ভূমি দস্যুতা এখন সমাজের অতি চেনা চিত্র। অসহায় গরিব পরিবারের জমির প্রতি একশ্রেণীর লোকের লোভাতুর চোখ পড়ার ঘটনা নতুন নয়। রবীন্দ্রনাথের \’দুই বিঘা\’ কবিতায় হতদরিদ্র প্রজা উপেনের জমিলোভী জমিদারের হাতে গ্রাসের কাহিনী পড়ে আমরা কেঁদেছি। কবিতার ভাষ্যে পাই_ রাজা ছলে-কৌশলে, ডিক্রি করিয়ে উপেনের সাত পুরুষের ভোগদখলের জমি কেড়ে নেন। একদা এভাবেই প্রভাবশালীরা ছলচাতুরী করে গরিবের জমি গ্রাস করত। এখন ছলে-কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলপ্রয়োগ। অস্ত্রের জোরে জমি দখলের ঘটনা ঘটছে আকসার। ধর্ম ও রাজনীতিও এখন পরিণত হয়েছে অপকর্মের হাতিয়ারে। সম্প্রতি রামু, হাটহাজারীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সাম্প্রদায়িক সহিংস হামলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিরাঙ্গায় আদিবাসীদের ওপর যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে, তার মূলেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পাশাপাশি স্বার্থান্বেষী মহলের ভূমি দখলের বদনজর যে ছিল, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। গত ২৭ আগস্ট সকালে মাদারীপুর শহরে যৌনকর্মীদের ওপর হামলা, তাদের বসতবাড়িতে লুটপাটসহ যে নির্মম ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে যে তাদের জমি ও সম্পত্তি জবরদখলের অভিপ্রায় কাজ করেছে, তা কারও কাছেই দুর্বোধ্য নয়। রাজধানীর কান্দুপট্টি ও নারায়ণগঞ্জের টানবাজার যৌনপল্লী উচ্ছেদের কাহিনী আমাদের জানা আছে। সেখানেও যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করে প্রভাবশালী মহল তাদের জমি ও বসতবাটি গ্রাস করেছে।
১৯ মাস ধরে \’ইসলাহে কওম পরিষদ\’ নামক একটি ধর্মাশ্রয়ী সংগঠন মাদারীপুর শহরের যৌনপল্লী উচ্ছেদের বিভিন্ন হুমকি দিয়ে আসছিল। সংগঠনটির নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেখা যায়, তারা যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন ও উচ্ছেদ দুই-ই করছেন। \’পুনর্বাসন\’ শব্দটি বিবৃতিবন্দি করে তারা বারবার যৌনকর্মীদের উচ্ছেদের হুমকি দিয়েছেন, তাদের শহর ছাড়া করে শহরকে \’পূতপবিত্র\’ করতে চেয়েছেন। আমার জিজ্ঞাসা, যৌনকর্মীরাই কি সমাজের সব অবক্ষয়ের জন্য দায়ী? সমাজে ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক, মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এসব সমাজপতির কোনো ভূমিকা আছে বলে শুনিনি। তাদের চোখে সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা যৌনকর্মীরা_ যারা সমাজের অনাচার-অত্যাচারের নির্মম শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে ঠাঁই নিয়েছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মম থাবায় প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। তারাই এখন ধর্মের ধ্বজাধারী, সমাজের কথিত শুদ্ধাচারীদের চক্ষুশূল! অথচ ভদ্রবেশী খদ্দেররা_ যারা যৌনকর্মীদের ঘরে আসা-যাওয়া করছে, তাদের হেদায়েত করার কোনো কর্মসূচি নেই।
আমি যৌনকর্মীদের ভিন্ন পেশা ও সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার বিরোধী নই। বরং সেটিকে মনে করি মহতী উদ্যোগ। এমন উদ্যোগ সীমিতভাবে হলেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও কিছু এনজিও-সামাজিক সংগঠনের রয়েছে। তাদের সঙ্গে যৌনকর্মীদের কখনও বিরোধ হয়নি। বরং এসব সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে যৌনকর্মীদের সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে_ ইসলাহে কওম পরিষদের সদস্যরা কি কখনও যৌনকর্মীদের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে তাদের কাছে হাজির হয়েছেন? না, এমন কথা শোনা যায়নি। বরং বিভিন্ন সমাবেশে তারা যৌনকর্মীদের প্রতি অবমাননাকর ও ঘৃণাসূচক বক্তব্যই দিয়েছেন। তবে ইসলাহে কওম পরিষদ শেষ কথা নয়। এর পেছনে আছে আরও লম্বা হাত। ইসলাহে কওম পরিষদ হয়তো সেই প্রভাবশালীদের হাতের হাতিয়ার।
এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা হতাশাব্যঞ্জক। বিভিন্ন সংবাদপত্রের বয়ানে জানা গেছে_ ইসলাহে কওম পরিষদের দাবির মুখে শহরের ২০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দিয়ে কমিটি করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন, যাদের কাজ হবে যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন। যুক্তির খাতিরে ধরে নিই এটি ভালো উদ্যোগ। তাহলে ওই ২০ ব্যক্তির কমিটির প্রাথমিক দায়িত্ব হতে পারত যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য অর্থায়নসহ সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি করা। সেখানে অভিজ্ঞ মোটিভেশন কর্মীদের মাধ্যমে যৌনকর্মীদের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল, তা না করে সেখানে তারা হাজির হয়ে তাদের পেশা ছেড়ে দেওয়ার নসিহত করেছেন, চাপ দিয়েছেন। এমন প্রস্তাব যৌনকর্মীদের কাছে দিলে তা প্রত্যাখ্যাত হওয়ারই কথা। তাই বলে যৌনকর্মীরা তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে বলে ইসলাহে কওম পরিষদ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে যে দাবি করা হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এটি রটিয়ে পরিকল্পিতভাবে যৌনপল্লীতে হামলা করা হয়েছে।
