নির্বাচনকালীন সরকার প্রদ্ধতি নিয়ে যে মতদ্বৈধতা আছে তা নিরসন করা জরুরি। তবে জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থে আরও কতিপয় বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যে পেঁৗছার বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৮ অক্টোবরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ এবং ২১ অক্টোবর বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে এমন আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে।
উভয় নেত্রীই সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানের কথা বলেছেন। অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন একজন আরেকজনের প্রতি। দ্বিমত করার সুযোগ নেই যে, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নিয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছেন, তা সত্য। বর্তমান মহাজোট সরকারের শাসনামল সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি থেকে মুক্ত নয়। আওয়ামী লীগ নেতারা স্বীকার করুন আর না-ই করুন_ সন্ত্রাসীরা দলের প্রশ্রয়ে থেকে চাঁদাবাজি, খুনখারাবি করে চলেছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের চিহ্নিত ক্যাডাররা টেন্ডারবাজি-দখলবাজিতে রেকর্ড করেছে। এ সরকারের শাসনামলকে কলঙ্কিত করেছে শেয়ারবাজার, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক ও পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির ঘটনা।
সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনায় পিছিয়ে ছিল না বিএনপির নেতৃত্বাধীন শাসনামলও। হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট, ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার, ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটেছে। এ আমলে চৌধুরী জানে আলম, ইলিয়াস আলীর গুম, শ্রমিক নেতা আমিনুলসহ অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে অনেক। একইভাবে চারদলীয় সরকারের বিগত শাসনামলে এসএএমএস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। তখনও বেপরোয়াভাবে চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
পরস্পরের প্রতি দোষারোপ নয়, নেতৃত্বের আত্মোপলব্ধি ও আত্মসমালোচনাই পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। সেই উপলব্ধি অনুপস্থিত। দুই নেত্রীর বক্তব্যে আত্মপ্রচার আছে, কিন্তু আত্মোপলব্ধির কোনো প্রতিফলন নেই, আত্মসমালোচনা নেই। উল্লেখ্য, খালেদা জিয়া তার পরিবারের প্রতি যারা অন্যায়-অবিচার ও ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন, তাদের প্রতি ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটি মহত্ত্বের লক্ষণ। তবে তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে, আদালতে মামলা আছে তা নিয়ে কিছু বলেননি। জানতে ইচ্ছা হয়, তিনি ক্ষমতা পেলে কি রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করবেন, না আইনি লড়াই করবেন? অভিযোগ প্রমাণিত হলে কি মাথা পেতে নেবেন?
বর্তমান সরকার তাদের নেতাকর্মীদের মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করেছে, রাজনীতিকে দিয়ে সাজাপ্রাপ্তদের সাজা মওকুফ করেছে। অতীতের শাসনামলগুলো সম্পর্কে অনুরূপ অভিযোগ এসেছে। পরিবর্তন করতে হলে সেই অঙ্গীকার দরকার যে, রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো মামলা বা শাস্তি প্রত্যাহৃত হবে না।
সব শাসকই ভুল করেন। কেবল সুশাসকই ভুল-ত্রুটির জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। যারা ভুলের জন্য অনুতপ্ত হন না, তাদের পক্ষে আর যা-ই হোক সুশাসন কায়েম করা সম্ভব নয়।
জঙ্গিবাদ দমনের কৃতিত্ব শেখ হাসিনা দাবি করেছেন। খালেদা জিয়া বলেছেন, জঙ্গিবাদ দমনের কাজটি তার সরকার শুরু করেছে। একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে স্বীকার করি, এ ব্যাপারে উভয় দলের দাবিরই সত্যতা রয়েছে। সবার জানা_ বিএনপি জোট সরকারের শাসনামলে শীর্ষ জঙ্গিদের গ্রেফতার ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যদিও প্রথমভাগে জঙ্গিবাদের প্রতি প্রশ্রয় নীতি গ্রহণ করেছিল। মনে রাখা দরকার, জঙ্গিবাদের দর্শন হচ্ছে মৌলবাদ। মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়ে কিংবা তাদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করা যায় না। মৌলবাদের চর্চা থাকলে জঙ্গিবাদের বিস্তার হতে থাকবে।
বিএনপি এখনও মৌলবাদী রাজনীতির ধারক জামায়াত-হেফাজতের হাত ধরে আছে। জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করতে হলে বিএনপিকে জামায়াত-হেফাজতের হাত ছাড়তে হবে। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, অতীতে আওয়ামী লীগও জামায়াতের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আন্দোলন করেছে। এক সময়ে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের চুক্তি করেছিল। তাই তাদেরও বলতে হবে, তারা আর কখনও কোনো মৌলবাদী দলের সঙ্গে হাত মেলাবে না। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর এই নীতিগত অবস্থান ছাড়া জঙ্গিবাদকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা যাবে না।
খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে শান্তিপ্রিয় ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক দলগুলোর সঙ্গে জঙ্গিবাদকে একাকার করে দেখার সরকারের নীতির সমালোচনা করেছেন। কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি শান্তিপ্রিয় ও নিয়মতান্ত্রিক ধর্মভিত্তিক দল মানে জামায়াত ও হেফাজতের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোকে বুঝিয়েছেন। এ নীতিতে অটুট থাকলে তাদের পক্ষে কি জঙ্গিবাদ মোকাবেলা সম্ভব?
