ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ বা গোত্রের কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ রকম বহু ঘটনায় কলঙ্কিত হয়ে আছে পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনকাল। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেওয়া \’শত্রু সম্পত্তি আইন\’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ঘৃণ্য নজির।
এখানে \’শত্রু\’ মানে বিদেশি কোনো আক্রমণকারী গোষ্ঠী নয়। \’শত্রু\’ তাদেরকে বলা হয়েছে, যারা সে সময় দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়েছিলেন। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নর-নারীরা সেদিন কেন দেশত্যাগ করেছিলেন, এর কারণ সে সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নিহিত। এ লেখায় সে আলোচনায় যাওয়ার অবকাশ নেই। কেবল বলব, দেশ ছাড়লেই কেউ দেশের শত্রু হয় না। এ কারণে দেশের সন্তানদের শত্রু বলে চিহ্নিত করা অন্যায়। আরও বড় অন্যায় রাষ্ট্র কর্তৃক তাদের সম্পত্তি গ্রাস করা।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, এখন মুসলিমসহ সব সম্প্রদায়ের লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন কারণে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, সেখানে স্থায়ীও হয়েছেন অনেকে। তাদের সম্পত্তি কী হচ্ছে? তারাই মালিক থাকছেন। এটিই যৌক্তিক। দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় না। সে যা-ই হোক, সেদিন যে রাষ্ট্র এটি করেছিল, সে রাষ্ট্রের আর অস্তিত্ব নেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ শহীদের রক্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। সে দিনের পাকিস্তান এখন আমাদের কাছে মৃত। সেই মৃত পাকিস্তানের অপসৃষ্টিকে আমরা মুছে ফেলব, নাকি তা বহন করব_ সেটিই আজ গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা।
৪২ বছরে সেই অপসৃষ্টির সুরাহা হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে \’শত্রু সম্পত্তি\’ নাম পরিবর্তিত হয়ে এটি \’অর্পিত সম্পত্তি আইন\’ হয়েছে। শত্রু সম্পত্তি আইনের মতোই অর্পিত সম্পত্তি আইনের হুলও সংখ্যালঘুদের গায়েই ফুটছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ভুক্তভোগীরা সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কাছে ধরনা দিয়ে ফিরছেন। এর মধ্যে সাধুবাদ পাওয়ার ঘটনা, ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন প্রণীত হয়েছে। আইনটি স্পষ্ট করতে ২০১১ সালে দু\’বার, ২০১২ সালে একবার এবং ২০১৩ সালে আরেকবার, সর্বমোট চারবার সংশোধন হয়েছে। আইনের চতুর্থ দফা সংশোধনীর গ্যাঁড়াকলে ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু পরিবারগুলো নতুন করে আটকা পড়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন এসে যায়, একই আইন বারবার কার স্বার্থে সংশোধন করা হচ্ছে_ ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য, না সুবিধাভোগীদের স্বার্থরক্ষার জন্য?
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ জাতীয় সংসদে অর্পিত সম্পত্তি আইন রহিত করে \’দ্য এনেমি প্রপার্টি (কন্টিনিয়েন্স ইমারজেন্সি প্রভিশনস) (রিপিল) অ্যাক্ট ১৯৭৪ পাস হয়। পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন, ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পর আর কোনো সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা যাবে না, করা হলে তা অবৈধ। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? ভূমি মন্ত্রণালয় দুটি তালিকা প্রকাশ করেছে। একটি \’ক\’ এবং অপরটি \’খ\’। \’ক\’ তালিকার মধ্যে ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পরবর্তী সময়ের অনেক সম্পত্তি এবং \’খ\’ তালিকার পুরোটাতেই ১৯৭৪ সালের পরবর্তী সময়ের সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এ অভিযোগের সত্যতা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।
সমস্যাটি জটিল ও ভয়াবহ করে তুলছে একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী। ভূমি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কমকর্তা-কর্মচারীরা সংখ্যালঘুদের হাতে নতুন নতুন তালিকা ধরিয়ে দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, এ অপকর্মের সুযোগ করে দিয়েছে সংশোধিত আইন। সর্বোচ্চ আদালতের রায় অগ্রাহ্য করে ২০১৩ সালে আনা সংশোধনীর ৪ ধারায় মূল আইনের ৯(১) ও ৯(ক) সংযোজন করার মাধ্যমে নতুন করে ক ও খ তফসিলে তালিকাভুক্তির সুযোগ অবারিত করা হয়েছে। এটি আদালতের রায়ের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংশোধনীর একাধিক ধারায় উপেক্ষিত হয়েছে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ। তাই সুশাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে এসব সংশোধনী নতুন করে সংশোধন করার বিকল্প নেই।
