ecসমগ্র জাতি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়নের জন্য সোচ্চার। এমনকি ক্ষমতাসীন দলও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে তাদের অবস্থান যৌক্তিক প্রমাণ করতে বলছে_ নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন, এটি সরকারের কাজ নয়। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর ক্ষমতা দেওয়া হবে। অথচ কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করতে তৎপর। এর মাজেজা বোঝার আগে প্রেক্ষাপট ও ইসির প্রস্তাবগুলো খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
ইতিপূর্বে দলীয় সরকারের অধীনে যখন নির্বাচন হতো, তখন নির্বাচন কমিশন ছিল সরকারের আজ্ঞাবহ। কমিশনের সদস্যদের যে স্বাধীন মনোভাব ছিল না, তা নয়। তবে সে বাস্তবতা ও আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বনের সুযোগ ছিল সীমিত। \’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। তবে ২০০৫ সালে বিচারপতি আবদুল আজিজ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর এই সাংবিধানিক মর্যাদাবান প্রতিষ্ঠানটি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের ঘৃণ্য নজির সৃষ্টি করে, সেসব ঘটনা সবারই জানা। ওই কমিশনের সরকারঘেঁষা ভূমিকার জন্য \’আজিজ মার্কা\’ নির্বাচন কমিশন এখনও খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ২০০৭ সালে ব্যাপক গণরোষ ও প্রতিবাদের মুখে বিচারপতি আজিজের স্থলে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে নতুন কমিশন গঠিত হয়। সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও ওই কমিশনের ভূমিকা ও অর্জন যথেষ্ট প্রশংসনীয়। তারা নির্বাচনী বিধির সংস্কার ও যৌক্তিক অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন স্বকীয় ধারার ওপর দাঁড় করান। এখানে উল্লেখ্য, বিএনপি এটিএম হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ সত্ত্বেও তারা দলটির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং তাদের আস্থায় আনতে পেরেছিলেন। হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাব ছিল। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বলতে শুরু করেন যে, কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা সংস্কারের নীতিও ত্যাগ করেন।
হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০০৯ সালে নির্বাচন আইনের পরিবর্তন আনতে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব করে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে_ নির্বাচনকালে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কার্যক্রমে নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। এটি না হলে দেখা যাবে, নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পাচ্ছে না। যানবাহন মিলছে না। সেখানে যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তা হচ্ছে না। সবকিছুর জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারের কর্ম বিভাগগুলোর কোনো সিদ্ধান্ত নির্বাচনকে প্রভাবিত যেন করতে না পারে, সে বিবেচনায়ও এটি জরুরি। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশ যেখানে পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তকমা এঁটে আছেন, সেখানে নির্বাচনকালে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবেশী ভারতেও সাধারণ নির্বাচনকালে পুলিশ ও পার্লামেন্টসহ কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে পরিচালিত হয়।
বর্তমান কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনবিধি লঙ্ঘনের জন্য কর্মরত নিরাপত্তা বাহিনীর গ্রেফতারের ক্ষমতাও হ্রাস করেছে। সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে_ নির্বাচন কমিশন ৯১-ই ধারাটি অস্পষ্টতার অজুহাত দেখিয়ে বাতিলের সুপারিশ করেছে।
এর আগে আমরা প্রার্থীদের অসদাচরণের অনেক নজির দেখেছি। ম্যাজিস্ট্রেটের গায়ে হাত তোলাসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। প্রার্থী ও সমর্থকরা নির্বাচনী আইন এবং আচরণবিধির পরোয়া না করে যথেচ্ছাচার করেছেন। সে বিবেচনায় আইনটি ছিল নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি বড় অস্ত্র, যা বেপরোয়া প্রার্থীদের বশে রাখার জন্য খুবই কার্যকর। কিন্তু এটি তুলে দেওয়ার যুক্তি হিসেবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন, যে আইন প্রয়োগ করা যায় না_ তা রেখে কী লাভ? এ যুক্তিতে পরমাণু শক্তিধর দেশেরও পারমাণবিক বোমা রাখার যুক্তি নেই। কেননা, ওগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে না। কমিশনের ভিন্ন যুক্তি হচ্ছে ৯১-ই অনুযায়ী, একজন প্রার্থী থাকলে