দেশের সব নাগরিকেরই রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার বা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার অধিকার আছে। তবে তা সংবিধান দ্বারা বিধিবদ্ধ। একই সঙ্গে তা রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত। ইচ্ছা করলে ব্রিটেনে কিংবা ফ্রান্সে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা রাজার ক্ষমতায়নের জন্য দল গঠন করা যায় না। জার্মানিতে নাৎসিবাদ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে রাজনীতি করা যায় না। তেমনি বাংলাদেশে একাত্তরে পরিত্যক্ত পাকিস্তানি ভাবাদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে কেউ রাজনীতি করার অধিকার পেতে পারে না। একইভাবে রাজনৈতিক অধিকার পেতে পারে না গণশত্রুরা_ যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী।
জার্মানিতে নাৎসি যেমন ঘৃণিত, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী একইভাবে ঘৃণিত। যেমন নাৎসি ও তার সহযোগী সংগঠনের হাতে গণহত্যার শিকার হয়েছে জার্মানবাসী, তেমনি জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি এবং এসব দলের নেতৃত্বে পরিচালিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল শামসের স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধ ও বর্বরতার স্বাক্ষর বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ। কালের ধারায় নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপি হারিয়ে গেছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী জামায়াত এখনও বহালতবিয়তে।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর জামায়াতের নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা প্রমুখের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। গোলাম আযমের ৯০ বছর ও কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্যদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে। আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চলছে। এ বিচার বহু আগেই সম্পন্ন হওয়ার কথা। বিলম্বে হলেও বিচার হওয়াটা আশাপ্রদ ঘটনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ঘৃণিত ব্যক্তির বিচার হলেই কি পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে জামায়াতে ইসলামী? যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের বিচার হবে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর বিচার হবে না_ তা কী করে হয়? দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিলে যে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটপাট করেছে, তা আর নতুন করে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
জামায়াত একাত্তরের বিভীষিকাময় নাম। যে নাম শুনে একাত্তরের প্রজন্ম আঁতকে উঠত। ক্ষোভে ও আক্রোশে ফেটে পড়ত, সেই দলটির স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার কি সমর্থনযোগ্য?
আমরা জানি, স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমায় যুদ্ধাপরাধীরা গা বাঁচাতে পারলেও রাজনীতি করার অধিকার পায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ ও পিডিপি একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল। অতঃপর দ্বিতীয়বারের মতো ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সব ধর্মভিত্তিক দলই নিষিদ্ধ হয়।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সুযোগে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে যুদ্ধাপরাধীরা রাজনীতিতে এসেছে। কিন্তু তখন জামায়াতে ইসলামী স্বনামে রাজনীতির লাইসেন্স পায়নি। সেদিন নেজামে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামী একত্রিত হয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে রাজনীতি করার অনুমতি লাভ করে।
পরবর্তী সময়ে জাতীয় অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে জামায়াত স্বনামে আত্মপ্রকাশ করে। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো এ দলটিকে মোকাবেলা করেনি; বরং এটিকে নিয়ে টানাটানি করেছে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েমের আন্দোলনে জামায়াতকে সহযোগী করেছে। বিএনপি নিজামী-মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দিয়েছে। শাসকের এসব ভ্রান্ত পদক্ষেপে জনগণের সমর্থন মেলেনি, বরং একাত্তরের বিজয়ী জাতিকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই_ বিগত নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির অন্যতম কারণ জামায়াতপ্রীতি। নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী করায় জনমনে যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল, এ পটভূমিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ওয়াদা করার কারণে মহাজোটের পক্ষে গণজোয়ার বেগবান হয়েছিল। নতুন প্রজন্ম, নারী, আদিবাসী, সংখ্যালঘুসহ একাত্তরের চেতনায় উদ্বেলিত জনগোষ্ঠী মহাজোটকে বিজয়ী করেছে। মহাজোট ক্ষমতার শেষ লগ্নে হলেও বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এজন্য মহাজোট সরকারের সাধুবাদ প্রাপ্য। এ বিচার প্রক্রিয়া ব্যক্তির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে, না যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতেরও বিচার হবে_ তা স্পষ্ট নয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নুরেমবার্গ ট্রায়ালে কেবল যুদ্ধাপাধীদের নয়, নাৎসি ও সহযোগী দলগুলোরও বিচার হয়েছিল। জামায়াত ও তার সহযোগীদের জন্য এ দৃষ্টান্ত অনুসরণযোগ্য। বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের একাধিক রায়ে জামায়াতকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী বলা হয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণে জামায়াত যুদ্ধাপরাধী। তা ছাড়া গোলাম আযমের রায়ে জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল’ সংগঠন বলা হয়েছে।