বিরোধীদলীয় নেতা ধর্মীয় ও নৃতাত্তি্বক সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা বলেছেন। তবে কীভাবে সেই অধিকার নিশ্চিত হতে পারে, সেটিই বড় প্রশ্ন। সব সরকারের আমলেই সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের হাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি-মন্দির লুণ্ঠন ও নির্যাতন হয়েছিল। এখনও তার বিচার হয়নি। সম্প্রতি রামু-হাটহাজারী হামলাকারীদের বিরুদ্ধেও হয়নি। এবারের ঘটনায় কেবল জামায়াত-হেফাজত নয়, বিএনপি-আওয়ামী লীগের কর্মীদের জড়িত থাকারও অভিযোগ আছে। আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে।
খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে জঙ্গিবাদ ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রশ্নে যে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও মহাজোটের শরিক দলের নেতারাও এ ব্যাপারে অভিন্ন মনোভাবের কথা বলছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বাঙালি মুসলমান আর বাংলাদেশি মুসলমানের আধিপত্য নিয়ে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে অন্য জাতি ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ওপর বাঙালি মুসলমানের আধিপত্য কায়েম হয় আর বিএনপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে বাংলাদেশি মুসলমানের আধিপত্য বলবৎ হয়, যা নির্যাতনের অভিন্ন রূপ। তদুপরি আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি হুমকি হয়ে আছে রাষ্ট্রধর্মসহ কতিপয় সাংবিধানিক বিধি। সব নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হলে এসব কালাকানুন বাতিল করা দরকার। এ ব্যাপারে উভয় দলই নীরব।
প্রধানমন্ত্রী ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেওয়ার পাশাপাশি তার সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়েছেন। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যে দলের নীতিগত অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তার বক্তব্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা নীতি, সংখ্যালঘুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, জঙ্গিবাদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থান তুলে ধরা হলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে মৌনতা লক্ষণীয়। এর আগে খালেদা জিয়া একাধিকবার যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন। তবে তার দাবি হচ্ছে, বিচার হতে হবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের বিস্তারিত ও নীতিনির্ধারণী বক্তব্যে তা না থাকায় প্রশ্ন জাগে যে, জামায়াতে ইসলামীকে খুশি রাখতেই কি বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন তিনি? এটি সবারই বোধগম্য_ মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
জাতীয় স্থিতিশীলতার স্বার্থেই নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির পাশাপাশি জঙ্গিবাদ দমন, সংখ্যালঘুদের অধিকার ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়েও জাতীয় ঐকমত্য থাকা দরকার। সবারই মনে রাখতে হবে, এগুলো সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হওয়ার বিষয় নয়।
নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির বিষয়টি আর ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ নেই। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, না সংবিধানের আলোকে করতে হবে_ সেটি বড় কথা নয়। এ ক্ষেত্রে কোনটি যৌক্তিক সেটি সর্বাগ্রে বিবেচ্য।
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার দেওয়া দুটি ফর্মুলা আছে। প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব করেছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত উপদেষ্টাদের থেকে দুই দলের সম্মতিতে ১০ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে সরকার গঠনের কথা বলেছেন। দুই প্রস্তাবের মধ্যে কাঠামোগত পার্থক্য আছে। তবে দুই ফর্মুলার ক্ষেত্রেই সরকারপ্রধান কে হবেন, সেটিই সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ফর্মুলায় প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলে সরকারের গুণগত পরিবর্তন হবে না। অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার ফর্মুলায় উপদেষ্টাদের ভূমিকাও মুখ্য নয়। উভয় ব্যবস্থায়ই সরকার প্রধানের ভূমিকাই আসল।
কোন ফর্মুলা গৃহীত হবে তার প্রভাব নির্বাচনের ওপর পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুই জোটই বিজয়ীর বেশে নির্বাচনের মাঠে যেতে চাইছে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হতে হবে ‘উইন উইন সিচুয়েশন’।
উইন উইন সিচুয়েশন বজায় রেখে সমাধান করতে হলে উভয় দলকে ছাড় দিতে হবে। সেটি হতে পারে এমন_ বিরোধী দল সর্বদলীয় সরকারের ফর্মুলায় আসবে। আর সরকার শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী থাকার মনোভাব ছাড়বে। তা হলে কেবল এ মেয়াদের জন্য নয়, আগামীর জন্যও অনুসরণীয় হতে পারে।