আমাদের অনেক অর্জন রাজনৈতিক ডামাডোলে ম্লান হয়ে যায়। সবকিছুর মধ্যেই ‘রাজনীতি’ ঢুকে পড়ে কিংবা ‘রাজনীতির’ প্রাবল্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় এজেন্ডাও গুরুত্ব হারায়। বলা বাহুল্য, আমি এখানে যে রাজনীতির কথা বলছি, তা হীন স্বার্থের রাজনীতি।
রাজনীতি এক মহৎ কর্ম_ যা সমাজকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে। মানুষের জীবনমান, শিক্ষা, গবেষণা সবকিছু এগিয়ে নেয়। রাজনীতি হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতির চালিকাশক্তি। আর বর্তমানের দলবাজির রাজনীতি হচ্ছে সব অগ্রগতির প্রতিবন্ধক। গত ১৮ আগস্ট এমন হীন রাজনীতির কবলে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ল সাদা পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বের ঘোষণাটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সাদা পাটের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) উদ্ভাবনের যে ঘোষণা দেন_ তা ছাপিয়ে ম্লান করে দিয়ে বড় হয়ে উঠল দলবাজির রাজনীতি। সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমেও রাজনৈতিক বিতর্কে খর্ব হয়ে পড়ল বিজ্ঞানীদের এই অনন্য কৃতিত্বের সংবাদ। এভাবে সবকিছুর ভেতর রাজনীতি ঢুকে পড়ায় রাজনীতিও নষ্ট হচ্ছে, বিঘি্নত হচ্ছে উন্নয়ন-অগ্রগতি।
১৮৩৫ সালে যুক্তরাজ্যের ডান্ডিতে পাট থেকে বস্ত্রতন্তু আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এটি রফতানিযোগ্য পণ্যে পরিণত হয়। তারপর থেকে পাটের বহুমুখী ব্যবহার শুরু হয়। কালক্রমে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে পাটের রাজা। ব্রিটিশ ভারতেই প্রশ্ন উঠেছিল, পাটের সুফল নিয়ে ডান্ডি-লন্ডনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। এর সুফল কতটুকু পাচ্ছে বাংলার কৃষক? ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত সত্ত্বেও পাটের মূল্য কৃষকের জীবনে পরিবর্তন এনেছিল। সেদিন বাংলার মুসলিম গেরস্ত ও শূদ্রের সন্তানরা পাটের অর্থে শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল, যা বদলে দিয়েছিল দেশের রাজনীতির সমীকরণ। দেশ বিভাগের পর সাতচলি্লশ থেকেই বাংলার রাজনীতিক, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন পাটের মূল্য ও মর্যাদার ব্যাপারে সচেতন। পাট থেকে পাকিস্তানের সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো। সেই অর্থের কতটুকু হিস্যা পূর্ব বাংলা পাচ্ছে_ সেটি ছিল সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন। পাকিস্তানের ২৪ বছরজুড়ে বাংলার মানুষের যে অধিকারের সংগ্রাম চলেছিল, তার মধ্যে কৃষকের জন্য পাটের ন্যায্যমূল্য ও পাট থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত ছিল।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ভাষার মর্যাদা, পাটের মূল্য প্রভৃতি অধিকারের প্রশ্নে যে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন এবং স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা এলো, সেই স্বাধীন বাংলাদেশে পাটের মর্যাদা রক্ষিত হলো না। এর অন্যতম কারণ, পরিত্যক্ত পাটশিল্পগুলো জাতীয়করণের পর তা পরিচালনায় অদক্ষতা ও লুটপাট_ পাটশিল্পের ওপর বজ্রপাত ঘটাল। তা থেকে উঠে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টা হলো না। বরং হাজির করা হলো জাতীয়করণকৃত কারখানাগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণের মধ্য দিয়ে আত্মসাতের অন্য কৌশল। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কাঠামোগত সংস্কারের এই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পাট ও বস্ত্রকলগুলো পানির দামে বিক্রি করা হলো। সর্বশেষ বন্ধ করে দেওয়া হলো সর্ববৃহৎ আদমজী পাটকলও। কেবল শ্রমিক ও বাম সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তখন প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল কেবল নীরবই ছিল না, দাতাদের মুরিদ হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল। দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী যারা আজ জাতীয় স্বার্থের কথা বলেন, তাদের অনেকেই সেদিন বামদের প্রতিবাদকে পশ্চাৎপদতা ও প্রলাপ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আশির দশক ও পরবর্তীকালের সংবাদপত্র খুললে সেদিনের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদদের বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ তথা আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর নির্লজ্জ দালালির নজির পাওয়া যাবে। এভাবে আমাদের পাট, বস্ত্রশিল্প ও এর সম্ভাবনা ধ্বংস করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে পরিচালিত সিনথেটিকের ব্যাগ-বস্তা-প্যাকেজিং বাজারজাতকরণের স্বার্থ। পরিবেশ বৈরী এসব ব্যাগ-বস্তা-প্যাকেজিং সামগ্রীর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে পাটপণ্যের উপযোগিতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার যে কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারের সীমাবদ্ধতা বোধগম্য। কিন্তু পাট ও পাটশিল্প প্রশ্নে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে বড় বিপর্যয় ঘটত না। বলা আবশ্যক, আশির দশকের মাঝামাঝি যখন বাংলাদেশের সীমান্তের নিকটবর্তী ভারতে নতুন করে পাটশিল্প গড়ে উঠছে, তখনও বাংলাদেশে পাটশিল্প ধ্বংসের মহড়া চলেছে।
