india-1সামনে ভারতের নির্বাচন। কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। গত সেপ্টেম্বরের শেষ পক্ষে দিলি্ল, ব্যাঙ্গালোর, মহীশূর, কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। অগণিত মানুষকে মোদী জোয়ারে ভাসতে দেখেছি। দিলি্ল ও কলকাতার দুই ট্যাক্সিচালকের কাছ থেকে প্রায় একই সুরে কথা শুনেছি। দিলি্লর ট্যাক্সিচালকের রাহুলের প্রতি ভরসা নেই, তার কাছে করিতকর্মা নরেন্দ্র মোদী। কলকাতার চালকের কথা হচ্ছে, \’সিপিএম দেখেছি, মমতাকে দেখলাম। এবার মোদীকে সমর্থন করব।\’ বললাম, মোদী কেন্দ্রে, পশ্চিমবঙ্গে কাকে সমর্থন দেবেন? সেটি নিয়ে তার ভাবনা নেই। দিলি্লতে একাধিক সাংবাদিক বন্ধু মোদীর ভাবমূর্তির বয়ান করলেন। চা বিক্রেতা থেকে জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার গল্প। কিন্তু গুজরাটের দাঙ্গায় তার নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টিতে প্রলেপ দিয়ে এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, দেখুন, মোদী কীভাবে মুসলমানদের দলে ভিড়িয়েছেন এবং তাদের মন জয় করে চলেছেন। মোদীকে নিয়ে অনেক কথা, অনেক গল্প। যেন রূপকথার এক নায়ক!
প্রশ্ন হচ্ছে, মোদী কি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, ভারতে আবার বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার হচ্ছে? এর জবাব খোঁজার প্রসঙ্গে পেছনে ফিরতে চাই। ভারতের সমাজ বহুত্ববাদী। অনেক ধর্ম, বর্ণ, জাতি একই সমাজদেহে মিলেছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন বিভক্তি আছে, তেমনি আছে সমন্বয়ের ধারাও। এই সংঘাত ও সমন্বয়ের মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সামন্ত শাসকদের মধ্যেও সমন্বয় চিন্তা লক্ষণীয়। ভারতের দুই মহান নৃপতি অশোক ও আকবর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য সুশাসনে ব্রতী হয়েছিলেন। তবে ভারতের সব রাজন্য ও সাধারণ মানুষের মধ্য একাত্মবোধের প্রকাশ ঘটে ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে_ যা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে স্বীকৃত।
সেদিন সব জাতি, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ এক জোট হয়ে ব্রিটিশ আধিপত্য রুখতে চেয়েছিল। সফল হতে পারেনি সংগ্রামীরা। কিন্তু সেই থেকে একযোগে \’ব্রিটিশ খেদাও\’ আন্দোলনের সূত্রপাত। এ লড়াইয়ে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এক কাতারে মিলেছে। উনিশ শতকে সূচিত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে ধর্ম থেকে প্রেরণা লাভের চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী তরুণরা কালী মাতার চেতনা ধারণ করে আত্মোৎসর্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়; অন্যদিকে মুসলিম ধর্মীয় নেতারা ভারতকে \’দারুল হরব\’ ঘোষণা করে স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে শরিক হয়।
মহাত্মা গান্ধী ধর্মীয় মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন। তিনি ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মর্মবাণীও উপলব্ধি করেছেন। তার কাছে ধর্ম ছিল কল্যাণময়ী ধারা। তাই তার প্রার্থনা সভায় একই সঙ্গে গীতা, কোরআন, বাইবেল থেকে পাঠ করা হতো।
ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে খেলাফত আন্দোলন (১৯১৮-১৯২৪) শুরু হলে গান্ধীজি তা সমর্থন করেন। তখন একই সঙ্গে ধ্বনিত হতে থাকে_ বন্দে মাতরম-আল্লাহু আকবর। বলা আবশ্যক, জওয়াহেরলাল নেহরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ আধুনিক শিক্ষিত তরুণ কংগ্রেসীরা ছিলেন সেক্যুলার নীতিতে বিশ্বাসী। এই \’তরুণ তুর্কি\’রা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন না। তবে সেদিন গান্ধীর ধর্মীয় মানবতাবাদ চর্চার সঙ্গে সেক্যুলার চেতনার ধারকদের একসঙ্গে অগ্রসর হওয়ায় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তা ছাড়া গান্ধীর ধর্মীয় চেতনায় ছিল বহু ধর্মের সহাবস্থান নীতি, যা বহুত্ববাদী ধারণার পরিপূরক। তবে আন্দোলনকারী সবার ধর্মীয় বোধ মানবিক চেতনামুখী ছিল না। তাই ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির জঠরে একদিকে হিন্দুত্ববাদ জন্ম নিয়েছে, অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবাদী ভাবনা এসেছে, মুসলিম নেতৃত্বের একাংশ আলাদা জাতি দাবি করে পৃথক রাষ্ট্র গড়ার সংগ্রামে নেমেছে। সবারই জানা, যার হাল ধরেছিলেন এক সময়ের সেক্যুলার রাজনীতির প্রবক্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সে যাই হোক, মুসলিম মৌলবাদী চেতনা পাকিস্তানে হিজরত করেছে, যা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ভারত বিভাগের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তি প্রবল হয়ে ওঠে। সেক্যুলার নীতির বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে।
হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে তখন পথের বড় বাধা স্বয়ং গান্ধীজি। তিনি মুসলমানদের অধিকার, এমনকি ভারতের কাছে পাকিস্তানের প্রাপ্য অর্থ দেওয়ার দাবিতে অনশনে গেলেন। ক্ষুব্ধ ধর্মান্ধরা গান্ধীজিকে হত্যা করে। কিন্তু এতে হিন্দুত্ববাদীদের লাভ হয় না বরং গণক্রোধের শিকার হয় তারা। তারপর বিভিন্ন সময়ে বজরং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদসহ নানা নামে হিন্দুত্ববাদের প্রকাশ ঘটেছে; কিন্তু রাজনীতিতে শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা থেকে মুক্তি। তা সত্য হয়ে আসেনি ভারতীয়দের জীবনে। দীর্ঘ কংগ্রেসী শাসনে ভারতে পুঁজির বিকাশ ঘটেছে। মধ্যবিত্তের একাংশের জীবন বদলেছে। শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। কিন্তু সে সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকার। অগণিত যুবকের কাজ মেলেনি। নিচের তলার মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি।
আমজনতার কাছে পারমাণবিক শক্তির গর্ব আর আকাশে চন্দ্রযানের পদচারণা পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঝলসানো রুটি। এ প্রেক্ষাপটে গণমানুষের কাছে হিন্দুত্ববাদের দর্শন কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। বরং পঞ্চাশ থেকে শুরু করে ষাটের দশকজুড়ে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, কেরালা, ত্রিপুরাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে বামপন্থি আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। অগণিত তরুণ-তরুণী উদ্বেলিত হয় সাম্যভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন বুকে নিয়ে আত্মবলিদানের মহোৎসবে। সেই আন্দোলনও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রেই মুক্তিকামী মানুষকে হতাশ করেছে।
ভারতবাসী দীর্ঘ কংগ্রেসী শাসন দেখেছে। বামরাও হতাশ করেছে। কেউ আশার আলো ফোটাতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপির চটকদারি বক্তব্যের মাঝে বিপুলসংখ্যক নর-নারী পরিবর্তনের ডাক শুনেছে। তখন ভারতের মুক্তিকামী মানুষ খতিয়ে দেখেনি যে, বিজেপিতে কাদের সমাবেশ ঘটেছে, অটল বিহারি বাজপেয়ি নামক মুখোশের আড়ালে কোন অপশক্তি দাঁত ভেংচিয়ে আছে। অচিরেই জনতার মোহমুক্তি ঘটেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার।