এটি বিবেচনার বিষয়_ লাখো শহীদের রক্তস্নাত বাংলায় বিতর্কিত ও অপরাধপ্রবণ জামায়াতের রাজনীতি করার অধিকার আছে কি-না? অন্তত তিনটি কারণে জামায়াতের রাজনীতি করার অধিকার নেই। এক. এটি যুদ্ধাপরাধী দল, যা আদালতের রায়ে প্রতিভাত হয়েছে; দুই. ক্রিমিনাল ও জঙ্গি সংগঠন। দলটির বিভিন্ন জঙ্গি কানেকশন রয়েছে। কেবল একাত্তরের পটভূমিতে নয়, স্বাধীন বাংলাদেশেও জামায়াত সন্ত্রাসী ও অপরাধী সংগঠন হিসেবে নিজেদের বারবার প্রমাণ করেছে। রগকাটা, গলাকাটার রাজনীতি করেছে এবং এখনও করছে। যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের পর আমরা কী দেখেছি? রেললাইন উপড়ে ফেলা, রেলের বগিতে আগুন দেওয়া, বিদ্যুৎ প্রকল্প ধ্বংস করা, পুলিশের ওপর হামলাসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তারা। জামায়াতের ধ্বংসযজ্ঞের তুলনায় জেএমবি ও হিজবুত তাহ্রীরের অপকর্ম কোনোক্রমেই বেশি নয়। সন্ত্রাসী-জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জেএমবি, হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হলে জামায়াত নিষিদ্ধ করতে বাধা কোথায়? তৃতীয়ত, জামায়াতের রাজনীতি সংবিধানের পরিপন্থী।
১ আগস্ট হাইকোর্ট সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছেন। কারণ, এটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ৯০(বি)(এ)(বি)(২) এবং ৯০(সি) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সংবিধানের পরিপন্থী। এ ধারাগুলো অনুযায়ী এক. কোনো দল যদি সংবিধানের পরিপন্থী হয়। দুই. দলের গঠনতন্ত্রে কোনো বিশেষ ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, ভাষা বা লিঙ্গভেদে কোনো বৈষম্য প্রতীয়মান হয়। তিন. দলের নাম, পতাকা, চিত্র বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ড দ্বারা সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিনষ্ট হওয়া কিংবা দেশকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। চার. দলের গঠনতন্ত্রে দেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে যা দফতর, শাখা, কমিটি গঠন কিংবা পরিচালনার বিধান থাকে। এসব লক্ষণ বা চরিত্র প্রতীয়মান হওয়ায় আদালত রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌল নীতি হচ্ছে গণতন্ত্র, জনগণের সার্বভৌমত্ব যার মর্মবাণী। কিন্তু জামায়াতের রাজনীতি তা স্বীকার করে না। সেখানে জামায়াত ধর্মীয় আইনকে অলঙ্ঘনীয় বলছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মানুষের মধ্যে বিভাজন রেখা টানছে। অমুসলিম ও নারীর নেতৃত্ব অস্বীকার করছে, যা বাংলাদেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর মতবাদ হচ্ছে জামায়াতের নীতি। মওদুদী মতবাদ অনুযায়ী অমুসলিমদের নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান নেই। সেখানে ধর্মীয় অনুশাসনই তার লক্ষ্য। পক্ষান্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ কায়েম হয়েছে। যেখানে ধর্ম ও রাজনীতি এক রেখায় মিলিত হবে না। রাজনীতি হবে ধর্মের প্রভাবমুক্ত। এখানে কে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হবেন_ তিনি নারী না পুুরুষ, কোন ধর্মবিশ্বাসী, তা বিবেচিত হবে না। এই সার্বজনীনতা গণতন্ত্রের মর্মকথা। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। তা কখনও মৌলবাদী বা ধর্মীয় রাষ্ট্র হয় না।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে_ বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান আছে, তা ধর্মাশ্রিত রাজনীতিকে অনুমোদন করে কি-না। বলাবাহুল্য, সংবিধানে ২(ক) অনুচ্ছেদে যে রাষ্ট্রধর্মের সংযোজন করা হয়েছে, তা রাষ্ট্র পরিচালনা নীতির অন্তর্ভুক্ত নয়। অতএব এ দোহাই দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ব্যত্যয়ের সুযোগ নেই। এ ধরনের যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকার পরও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হচ্ছে না। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পর সরকার ও বিরোধী দল একই সুরে কথা বলছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, কোনো দল নিষিদ্ধের নীতি তারা সমর্থন করেন না। তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধের ইচ্ছা তাদের নেই। এর পক্ষে সাফাই গাইছেন বিদেশি কোনো কোনো সংবাদপত্র ও দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী। তাদের যুক্তি_ জামায়াত নিষিদ্ধ হলে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাবে। বাস্তবে কি জামায়াত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের বিরত রাখছে? এ যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র আল কায়দার প্রতি সদয় হয়নি। জার্মানরা নাৎসি দল নিষিদ্ধের উদ্যোগ থেকে বিরত থাকেনি। এমন দৃষ্টান্ত থাকার পরও কেন বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী ও অপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে নতুন নতুন অপরাধের সুযোগ করে দেবে, তা বোধগম্য নয়।
দেশের সামগ্রিক স্বার্থেই জামায়াত নিষিদ্ধ করা জরুরি। কোনো যুক্তিতে এ দাবি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।