতে ভাংচুর ও অগি্নসংযোগ করে। ভাংচুর ও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ওই এলাকার ২০-২৫টি হিন্দু বাড়ি ও দুটি মন্দিরে। সেখানে ভগ্নস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে নর-নারী আর্তনাদ করছে। ফরিয়াদ জানাচ্ছে সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে। কী জবাব দেবে রাষ্ট্র ও সমাজ?
ঘটনাটি যে ষড়যন্ত্রমূলক তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ৩ নভেম্বর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে জানা যায়, যে ফেসবুক পাতার ফটোকপি দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে রাজীবের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সেপ্টেম্বরে রামুতে জনৈক উত্তম বড়ূয়ার বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ আনা হয়েছিল, তদন্তে তা প্রমাণিত হয়নি। সেটি ছিল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করার এক হীন চক্রান্ত। রামুর পর সাঁথিয়ায় একই চক্রান্তের পুনরাবৃত্তি হলো।
ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তান আমলে কোরআন শরীফ পোড়ানো হয়েছে বা ‘দেবীর মূর্তি ভেঙেছে’ বলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করা হতো। আজ সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের কৌশল বদলেছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করছে। এসব দুর্বৃত্ত যেমন ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতায় তাড়িত হচ্ছে, তেমনি হীন রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
রামুতে আমরা কী দেখেছি? তদন্ত ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে_ জামায়াতে ইসলামী ও মৌলবাদী শক্তিই কলকাঠি নেড়েছে। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তৈরি করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভিড়িয়ে একযোগে অপকর্ম করেছে।
সাঁথিয়াতেও বিএনপি-জামায়াতের স্থানীয় কর্মীরা ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন রাজীবের বাবা বাবলু সাহা। বলা বাহুল্য, এখানে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সংশ্লিষ্টতার কথা শোনা না গেলেও তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করেনি।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে বিভিন্ন মহলের রাজনীতির স্বার্থ কাজ করে। ব্রিটিশ ভারতে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। যার পরিণতিতে সংঘটিত হয়েছিল কতিপয় রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে জনগণের আন্দোলন বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছিল একাধিকবার। স্বৈরাচারী এরশাদকে আমরা এমন কৌশল নিতে দেখেছি। ‘৮৯ ও ‘৯০ সালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে সরকারের মদদ ছিল। এমন ঘৃণ্য পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কিন্তু সে সময় তিন জোটের প্রতিরোধের মুখে তা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীরা। আজ সেই প্রতিরোধ শক্তি দেখছি না। বাম সংগঠনগুলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে অগ্রণী থাকত। তারা এখন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। বিএনপি জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে একাকার। আওয়ামী লীগের কর্মীরা দোদুল্যমান। তারা ভোটের রাজনীতির কারণে মুসলিম সেন্টিমেন্ট ধারণ করতে গিয়ে কখনও সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় শরিক হচ্ছে, কখনও সংখ্যালঘু ভোটের কথা চিন্তা করে দূরে থাকছে। কিন্তু প্রতিরোধ করছে না। আওয়ামী লীগের এই দ্বৈতনীতির সমালোচনা শুনেছি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক নেতার মুখে। তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের নিয়ে দুই রকম হিসাব করে। দেশে থাকলে ভোট পাবে, আর তারা দেশছাড়া হলে ভোট কমবে। কিন্তু জমি মিলবে।’ সে কারণে আওয়ামী লীগের নেতারা প্রতিরোধে এগিয়ে যান না, কেবল দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। বর্তমান মহাজোট সরকারের শাসনামলে রামু-হাটহাজারী-সাতক্ষীরা-চিরিরবন্দর ও সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে এবং সর্বশেষ সাঁথিয়ায় যা ঘটল, তা সরকারের সৃষ্ট বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে। সব ক্ষেত্রেই তার প্রমাণ মেলে না। হিসাবও মেলে না। বরং যেটির প্রমাণ ও হিসাব দুই মেলে_ সেটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত মরিয়া হয়ে সহিংস কর্মকাণ্ড করছে। একদিকে তারা পুলিশ-প্রশাসনের ওপর হামলা করছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হচ্ছে। এভাবেই তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করতে তৎপর।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে বিএনপি জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। এ সুযোগে জামায়াত বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। বিএনপির কর্মীরা এখন জামায়াতিদের পেছনে হাঁটছে এবং জামায়াতের মদদে বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা সংঘটনে শামিল হচ্ছে। খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশে সংখ্যালঘু বলে কেউ নেই। এখানে সবার সমান অধিকার। আর তার দলের কর্মীদের একাংশ সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হচ্ছে। জানি না খালেদা জিয়া কি এ খবর রাখেন, না রাজনীতির স্বার্থে চোখ বুজে আছেন?
এ ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা আমাকে বিস্মিত করে। এ সরকারের আমলে সংঘটিত রামু-হাটহাজারীসহ বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এখনও বিচার হলো না। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া হলো না। ২০০১ সালে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা সংখ্যালঘুদের ওপর সে নির্যাতন চালিয়েছিল, সেসবের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক-সামাজিক দুবর্ৃৃত্তদের প্রতি উদার মনোভাবের রহস্য কী?
এটি কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, মুসলিম ভোটব্যাংকের কথা চিন্তা করে সরকার সাম্প্রদায়িক-ধর্মান্ধদের চটাতে চাইছে না। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আইনের শাসনের চেয়ে মুসলমানদের সেন্টিমেন্ট হিসাব করাই যেন তাদের রাজনীতি! এ কারণেই অসাম্প্রদায়িকতার দাবিদার বিএনপি স্লোগান দেয়, ‘ধানের শীষে বিসমিল্লাহ’; ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার আওয়ামী লীগ বলে, ‘নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’। একদা ভোটের রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগ খেলাফত মজলিশের সঙ্গে ব্লাসফেমি আইন প্রবর্তনের চুক্তি করেছিল। এখনও ওলেমা-মাশায়েখদের একাংশ নিয়ে সিটিং-মিটিং করছে। শোনা যায়_ হেফাজতকে বিভক্ত করে একাংশ কাছে টানার চেষ্টা করছে। আর বিএনপি এক কাঁধে হেফাজত ও আরেক কাঁধে জামায়াতকে তুলে খুশিতে আত্মহারা।
রাজনৈতিক দল ক্ষমতাভিমুখী হবে তা নিয়ে কথা নেই। কিন্তু সেই ক্ষমতা দখল হবে জনকল্যাণে_ জনস্বার্থ বিলিয়ে দিয়ে নয়, আদর্শের বিনিময়ে নয়। কেউ সংখ্যালঘুদের অধিকার পদদলিত করে কিংবা কেউ এ ব্যাপারে নিস্পৃহ থেকে ক্ষমতার খেলা খেলবে_ তা সমর্থন করা যায় না। একাত্তরে কেবল বাঙালি মুসলমান কিংবা বাংলাদেশি মুসলমানের দেশ কায়েমের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সব ধর্মের সব জাতির সব মানুষের সমঅধিকারের বাংলাদেশের জন্য। এখানে সব ধর্মের সব জাতির অধিকার রক্ষা করাই হবে সরকারের কাজ, বিরোধী দলের অঙ্গীকার।
বলা আবশ্যক, সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে বিভ্রান্তির ধূম্রজাল তৈরি করা যায়, তবে তা স্থায়ী হয় না। ধর্মীয় জিকির তুলে পাকিস্তানি শাসকরা শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ইতিহাসের এই শিক্ষা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে, ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বর্জন করবে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে_ সেটিই আজ প্রত্যাশিত।