বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে সংশয় নেই। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে এর প্রমাণ মিলছে। নারী শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড রিজার্ভসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটেছে। আবার দুর্নীতি রোধসহ কতিপয় ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতিতে আমরা কতটুকু এগিয়েছি বা পিছিয়েছি_ এ ক্ষেত্রে সরাসরি কোনো সংস্থার জরিপ দেখিনি। তবে বিভিন্ন সামাজিক সিনড্রোম থেকে সিদ্ধান্তে পেঁৗছা যায়। তার চেয়ে বড় প্রমাণ, নেতা-নেত্রীর আচরণ বলে দিচ্ছে_ আমাদের রাজনীতি অগ্রগামী না অবনতিশীল।
পেছনের ইতিহাসে চোখ বুলাই_ বরিশালের এক উকিলের ছেলে আবুল কাসেম ফজলুল হক কী করে অবিভক্ত বাংলার প্রভাবশালী নেতা হয়েছিলেন। সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। অবিভক্ত বাংলার প্রভাবশালী নেতা ছিলেন, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের অধিবেশনে কাকে দিয়ে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হলে তা অর্থবহ হবে_ মুহম্মদ আলী জিন্নাহসহ মুসলিম লীগ নেতারা এ দায়িত্ব পালনে শেরেবাংলাকেই মনোনীত করেছিলেন। এ প্রস্তাব পাঠে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক হক সাহেব কতখানি মহিমান্বিত, না বিতর্কিত হয়েছিলেন_ সেটি ভিন্ন বিতর্ক। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে তৃণমূল থেকে নেতৃত্বে আসীন হওয়ার সুযোগ ছিল। তখন মেধা, যোগ্যতা আর অধ্যবসায়ই ছিল নেতৃত্বে আরোহণের মানদণ্ড। তাই গোপালগঞ্জের সাধারণ পরিবারের সন্তান শেখ মুজিব বাংলার মহানায়কে পরিণত হয়েছিলেন। সম্প্রতি প্রকাশিত তার \’অসমাপ্ত আত্মজীবনী\’ পড়ে বিস্মিত হতে হয়। কী নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে তিনি লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। সততা, আন্তরিকতা, সাহস আর কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে গড়েছিলেন। তিনি তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে এতই আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন যে, দেশের খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উদ্দেশে বলতেন, \’আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট আর আমি রাজনৈতিক আন্দোলনের ডক্টরেট।\’
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি পড়েও উপলব্ধি করেছি যে, কত নিয়মানুবর্তী ও সংগ্রামী মানুষ ছিলেন তাজউদ্দীন। ঢাকাতে যখন তার থাকা ও খাওয়ার জায়গা ছিল না, তখন তিনি কাপাসিয়া থেকে এসে যথাসময়ে রাজনৈতিক সভা-কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। প্রথমত অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি জাতির অন্যতম কাণ্ডারি হয়েছিলেন।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কী করে \’নেতাদের নেতা\’ হয়েছিলেন_ সেটি বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। বলা যায় স্বশিক্ষিত। কিন্তু রাজনীতির শীর্ষে আসীন হয়েছিলেন।
শেরেবাংলা, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন পরাধীনতার শিকল ছেঁড়ার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তখন সে সংগ্রামে প্রয়োজন ছিল আত্মত্যাগ, মেধা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা। তখন রাজনীতিতে কে কত জেলজুলুম সয়েছেন, কী নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন তা ছিল প্রধান বিবেচ্য বিষয়। পৈতৃক পরিচয়, বংশ মর্যাদা তখন নেতৃত্বের মানদণ্ড ছিল না। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল খালেক নেওয়াজ মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তখন মুসলিম লীগের জোতদার নেতারা কৃষকের সন্তানদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। কমিউনিস্ট নেতা সরদার ফজলুল করিম জেল থেকে মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হন। \’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কথা জানি। তখন শুনেছিলাম, একজন ধনপতি ফরিদপুর সদরে প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ওখানে আমার ইমাম আছে। ওর হয়ে কাজ করুন। ইমাম উদ্দিন আহমেদ তখন রাজনৈতিক কারণে চাকরিহারা স্কুলশিক্ষক। তখন উকিল, শিক্ষক, ডাক্তার, সাবেক ছাত্রনেতারাই প্রার্থী হয়েছিলেন। আমার থানা নগরকান্দার প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ ওয়াই আমিন উদ্দিন আহমেদও ছিলেন স্কুলশিক্ষক। আমার মনে পড়ে, একদিন ভোরে পাশের থানা বোয়ালমারীর প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. আফতাব উদ্দিন আহমেদ আমাদের বাড়িতে সাইকেল চালিয়ে এসে হাজির হন। সঙ্গে অপর সাইকেলে দু\’জন কর্মী। আমি আফতাব সাহেবের সাইকেলের পেছনে বসে পাশের গ্রামের নির্বাচনী সভায় হাজির হয়েছিলাম। \’৭০-এর নির্বাচনে অনেক সম্পদশালীই আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য আনাগোনা করেছিলেন। কিন্তু তখন সিদ্ধান্ত ছিল পরীক্ষিত রাজনীতিক বা সমাজকর্মীদের মনোনয়ন দেওয়া। দুই ন্যাপই নির্বাচনের রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ে। তবে \’৭০-এর নির্বাচনে তাদের প্রার্থীরাও ছিলেন পরীক্ষিত রাজনৈতিক