সোনিয়া-মনমোহনের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট নানা হিসাব কষছে। আর মোদী ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর। অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি তৈরি করতে সচেষ্ট। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) \’সদ্ভাবনা\’ সমাবেশে মুসলিম সুফি নেতা সৈয়দ মেহেদী হুসাইন (পীরানা বাবা) মোদীকে একটি টুপি উপহার দিলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেই মোদী গত ২৫ সেপ্টেম্বর ভুপালের সমাবেশে উপস্থিত মুসলিম পুরুষদের জন্য টুপি এবং নারীদের বোরকা উপহার দিয়েছেন। বিভিন্ন সমাবেশে মুসলমানদের মধ্যে হাজার হাজার টুপি ও বোরকা বিতরণ করেছেন। বলা বাহুল্য, ইতিপূর্বে মুসলমানদের ধর্মীয় পোশাক নিষিদ্ধের দাবি করেছিল বিজেপি। আর এখন সে দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মোদী অতিমাত্রায় মুসলিমবান্ধব। বিষয়টি তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনীয়। যিনি কোনো সমাবেশে বসে আজান শুনলে মাথায় ঘোমটা টেনে দেন। শুনেছি, রোজা রেখে ইফতার পার্টিতে যোগ দেন।
মুসলিম মন জয় করতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কথাও বলছেন মোদী। তিনি এখন ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়ে তার কাক পরিচয় গোপন করতে চাইছেন। হিন্দুবাদী অবয়ব আড়াল করতে নতুন নতুন ফন্দিফিকির আঁটছেন। তিনি এক সমাবেশে বলেছেন, \’লোকে আমাকে হিন্দুত্ববাদী বলে। কিন্তু আমি তো বলি_আগে শৌচালয় (বানানো জরুরি), পরে দেবালয়।\’ এভাবেই গুজরাটের দাঙ্গার মদদদাতা বলে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদী ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি তৈরিতে তৎপর।
আমি সর্বস্তরের ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলে, পত্রপত্রিকা ঘেঁটে বুঝতে চেষ্টা করেছি, মোদী কি পরিবর্তনের কোনো কর্মসূচি দিতে পেরেছেন? না, পরিবর্তনের কোনো ফর্মুলা তার কাছে নেই। তিনি বোঝাতে চাইছেন, কংগ্রেসের সম্ভাব্য প্রার্থী রাহুল গান্ধীর চেয়ে তিনি করিতকর্মা। এক অধ্যাপক কৌতুক করে বলেছেন, \’মোদী দ্রুত পরিবর্তন আনতে পারবেন। তার প্রমাণ তিনি নিজেই। কিছুদিন আগেও তিনি ছিলেন মুসলিমবিদ্বেষী, এখন তিনি মুসলিমবান্ধব(?)। মোদী জোয়ার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা স্পষ্ট নয়। ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলো বড় ফ্যাক্টর। আঞ্চলিক দলগুলো কী ভূমিকা নেবে_তার ওপর নির্ভর করবে কারা ক্ষমতায় আসছে, কে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে আদভানি মুখ ঘুরিয়ে রাখলেও নরেন্দ্র মোদী বিজেপি জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী। অন্যদিকে তার বিপরীতে রাহুলই যে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী তা বোধহয় নিশ্চিত করে বলা যায় না। এখানে কংগ্রেসকে ঘিরে জোটে কারা আসছে, তা বিবেচ্য। তৃতীয় জোট হওয়ার ব্যাপারটা আলোচনায় আছে। জয়ললিতা, মুলায়ম সিং যাদব, নিতিশ কুমার, মমতাসহ আঞ্চলিক নেতারা কী করছেন_ সেটি ভাববার বিষয়। বামদের ভূমিকাও হিসাবের ব্যাপার।
শেষ বিচারের মালিক জনগণ। শান্তিপ্রিয় ভারতবাসী নতুন কোনো দাঙ্গা, হানাহানি দেখতে চায় না। তারা ভালো করে জানে, যে কোনো সহিংসতা ভারতের অগ্রযাত্রার লাগাম টেনে ধরবে। সে সঙ্গে মনে হয় না, ভারতের মুসলিমসহ সংখ্যালঘুদের তেমন ভোট মোদীর বাক্সে পড়বে। তা ছাড়া বিজেপি সারা ভারতেও সাড়া জাগাতে পারেনি। উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গসহ ছোট-বড় অনেক রাজ্যেই শিকড় গাড়তে পারেনি। বর্তমানের সৃষ্ট জোয়ার এসব রাজ্যে বিজেপি হঠাৎ শক্তিধর হয়ে উঠবে_ তা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য?
বাংলাদেশে বসে ভারতের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করা কঠিন। তবে কেবল বলতে পারি_ মোদী বদলালেও বিজেপির অভ্যন্তরের বজরং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএসসহ কট্টরপন্থিরা বদলাবে না। তাই বিজেপি জোট ক্ষমতায় এলে বহুত্ববাদী সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে উঠবে_ তা সচেতন ভারতবাসীর না বোঝার কথা নয়।