হতাশার মাঝেও আমরা আশার আলো খুঁজি। সংঘাতময় পরিবেশেও কান পেতে থাকি_ শান্তির বারতা শুনব বলে। কিন্তু এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিছুদিন আগে ক্ষীণ আশার কথাই বলেছিলাম একটি টিভির গোলটেবিল বৈঠকে। একাধিক আলোচক ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের মুখোমুখি অবস্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। অনুরূপ উদ্বেগ আমারও। তারপরও নিবু নিবু আশা নিয়ে বললাম_ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-উত্তর দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও তৃতীয় মহাযুদ্ধ হলো না। স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যেই তারা ব্যস্ত থাকল। এমন হতে পারে, দুই জোট হুমকি-ধমকির মধ্য দিয়ে একে অন্যের ওপর স্নায়বিক চাপ সৃষ্টি করছে। শেষ পর্যন্ত তারা সংঘাতের পথে এগোবেন না। আলোচনার টেবিলে বসেই সমাধানে পেঁৗছবেন। কথার কথা বলিনি। মাঝে মধ্যে এমন ক্ষীণ সম্ভাবনার কথা ভাবি। পরক্ষণে তা শূন্যে মিলিয়ে যায়। মনে হয়, এমন হলে কতই না ভালো হতো।
৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে আমরা ১৬ কোটি মানুষ বাস করি। কৃষকের অক্লান্ত শ্রম ও মেধায় আমরা এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের যুবকরা বিদেশের শ্রমবাজারে ঘাম ঝরিয়ে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। দুনিয়া অবাক হয়ে দেখছে, গার্মেন্টশিল্পে মেয়েরা কী দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। বিদেশে সেচযন্ত্র, যা কেবল জমিতে পানি দেওয়ায় ব্যবহৃত হওয়ার কথা। এখানে সেচের বাইরে সেটি কখনও ধান-গম মাড়াই কল, কখনও নৌকার ইঞ্জিন আর কখনও সেটি হয়ে যায় সড়কপথের যান নছিমন-করিমনের পরিচালন-প্রযুক্তি। মোটর মেকানিকদের এক সম্মেলনে গিয়ে শুনলাম, বিদেশ থেকে নতুন নতুন মডেলের গাড়ি আসছে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার-কারিগর আসছে না। দেশের কারিগররা তা দেখে মাথা খাটিয়ে মেরামত করে। যন্ত্রপাতি পাওয়া না গেলে ধোলাইখাল থেকে অবিকল তা তৈরি করে দেওয়া হয়। এসব কারিগরের বড় অংশ সুবিধাবঞ্চিত কিশোর-তরুণ। অনেকেই পথশিশু_ ফুটপাতেই বেড়ে ওঠা। একজন প্রবীণ মিস্ত্রি বললেন, \’আমরা ওদের কাজ শেখাই। ওরা আমাদের ওস্তাদ বলে। কিন্তু কখনও কখনও ওদের কাছ থেকে আমরা শিখি। আমাদের আগেই বলে দেয়_ কোথায় কী সমস্যা হয়েছে।\’ আমার মনে হয়, যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব মেধাবী কিশোর-তরুণের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিলে বাংলাদেশ অনেক দূর যেত। একদিন চীন, জাপান, কোরিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে পারত। বাংলাদেশের তরুণরা পারে। বুয়েট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ার-চিকিৎসক-প্রযুক্তিবিদরা ইউরোপ-আমেরিকার গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়, হৃদয়ে জেগে আছে বাংলাদেশ। দেশের সেবা করতে তারা উন্মুখ। সুযোগ তৈরি হলে দামি চাকরি ছেড়ে দেশসেবায় নিয়োজিত হবেন। অনেক প্রযুক্তিবিদ দামি চাকরির মোহ ছেড়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সে কাজ করছেন। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় বেতনের পরোয়া না করে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা।
আমরা কি আমাদের মেধা, শ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে দেশটাকে গড়ে তুলতে পারি না? অগ্রসর প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে বাধা কোথায়? আমাদের উর্বর মাটি, খনিজসম্পদ ও সমৃদ্ধ সমুদ্র রয়েছে। তা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হতে পারে, উন্নয়নের ধারা জোরদার করতে পারে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি। একদা রাজনীতিই ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছে, স্বাধীনতা দিয়েছে, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। আজ হীনস্বার্থের কারণে রাজনীতিই উন্নয়নের বড় বাধা।
রাজনীতিবিদদের অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব_ সর্বদাই ক্ষমতায় থাকবেন, বিরোধী দলের আসনে বসবেন না। এ মানসিকতার পেছনে বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। তবে দুটি প্রণিধানযাগ্য। এক. রাজনৈতিক বাণিজ্য। রাজনীতি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার পরশে একশ্রেণীর রাজনীতিক বেহিসাবি সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, অভিজাত পল্লীতে বাড়ি, এমনকি লন্ডন-নিউইয়র্ক-টরেন্টো-সিডনিতে বাড়ির মালিক হচ্ছেন। দেশ-বিদেশের ব্যাংকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রাখছেন। সৎ রাজনীতিক নেই তা নয়। তবে তাদের সংখ্যা কমে আসছে। বিত্তশালীদের ধাক্কায় তারা ছিটকে পড়ছেন। দ্বিতীয়ত, সামন্তবাদী সংস্কৃতি। এসব রাজনীতিকের কাছে ক্ষমতা মানে রাজকীয় আসন, দেশসেবার ব্রত নয়। বিরোধী আসন থেকেও যে দেশসেবা করা যায়, এমন বোধ জাগ্রত নয়। তাই যে দলই ক্ষমতায় এসেছে_ ক্ষমতায় থাকার ফন্দিফিকির এঁটেছে তারা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফন্দিফিকিরে কাজ হয়নি। তার মূলে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। বর্তমান সরকার আদালতের রায়ের অজুহাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে, যা ক্ষমতা পরিবর্তনের গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে উঠেছে।
