election-02রাজনীতি একটি মহৎ কর্ম_ জনগণের নিরাপত্তা, শান্তি ও অধিকার নিশ্চিত করে। বদলে দেয় ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এই গণমুখী রাজনীতির ধারা যেমনি আছে, তেমনি আছে গণবিরোধী রাজনীতির অভিশাপও।
আজ রাজনৈতিক অঙ্গনে যা ঘটছে তা আমরা কীভাবে দেখব? কোন লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে রাজনীতি, জনগণের জন্য কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনছে_ সেটিই সর্বাগ্রে বিচার্য।
জনসম্পর্কিত রাজনীতির সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতেই। তখন লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। পাকিস্তান আমলে সংঘটিত আন্দোলনগুলোও ছিল গণমুখী। ‘৪৮-৫২ সালে ভাষার জন্য আন্দোলন, ‘৬৬ সালে স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন, ‘৬৯ সালে গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য গণঅভ্যুত্থান এবং ‘৭১-এ স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ। ‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা প্রবর্তন। কিন্তু আজ কেন হরতাল-সংঘাত হচ্ছে? আজকের এসব কর্মকাণ্ড কতটুকু জনস্বার্থ সম্পর্কিত?
বিরোধী দল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ সরকার গঠনের জন্য আন্দোলন করছে। সরকারও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব করেছে। উভয়ের লক্ষ্য যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে নির্দলীয় সরকার, না সর্বদলীয় সরকার কোনটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য_ তা নিরূপণের জন্য হরতাল-সংঘাত, রাজপথে পাল্টাপাল্টি লড়াইয়ের দরকার নেই। কিন্তু ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটি আজ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে অবতীর্ণ।
আমরা পরস্পরের দোষারোপ শুনছি। বিরোধী দল বলছে, সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করায় সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। জবাবে সরকার আদালতের রায়ের কথা উল্লেখ করছে। এ দুই বক্তব্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে আসল সত্য। সেটি হচ্ছে_ ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা আর ক্ষমতা দখলের আদর্শহীন রাজনীতি। দল যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তোলে। আর ক্ষমতায় গিয়ে সেই দলই ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচনের কথা বলে। এমন দ্বিমুখী আচরণ থেকে কেউ মুক্ত নয় ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
এটি বুঝতে পেছনের দিকে তাকাতে চাই। স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী লড়াইয়ের পটভূমিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ওঠে। ‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে তিন জোটের (৮ দল, ৭ দল ও ৫ দল) খসড়া রূপরেখায় তিন মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রবর্তনের প্রস্তাব ছিল। সব বাম দল এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তা একযোগে প্রত্যাখ্যান করে। দল দুটির নেতারা কেবল এরশাদ সরকারের স্থলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেন। তিন জোটের রূপরেখায় সেটিই গৃহীত হয়। এর কারণ সবারই বোধগম্য। তখন উভয় দলের ধারণা ছিল যে, সেবারে তারাই জিতবে। তাই পরবর্তী নির্বাচন তাদের অধীনেই হবে। আমরা জানি, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করল। সে সুযোগে ১৯৯৬ সালে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ঘোষণা দিল। কিন্তু তা মানল না আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও অন্যরা। তাই নতুন করে শুরু হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য হরতাল-সংঘাত-রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এবং অবশেষে বিএনপি তা পাস করতে বাধ্য হলো।
যে আওয়ামী লীগ একদা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ব্রেইনচাইল্ড দাবি করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ ত্রয়োদশ সংশোধনীর ওপর আদালতের রায়ের দোহাই পেড়ে তা বাতিল করল। এটি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই যে, আদালতের রায়ে আরও দুটি মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বহাল রাখার সুযোগ ছিল। হীন স্বার্থে রায়ের সামগ্রিকতা ধারণ করেনি আওয়ামী লীগ। রাজনীতির নির্মম পরিহাস_ যে বিএনপির কাছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ছিল পাগল ও শিশুর সঙ্গে তুলনীয়, এখন তারাই সেটি কায়েমের জন্য সংগ্রামরত।
উভয় দলের লক্ষ্য হচ্ছে কেবলই ক্ষমতা। তাদের রাজনীতি যতটা না আদর্শকেন্দ্রিক, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাকেন্দ্রিক, জনস্বার্থ তাদের কাছে গৌণ, গোষ্ঠীস্বার্থ বড়। সে লক্ষ্যেই তারা ধাবিত হচ্ছে।
কেউ বলতে পারেন_ রাজনীতি তো ক্ষমতা দখলের লড়াই। হয়তো তা তাত্তি্বকভাবে সত্য। তবে এমন লড়াইয়ের দুটি পথ আছে_ একটি বৈপ্লবিক, অপরটি গণতান্ত্রিক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, উভয়ে গণতন্ত্রের কথা বলে। আর এটি যদি তাদের আন্তরিক অভিপ্রায় হয়, তবে সংঘাত কেন, দুই নেত্রীর ফোনালাপে এত ক্রোধ কেন?