সঙ্গত কারণেই \’খ\’ তালিকা পুরোটা এবং \’ক\’ তালিকার মধ্যে ১৯৭৪-এর ২৩ মার্চের পরের সংযোজিত অংশ বাতিল করা দরকার। সেসঙ্গে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১-এ জনস্বার্থবিরোধী যেসব সংশোধনী যুক্ত হয়েছে, তা বাতিলযোগ্য। এ ক্ষেত্রে মূল মালিকের অবর্তমানে সম্পত্তির ওপর সহঅংশীদারের অর্থাৎ যৌথ পরিবারের সদস্যদের অধিকার সমুন্নত রেখে আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।
সমস্যা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির। নীতিনির্ধারকরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের অধিকারের প্রশ্নে কতখানি আন্তরিক? এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, একাত্তরে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষ, সব জাতি-গোষ্ঠী, আদিবাসী একাট্টা হয়ে লড়াই করে স্বাধীনতা এনেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ একাত্তরের চেতনায় সব ধর্মের, সব মানুষের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারছে না। এটি রাখঢাকের ব্যাপার নেই যে, যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন দেশটি \’বাঙালি মুসলমানের\’ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারক বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন এটি \’বাংলাদেশি মুসলমানের\’ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বাস্তবে এই দুই প্রজাতির মধ্যে পার্থক্য নেই। এই সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যসুলভ মনস্তত্ত্বের কাছে
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ অপমানিত। এই মনস্তত্ত্ব থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুক্ত হতে না পারলে বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা কি আদৌ সম্ভব? এই নীতিনির্ধারকদের পক্ষে কী করে সম্ভব রাষ্ট্রের সব নাগরিকের প্রতি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা? এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলীয় স্বার্থও। অর্পিত সম্পত্তি তো শাসক দলগুলোর হস্তগত রয়েছে, কিংবা নতুন করে তাদের হস্তগত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তাই সমস্যা সমাধানে নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্ষুদ্র স্বার্থ দুই-ই পরিবর্তন খুবই জরুরি।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার, এ অঞ্চলের মানুষ তলোয়ার হাতে বিশ্বজয়ে বের হয়নি, বিদেশে গিয়ে লুণ্ঠনবৃত্তি করেনি। তবে একশ্রেণীর লোক দেশের মাটিতে যে অন্যায় ও লুটপাট করেছে, তা চিহ্নিত হওয়া এবং সেসবের জন্য ঘৃণাও প্রকাশ দরকার। ১৯৪৭ সালের পর হিন্দু সম্পত্তি ও ১৯৭১ সালের পর অবাঙালির সম্পত্তি দখলের ঘৃণ্য নজির তৈরি করেছে একদল সুবিধাবাদী লোক। এই দখলকারীরা সমাজে মাথা উঁচু করে আছে, তা তাদের প্রাপ্য নয়।
রামু-হাটহাজারীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধ মন্দিরে যে হামলা হয়েছে, তার পেছনে ধর্মান্ধতা ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির পাশাপাশি কাজ করেছে প্রভাবশালীদের সম্পত্তি দখলের লালসা। তাই কোথাও কোথাও হামলাকারীদের মধ্যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির ধারক জামায়াত-হেফাজতের কর্মীদের পাশাপাশি \’অসাম্প্রদায়িক\’ বিএনপি ও \’ধর্মনিরপেক্ষ\’ আওয়ামী লীগ কর্মীদেরও নির্লজ্জভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। রাজনীতির এই দুর্বৃত্তায়ন গণতন্ত্র ও জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে বড় হুমকি।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘুদের আশার বাণী শুনিয়েছে। সংখ্যালঘুরা আশা করেছে, আওয়ামী লীগ এবার তাদের সমস্যা দেখবে। কিন্তু আশায় আশায় আর কত দিন? সরকার মেয়াদের শেষ প্রান্তে এখন।
ধরা যাক, স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্পিত সম্পত্তির থাবা থেকে মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট সময় পায়নি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করতে করতে সময় গড়িয়ে গেল! প্রশ্ন হচ্ছে, এবার কেন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না? তবে কি আওয়ামী লীগ বা মহাজোট এটিকে আরেকবার নির্বাচনী ইস্যু করতে চাইছে? ব্যাপারটা কি এমন_ \’আপনারা আরেকবার আমাদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন, তখন আমরা অর্পিত সম্পত্তি আইনের থাবা থেকে আপনাদের মুক্ত করব।\’ এমনটি করা হলে তা হবে প্রতারণারই শামিল। বরং এমন কৌশল না নিয়ে মহাজোট সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান করবে, আইনগত জটিলতা দূর করবে, সেটিই প্রত্যাশিত।
আসলে অর্পিত সম্পত্তি আইনের সমস্যা কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের সমস্যা নয়, এটি জাতীয় সমস্যা। আর তা প্রতিকারে যে সংগ্রাম, সেটিও জাতির সম্মিলিত সংগ্রাম। সব দল, সব সচেতন নাগরিককে এটি উপলব্ধি করতে হবে, সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াতে হবে।