সে ক্ষেত্রে পুনরায় নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনের যুক্তি_এতে বৈধ প্রার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর জবাবে বলা যায়, আরপিও ১৭ ধারা অনুযায়ী কোনো প্রার্থীর মৃত্যু হলেও নতুন করে নির্বাচন করতে হয়। তখন কি অন্য প্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন না? সিইসি বিষয়টি আরপিও ১৯ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলছেন। ১৯ ধারা অনুযায়ী সদস্যপদ বাছাইয়ের একক প্রার্থী বৈধ হলে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। আমার বিবেচনায় ১৯ ধারা সংশোধনযোগ্য। যদি কোনো দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে বাদ পড়েন, তবে সে দলের প্রতিনিধিত্ব শূন্য হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ওই দলের বিকল্প প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ অবারিত রাখাই অধিকতর গণতান্ত্রিক।
ইসি সংসদ নির্বাচনে ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ করার সুপারিশ করেছে। যেখানে সচেতন মহল থেকে নির্বাচন ও রাজনীতি অর্থ ও পেশিমুক্ত করার জোর দাবি রয়েছে। এ নিয়ে সভা-সেমিনার হয়েছে এবং হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে। এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী আচরণবিধিও পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে বিগত সাধারণ নির্বাচনগুলোতে সভা-সমাবেশ, মাইকের ব্যবহার, দেয়াল লিখন, রঙিন পোস্টার সাঁটানো, তোরণ নির্মাণ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। প্রকাশ্যে চাঁদা ও অনুদানের প্রবণতাও কমেছে। এই অগ্রগতির পরও ইসি কেন নতুন করে ব্যয়ের অঙ্ক বাড়াল? এর একটাই যুক্তি, ৯১-ই তুলে দেওয়ার পর প্রার্থীরা বেপরোয়া হয়ে উঠবেন, অতিরিক্ত ব্যয়ে উৎসাহী হবেন। সে বিবেচনায় ব্যয়ের অঙ্ক না বাড়িয়ে উপায় কী! আর নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না থাকলে ব্যয়ের সিলিং রাখা না রাখা সমার্থক।
বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে অর্থ ও ধর্মের ব্যবহার এবং সাম্প্রদায়িকতা নিয়ন্ত্রণে ইসি ছিল নির্বিকার। এ নিয়ে লিখেছি। নতুন করে বয়ান না-ইবা করলাম। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ইসি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামাল দিতে পারেনি দৃঢ়তার অভাবে, জাতীয় নির্বাচনে সে ইসি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে, সে গ্যারান্টি কোথায়!
নির্বাচনের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজনৈতিক দল। কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দলগুলোর সঙ্গে তো বটে, এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজের সঙ্গেও আলোচনা করা উচিত। সে রেওয়াজ চালু হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান ইসি কারও ধার না ধেরে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, না কারও আজ্ঞাবহ হয়ে এটি করছে, সেটিই আজ উদ্বেগের বিষয়। বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইসি স্বাধীন সত্তা হারিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো নির্বাচনকালীন ক্ষমতার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে। সে ক্ষেত্রে সংবিধানের দোহাই পেড়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বর্ণিত পদ্ধতিতে নির্বাচন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ ২০ মন্ত্রীকে নির্বাচনে প্রচারের সুযোগ দেওয়ার জন্য আচরণবিধির সংশোধনের উদ্যোগ কি পক্ষপাতদুষ্ট নয়? এ ব্যাপারে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সংলাপ ও সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করা কি ইসির জন্য যুক্তিসঙ্গত নয়?
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা যেন স্বেচ্ছায় নিজেদের সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ছড়া \’বাবুরাম সাপুড়ে\’র নিরীহ প্রাণীতে পরিণত করতে চায়। ছড়াটিতে বাবুরাম সাপুড়ের কাছে এক শিশুর আবদার প্রকাশ পেয়েছে। সে আবদার হলো, খেলার জন্য সে এমন সাপ চায়_ \’যে সাপের চোখ নেই,/শিং নেই নোখ নেই,/ছোটে না কি হাঁটে না,/কাউকে যে কাটে না/ করে নাকো ফোঁসফাঁস/ মারে নাকো ঢুশঢাশ…।\’ কাজী রকিবউদ্দীনের নির্বাচন কমিশনও কারও আবদার রক্ষায় যে এমন নিরীহ প্রাণী হতে চাইছে, তা বোধহয় কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।
কারও আবদার রক্ষা বা নিজেদের মর্জি_ যে কারণেই হোক, নির্বাচন কমিশনের এই সংস্কারবিরোধী মনোভাব নির্বাচন ও গণতন্ত্রের জন্য অশুভ সংকেত হয়েই দেখা দেবে, যা কারও কাম্য নয়।