আমাদের মনে রাখা দরকার, ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যম সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটি কোন পদ্ধতিতে হবে_ তার জন্য রাজপথে যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন_ সংলাপ। সংলাপের মাধ্যমেই এই সংকট সমাধান হতে পারে। কিন্তু দুই দল নির্বাচনের আগেই জিততে চাইছে। তাই শক্তি প্রদর্শনের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। এটি সামন্ত সংস্কৃতি। যেখানে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতাসীন হতে হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা-যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়, সমঝোতা-ঐকমত্যে পেঁৗছতে হয়।
সমস্যা হচ্ছে, স্বৈরাচার লুকিয়ে আছে গণতন্ত্রের আলখাল্লায়। এখান থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে, দল ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের রীতিনীতি, মূল্যবোধের অনুশীলন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বকীয় ধারায় পরিচালিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
এটি সত্য, গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হচ্ছে; কিন্তু তা নিয়ে কোনো বাদ-প্রতিবাদ নেই। কারণ, সেখানে নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ নয়, স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করে। পুলিশ প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে কাজ করে। এ জন্য প্রয়োজন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়ন এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুশীলন। কিন্তু সেদিকে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মনোযোগ নেই।
শামসুল হুদা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন যে সাহস ও স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছিল, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। তদুপরি জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধন করে বিল পাস হয়েছে। সে অনুযায়ী যে কেউ কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে সুযোগ পাবেন। আগে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন থেকে পূর্ববর্তী তিন বছরে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলে নিরবচ্ছিন্ন সদস্য পদ না থাকলে নির্বাচনে সে দলের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ছিল না। তা ছাড়া প্রার্থীর ব্যয় ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা বর্ধিত করা হয়েছে। এ সংশোধনীর ফলে মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, কালো টাকার দাপট বাড়বে। সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা নির্বাচন করার অধিকার হারাবেন।
এ ক্ষেত্রে বিরোধী জোট আপত্তি জানায়নি। ধরে নেওয়া যায়, এতে উভয় জোটের ঐকমত্য আছে। গণতন্ত্র চর্চার সব দরজায় তালা ঝুলিয়ে কেবল নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছে। অবশ্য এ বিতর্কের অবসান হওয়া দরকার। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কারে ঐকমত্য হওয়া দরকার। ভাবতে হবে নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের কথাও। সেদিকে দৃষ্টি না দিলে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেবে। তবে এমন রূপান্তর সময়সাপেক্ষ।
প্রশ্ন হচ্ছে_ এখন কী করতে হবে? আশু করণীয় কী? সরকার ও বিরোধী দলকে আলোচনার টেবিলে আসতে হবে, উভয়কে ছাড় দিতে হবে, সমঝোতায় পেঁৗছতে হবে_ এর বিকল্প নেই। আর যেটি আছে তা উভয়ের জন্যই বিপদসংকেত। তবে এ ব্যাপারে সরকারকেই হতে হবে অগ্রণী। কারো ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে বা খণ্ডিত করে কোনো নির্বাচন করলে তা অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য হবে না। এ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘৮৬, ‘৮৮ এবং ‘৯৬-এর ফেব্রুয়ারি নির্বাচন টেকেনি। তাই এমন উদ্যোগ হবে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি মাত্র।