সরকার বলছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পক্ষপাত হয়নি, সাধারণ নির্বাচনে তারা পক্ষপাতিত্ব করবে না। বিরোধী জোট এ আশ্বাসে আশ্বস্ত হচ্ছে না। সরকার ও বিরোধী জোট স্ব-স্ব অবস্থানে অনড় রয়েছে। বিরোধী জোট জানিয়ে দিয়েছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের যে বিধান প্রবর্তিত হয়েছে, তা সুযোগের বৈষম্য তৈরি করবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না। তদুপরি নির্বাচন কমিশনও নিজের ক্ষমতা খর্ব করে অকেজো হয়ে পড়েছে, নিজেদের সরকারের আজ্ঞাবহ পরিণত করেছে।
এ পরিস্থিতিতে অর্থবহ নির্বাচন কি সম্ভব? অর্থবহ নির্বাচনের জন্য প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড জরুরি। সবার আগে দরকার সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণ। প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে যদি নির্বাচন হয় তা দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই অর্থবহ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের বিকল্প নেই। এ জন্য সংলাপ অত্যাবশ্যক। গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রাখতে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে তো বটেই, আরও কতিপয় প্রশ্নেও ঐকমত্য জরুরি।
ক. নির্বাচনের পর সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকা কী হবে? সরকার কি কাছে টানবে, না বিরোধী দলের প্রতি খড়্গহস্ত হবে? অন্যদিকে বিরোধী দল রায় মেনে নিয়ে সংসদে বসবে, না সংসদ বর্জন ও হরতালের রাজনীতি করবে? বিগত বছরগুলোতে বর্জন ও অসহযোগিতার রাজনীতি গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সংসদ একদলীয় সংসদে পরিণত হয়েছে। সেখানে দেশের উন্নয়ন, বিনিয়োগ, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কার্যকর আলোচনা হয়নি। সরকার ও বিরোধী দল কোন্দলে ব্যস্ত থেকেছে। আর জাতিকে ব্যস্ত রেখেছে তাদের \’কাজিয়া\’ দর্শনের জন্য। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে জাতির সামনে অঙ্গীকার করতে হবে যে, বিজয়ী দল বিরোধী দলের প্রতি খড়্গহস্ত হবে না এবং বিরোধী দলও সংসদ বর্জনের রাজনীতি করবে না।
খ. জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল সুবিধাবাদী ভূমিকায় রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মানের দোহাই পেড়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি অস্পষ্ট করে রেখেছে। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে। এ ব্যাপারে বিএনপির জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের বিকল্প নেই। যারাই ক্ষমতায় যাক না কেন, বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
গ. রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মান্ধ ও ধর্ম ব্যবসায়ী দলগুলোর সম্পর্কে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা জরুরি। এ দলগুলো গণতন্ত্র ও উন্নয়নবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। অথচ ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের নিয়ে প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে টানাটানি করছে। দেশের গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে ধর্মান্ধ শক্তির সঙ্গে সম্পর্কছেদ ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধেও একমত হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ জঙ্গিবাদের জন্মদাতা। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করা যাবে না।
ঘ. ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন। রামু, হাটহাজারীসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা জাতির অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তির ওপর কালো ছায়া ফেলেছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া থেমে আছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে জাতীয় সংহতি ও অগ্রগতি সম্ভব নয়।
জাতিকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হলে কালাকানুন বাতিল, তেল-গ্যাসসহ জাতীয় সম্পদের ব্যবহার, ভূমি ব্যবহার নীতিসহ অনেক বিষয়ে ঐকমত্য দরকার। তবে বর্তমানে অচলাবস্থার অবসান করতে হলে কমপক্ষে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে যেভাবে তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেরকম আন্তরিকতা নিয়ে উলি্লখিত বিষয়ে জাতীয় সনদ প্রণীত হলে তা হবে জাতির জন্য মঙ্গলজনক। বলা আবশ্যক, তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী অগ্রসর হলে গণতন্ত্র নতুন মাত্রায় উন্নীত হতো। কিন্তু কোনো দলই ক্ষমতায় এসে এটি বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখায়নি। পুরনো প্রসঙ্গ থাক।
আজকের বাস্তবতায় এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপিত হলে শাসন-প্রশাসনের প্রাথমিক বাধাগুলো দূর হবে। তৈরি হবে গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার পাশাপাশি এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্যে না আসতে পারলে দেখা যাবে যে, আবার পুরনো খেলা শুরু হয়েছে। সরকার বিরোধী দলের প্রতি খড়্গহস্ত হচ্ছে, বিরোধী দল সংসদে বসছে না, সংঘাতের রাজনীতি চলছে, ধর্মান্ধ শক্তিগুলো নিয়ে টানাটানি হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা হচ্ছে বিঘি্নত।
এ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় এজেন্ডায় ঐকমত্য হওয়া সময়ের দাবি। এগুলো পাশ কাটিয়ে সামনে পা বাড়ানোর সুযোগ নেই।