সহজেই আন্দাজ করা যায়, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন নয়, বিতাড়নের জন্য ইসলাহে কওম পরিষদের ব্যানারে কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। আর প্রশাসন ও সমাজপতিরা তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। এ লক্ষ্যে ৩১ আগস্ট যৌনকর্মীদের উচ্ছেদের জন্য ইসলাহে কওম পরিষদের পক্ষ থেকে সভা ডাকা হয়। এ জন্য ২৫ আগস্ট বিভিন্ন মসজিদ থেকে চাঁদাও তোলা হয়েছে। চাঁদা দেওয়ার জন্য সমাজপতিরাও মুসলি্লদের কাছে আবেদন করেছেন। বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন চাঁনমারী মসজিদে এক পুলিশ কর্মকর্তা চাঁদা আদায়ে উৎসাহী ভূমিকা পালন করেছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
ধর্মান্ধতা, তথাকথিত সামাজিক শুদ্ধাচারিতা আর জমির প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি একসঙ্গে মিলেছে। এই মিলিত শক্তির দানবীয় হামলায় বিপর্যস্ত হয়েছে মানবতা। লাঞ্ছিত হয়েছে ৫০০ নারীর মানবাধিকার। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘৃণ্য নজির সৃষ্টি করেছে মাদারীপুরের বিপথগামী তরুণ ও বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি, যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করে \’সওয়াব হাসিলে\’র এই মিছিলে অংশ নিয়েছে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার দলগুলোর কর্মীরাও।
এই বর্বরোচিত হামলার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বেদনাহত মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের বর্ণনা শুনে আমি হতবিহ্বল। মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে লাঠিপেটা করে বিতাড়িত করেছে উৎসাহী তরুণরা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি শিশুসন্তানরা। হামলাকারীদের ধর্মের নামে মানবশিশুদের হাত-পা ধরে ছুড়ে ফেলেছে। লাথির পর লাথি মেরে তৃপ্তি খুঁজেছে হামলাকারীরা। মেয়েরা যখন পালিয়ে ছুটছিল, তখন জাপটে ধরে গা থেকে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকাকড়ি কেড়ে নিয়েছে এক শ্রেণীর ভদ্রবেশী তরুণ। এভাবেই \’পাপী\’দের বিতাড়িত করে ওরা নিজেদের শুদ্ধ করেছে, সওয়াব কামিয়েছে \’নেকবান্দারা\’।
মাদারীপুর রাজনীতিসচেতন জনপদ, সেখানে মানবাধিকার সংগঠনের কর্মপরিধি বিস্তৃত। কিন্তু এ ঘটনার পর তাড়া খাওয়া নারীদের পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়নি। প্রধান রাজনেতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, এমনও শুনিনি।
পুলিশ কিছু তরুণকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু এর পেছনে উস্কানিদাতা ও ষড়যন্ত্রকারীদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয়নি। বরং স্বার্থান্বেষী সমাজপতিদের সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে চলছে পুলিশ ও প্রশাসন। অন্য ভাষায় বলা যায়, পুলিশ ও প্রশাসন প্রকারান্তরে ষড়যন্ত্রকারীদের সহযোগী হয়েছে।
এখন ঘটনার কুশীলবরা নিশ্চয়ই বিজয়ের হাসি হাসছেন। নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে, কৃতিত্বের সঙ্গে উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন, দীন-দুনিয়ার \’ফজিলত\’ কামাই করেছেন। এখন আত্মসুখে তারা হয়তো বিভোর। পক্ষান্তরে উচ্ছেদ হওয়া কয়েকশ\’ নারী কোথায় কী অবস্থায় আছে সে খবর আমরা রাখিনি। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, বাংলাদেশের নাগরিক, আমাদের বোন ও কন্যাসম এই মেয়েরা কী অসহায় অবস্থায় আছে এখন? তারা শহর-গ্রামে তাড়া খেয়ে ফিরছে, কী অবর্ণনীয় কষ্টে তাদের দিন কাটছে!
প্রশ্ন হচ্ছে_ ওদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই? এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের রায় আছে_ এ রায়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের পেশা অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে। সে রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদেরকে স্ব-স্ব গৃহে ফিরিয়ে আনা প্রশাসন ও পুলিশের দায়িত্ব নয় কি? সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য-সহযোগিতা করাও রাষ্ট্র ও সমাজের কর্তব্য। তা পালনে বিরত থাকা কোনো সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না।