কর্মী। \’৭৩-এর নির্বাচনে বটেই। এমনকি ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনেও সব দল অধিকাংশ রাজনীতিককে মনোনয়ন দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে। তখন জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলেও বিভিন্ন দলের নেতাদের ভাগিয়ে এনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সে সময়ে বিএনপিতে যোগদানকারীরা \’দলছুট\’ পরিচয়ে পরিচিত হন। ওই সংসদেও রাজনৈতিক নেতাদের প্রাধান্য ছিল। তবে তখন থেকেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়াবহির্ভূত আমলা ও ব্যবসায়ীরা নির্বাচন ও রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করতে থাকেন। \’৮৬ ও \’৮৮ নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি আমলা, ব্যবসায়ী ও চিহ্নিত মাস্তানদের ব্যাপকভাবে মনোনয়ন প্রদান করে। কিন্তু আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দল মৌসুমি রাজনীতিকদের জন্য দুয়ার তখনও খুলে দেয়নি।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপিতে ব্যাপকভাবে সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। বিনিময়ে দলীয় ফান্ডে তারা বড় অঙ্কের চাঁদা দেন বলে শোনা যায়। ১৯৯১ সালেও প্রার্থী চয়নে আওয়ামী লীগ দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগও বিএনপিকে অনুসরণ করে। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিযোগিতামূলক মনোনয়ন বাণিজ্য শুরু হয়। সে সময় উভয় দলের রাজনীতিকদের কাছে শোনা যায়, রাজনীতি আর রাজনীতিকদের কাছে নেই। এটি আমলা, ব্যবসায়ী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আমলা বা ব্যবসায়ীরা কি রাজনীতি করতে পারবেন না? অবশ্যই পারবেন। তবে দলে যোগদান করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মনোনয়ন লাভ করবেন। হঠাৎ করে মনোনয়ন কিনে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার প্রক্রিয়া রাজনীতিতে অশুভ প্রভাব ফেলছে। এসব মৌসুমি রাজনীতিক নির্বাচনে দু\’হাতে টাকা ছিটিয়েছেন। মোটা টাকা খাটিয়ে জিতেছেন। সুতরাং তা উসুল করা চাই। তা বহুগুণ তুলে নিয়েছেন নির্বাচিত হয়ে। এভাবে দুর্নীতি বিস্তৃত হয়েছে রাজনীতিতে। এতে রাজনীতি ও সমাজ দুই-ই কলুষিত হয়েছে, হচ্ছে।
রাজনীতিকরা বুঝেছেন, টাকা ছাড়া নির্বাচনে জেতা যাবে না। তাই রাজনীতিকদের এক দল টাকার পেছনে ছুটেছেন। ব্যবসা-তদবির করে কেউ কেউ টাকাও কামিয়েছেন। যারা এ পথে পা দেননি বা পা দিয়ে সফল হতে পারেননি, তারা রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখন অর্থের সোর্স প্রবল, যা দেশের দুর্নীতির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। কেবল নির্বাচন নয়, রাজনীতি এখন বাণিজ্য। ক্ষমতার ছোঁয়ায় চেহারা বদলে যাচ্ছে এক শ্রেণীর রাজনীতিকের। যা দেখে কর্মীরা দখলবাজি-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত হচ্ছে।
কেউ কেউ বলেন, দলীয় নেতারা টেন্ডারবাজ কর্মীদের কেন নিয়ন্ত্রণ করেন না? আসলে তাদের পক্ষে তা কি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? নেতাদের রাজনৈতিক বাণিজ্য বন্ধ না হলে কি কর্মীদের টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি বন্ধ করা যাবে? এখন শুনছি, প্রধান প্রধান দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোতে \’পদ\’ বিক্রি হচ্ছে। পদ কিনে প্রভাবশালী হচ্ছে কেউ কেউ। চাঁদাবাজির ভাগ মিলছে। আবার ঊর্ধ্বতন কমিটিকে টাকা দিতে হচ্ছে কমিটি অনুমোদনের জন্য। এভাবে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এখন বাণিজ্যিক লাভ-লোকসানের প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ।
এখন যে যত অর্থ ছড়াতে পারে, সেই তত বড় নেতা। অর্থই এখন মানদণ্ড; আদর্শ, ত্যাগ ও সততা এখন অচল কড়ির মতোই পরিত্যাজ্য।
এ ছাড়া দলগুলোতে অর্থের দাপটই শেষ কথা নয়, পরিবারতন্ত্র ও আত্মীয়তন্ত্র এখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বড় বাধা। কেবল দল দুটির শীর্ষ নেতৃত্বই নয়, নির্বাচনে মনোনয়ন কিংবা দলীয় পদ লাভের ক্ষেত্রেও উত্তরাধিকারিত্ব একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। কোনো এমপির মৃত্যুর পর নির্বাচনে তার পত্নী বা সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই অনভিজ্ঞদের রাজনীতিতে আগমন ঘটছে, যা দল ও রাজনীতির জন্য শুভ নয়।
এ প্রবণতার বাইরে ছিল বাম ও মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী। শোনা যাচ্ছে, যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত নেতারা নির্বাচনে অযোগ্য হলে সে ক্ষেত্রে তার পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে।
উত্তরাধিকারের রাজনীতি এশিয়ার বিভিন্ন দেশেই ক্রিয়াশীল। প্রতিবেশী ভারতেও আছে। তবে পার্থক্য সেখানে উত্তরাধিকারী দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নেতৃত্বে আসীন হন। এখানে হঠাৎ করে নেতৃত্বের শীর্ষে আসীন করা হয়।
যেখানে নেতৃত্ব উত্তরাধিকার সূত্র বা অর্থের মানদণ্ডে নিরূপিত হয়, যেখানে পেশিশক্তির দাপট দেখিয়ে নেতৃত্বে আসীন হওয়া যায়, সেখানে \’গণতন্ত্রের\’ চর্চা কতটুকু সম্ভব? এ অবস্থায় দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রবর্তন করা এক দুরূহ ব্যাপার।