বিলম্বে হলেও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পাট ও পাটশিল্প এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ এসেছে। এটি ইতিবাচক। সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক যে, একদল তরুণ বিজ্ঞানী সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছেন। মাকসুদুল আলম ও তার সহযোগীরা ২০১০ সালে তোষা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার করেছেন। তারপর তারা মনোনিবেশ করেন পাটের ক্ষতিকর ছত্রাক নিয়ে গবেষণা। ছত্রাকের জীবনরহস্য আবিষ্কারের পর তাদের লক্ষ্য ছিল সাদা বা দেশি পাট। এবার তারা দেশি পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন। সংবাদপত্রে মাকসুদুল আলমের একাধিক সাক্ষাৎকার পড়ে ভালো লেগেছে। তারা পশ্চিমা দুনিয়া থেকে শিক্ষা ও গবেষণায় তালিম নিয়ে দেশের এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে নিবেদিত হয়েছেন। তোষা পাট, দেশি পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য তাদের করতলে এখন। এটিকে কাজে লাগিয়ে দুই পাটকলে সংকর পাটের উদ্ভাবনের কথা ভাবছেন। পাটের রোগ প্রতিরোধ, উচ্চ ফলনশীল, দক্ষিণাঞ্চলের জন্য লোনাপানি সহিষ্ণু পাটবীজ উদ্ভাবনে তারা সচেষ্ট। মাকসুদুল আলম বলেছেন, দু’তিন বছরের মধ্যে কৃষকের হাতে উন্নত জাতের পাটবীজ পেঁৗছবে। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে এর সুফল আসবে। তখন এ থেকে কয়েক হাজার কোটি ডলার আয় করা যেতে পারে। এমন আশা দূরাশা নয়।
এখন পাটের বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। পাট থেকে কেবল বস্ত্র-কার্পেট নয়, কাগজ, কাপড়, আসবাবপত্র, ঘরের সাজসরঞ্জাম, এমনকি রেলের স্লিপারও তৈরি হচ্ছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহারে এগিয়ে আছে প্রতিবেশী ভারত। এ ব্যাপারে আমাদের ভাবতে হবে। পাটের ফলন বাড়লেই হবে না, পাটের বহুমুখী শিল্প গড়ার উদ্যোগও নিতে হবে। মনে রাখা দরকার, কৃষির সাফল্যের ক্ষেত্রে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন অপরিহার্য শর্ত।
বিজ্ঞানীদের ভাবনা এখন জিনোম গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার। সেটির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। আমাদের যে উদ্ভিদের বৈচিত্র্য আছে, সেসব নিয়ে গবেষণা ও নতুন নতুন আবিষ্কার জাতিকে পেঁৗছে দিতে পারে উন্নতির নতুন এক সোপানে, এগিয়ে দিতে পারে স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথে।
এ ক্ষেত্রে আবিষ্কারের মেধাস্বত্বের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আবিষ্কার যাতে হাতছাড়া না হয়, সে জন্য বাংলাদেশের প্যাটেন্ট স্বত্ব লাভ করতে হবে। এ চেষ্টাও থেমে নেই। ইতিমধ্যে বিশ্বমেধাস্বত্ব সংস্থার (ডবি্লউআইপিও) কাছে পাট তন্তুর কার্যকারিতা নিয়ে দুটি এবং ছত্রাকের ওপর তিনটি গবেষণা স্বত্বের আবেদন করেছে বাংলাদেশ। দেশি জাতের পাটের জীবনরহস্য উদ্ভাবনের স্বত্ব অর্জনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মাকসুদুল আলমের সাক্ষাৎকারে জানলাম, তিন তরুণ আইনজীবী মেধাস্বত্ব লাভের আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কর্মরত রয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আমাদের নিম, অর্জুন, তুলসীসহ বিভিন্ন ঔষধি উদ্ভিদ যা আবহমানকাল ধরে বাংলার মানুষ ব্যবহার করে আসছে, কিন্তু ভৌগোলিক নির্দেশক আইন না থাকায় বাংলাদেশ এগুলোর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। এসব ঔষধি গাছের নাম কেবল প্রতিবেশীদের ভৌগোলিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। ভারত এমন অনেক উদ্ভিদের প্যাটেন্ট স্বত্ব লাভ করেছে এবং প্যাটেন্ট স্বত্ব লাভের তাদের বেশ কিছু আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি বাংলাদেশ এককভাবে এবং কোনো কোনোটি ভারতের সঙ্গে যুক্তভাবে প্যাটেন্ট স্বত্ব লাভের অধিকারী। বাংলাদেশ এখনও প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, ইলিশ ও রাজশাহীর আমের প্যাটেন্ট স্বত্ব। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ তৎপর হবে_ সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।
এ ক্ষেত্রে বলতে ইচ্ছা হয়, বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। বিশ্ব উদ্ভাবন সূচকে (গ্গ্নোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স) বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়ে আছে_ বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম, সার্কের মধ্যে চতুর্থ। অথচ বাংলাদেশ জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, কুদরাত-এ-খুদাসহ আরও অনেক কৃতিমান বিজ্ঞানীর দেশ। বাংলাদেশ তাদের আবিষ্কার নিজেদের ভাণ্ডারে যুক্ত করতে পারেনি। যুক্ত করতে পারেনি বিশ্বে বহুতল ভবন স্থাপত্য-প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী ফজলুর রহমানের অবদানও। বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্বের বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর কর্মক্ষেত্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তার নামের সঙ্গেও বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হওয়ার কথা। জগদীশচন্দ্র বসু থেকে মাকসুদুল আলমসহ সব বিজ্ঞানীর অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে বিশ্ব উদ্ভাবন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ওপরে উঠে আসবে। নতুন মর্যাদায় ভূষিত হবে বাংলাদেশ।