দুই মেরুর মাঝে প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় অবস্থান আছে। সাদা ও কালোর মাঝে আছে রঙের বহু বর্ণিল সমাবেশ। নীতিনির্ধারণ বা মতামতের ক্ষেত্রে এমন বাস্তবতা বিবেচনাযোগ্য। তাই মতামতের ক্ষেত্রে সর্বদাই দক্ষিণ বা উত্তর মেরু, সাদা বা কালো_ এভাবে বিভক্ত অবস্থান যৌক্তিক নয়। কর্মকমিশনের নিয়োগে সাম্প্রতিক কোটার পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্কের ক্ষেত্রে দুই মেরুতে ভাগ হয়ে যাওয়া সঠিক নয়। অনেকেই প্রশ্ন করেন_ আপনি কি কোটা ব্যবস্থার পক্ষে, না বিপক্ষে? এক কথায় এর কোনো উত্তর নেই। কারণ, সমাজ অগ্রগতির ধারায় যেমন মেধার প্রতিযোগিতা থাকা দরকার, তেমনি পিছিয়ে পড়া অংশকেও এগিয়ে আনা দরকার।
বর্তমান নিয়োগ ব্যবস্থায় শতকরা ৫৬ ভাগ কোটাভিত্তিক (মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য ৩০, জেলা কোটা ১০, নারী ১০, আদিবাসী ৫ এবং প্রতিবন্ধী ১)-এর বাইরে শতকরা ৪৪ ভাগ মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতার জন্য অবারিত। এ নিয়ে সাধারণ প্রতিযোগীদের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত ছিল। এবার ৩৪তম বিসিএস ব্যাচে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে।
ইতিপূর্বে প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক পরীক্ষা চূড়ান্ত হওয়ার পরে কোটা প্রয়োগ করা হতো, এবার প্রিলিমিনারিতেই তা প্রয়োগ করায় উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার পরপরই কর্মকমিশন আগের ব্যবস্থা বাতিল করে পূর্বের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করেছে। কিন্তু অংশগ্রহণকারীদের ক্ষোভ থামেনি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। কোটা বাতিলের দাবি উঠেছে। বিষয়টি আদালতেও গড়িয়েছে।
কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তনের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। ব্রিটিশ ভারতেই নেতৃবৃন্দ ভেবেছিলেন, চাকরিসহ সব ক্ষেত্রে অগ্রসর বর্ণ হিন্দু আর অনগ্রসর মুসলিম ও তফসিলি সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব কীভাবে ঘোচানো যায়। সে লক্ষ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম নেতাদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর ১৯২৩ সালে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। সেটি \\’বেঙ্গল প্যাক্ট\\’ নামে পরিচিত। চুক্তিটি স্বরাজ পার্টি ও কংগ্রেসের প্রাদেশিক সভায় অনুমোদিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে অন্যান্য দাবির সঙ্গে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয় যে, শতকরা ৫৫ ভাগ পদ পাবে অবিভক্ত বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়। যতদিন ওই অনুপাতে না পেঁৗছবে, ততদিন মুসলমানরা সরকারি চাকরির শতকরা ৮০ ভাগ এবং হিন্দুরা অবশিষ্ট ২০ ভাগ লাভ করবে। এতে ক্ষিপ্ত হয়েছিল হিন্দু সমাজ। দেশবন্ধুকে \\’মুসলমানদের দালাল\\’ বলে আখ্যায়িত করেছিল সংক্ষুব্ধরা। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও দেশবন্ধুর বিরোধিতা করেছিলেন। দেশবন্ধু তার নীতিতে অটল ছিলেন। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধুর অকালমৃত্যুতে বেঙ্গল প্যাক্ট আর নিয়োগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণের বিষয় থাকল না। তবে আজ ইতিহাসবিদ-চিন্তাবিদরা বলছেন যে, দেশবন্ধুর পথে অগ্রসর হলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দেয়াল উঠত না, দেশ ভাগ হতো না। এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
বেঙ্গল প্যাক্ট অনুযায়ী না হলেও মুসলমান ও তফসিলিসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা ব্রিটিশ ভারতেই প্রবর্তিত হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানিদের চাকরির ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল। সরকারি চাকরিতে সীমিত আকারে কোটাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও বৈষম্য থেকেই যায়। যা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছে।
প্রতিবেশী ভারতে এখনও নিয়োগ সংরক্ষণের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ১৯৭৯ সালে সরকারি চাকরি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ বিভিন্ন সুযোগ প্রদানের বিষয়টি নির্ধারণে বিপি মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি কমিশন করা হয়, যেটি মণ্ডল কমিশন বলে পরিচিত। সেখানে চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে অনগ্রসর অংশের সংরক্ষিত কোটা শতকরা ২৭ ভাগ থেকে ৪৯.৫ ভাগে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে সেটি পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে জাতির অতীত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন রয়েছে। সেই আলোকেই সরকারি চাকরিতে নিয়োগ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মনিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে। একই অনুচ্ছেদের (৩) উপ-অনুচ্ছেদে অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব করতে পারে_ সেদিকে দৃষ্টি রেখে নিয়োগ সংরক্ষণের কথাও বলা হয়েছে। ২৮(৪) অনুচ্ছেদে একই নির্দেশনা প্রতিফলিত হয়েছে। পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সংবিধানের নির্দেশনা যৌক্তিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ ও সংরক্ষিত বিন্যাস কী হবে?
শুরুতেই আদিবাসী কোটার বিষয়টি বিবেচনায় আনা যাক। (উল্লেখ্য, সরকারের নথিপত্রে \\’আদিবাসী\\’ নেই। এ জনগোষ্ঠীকে ইতিপূর্বে উপজাতি, এখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই আমি তাদের আদিবাসীই বলছি)। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী থেকে পিছিয়ে আছে। প্রশাসনে তাদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে নিয়োগ কোটা অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। যতদিন পর্যন্ত চাকরির ক্ষেত্রে সমতা না আসছে, ততদিন পর্যন্ত এটি বহাল রাখাই যুক্তিযুক্ত।
দেশের নারীরা এগিয়েছে, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে এ পর্যায়ে নারী কোটাও তুলে দেওয়া উচিত নয়। মানবাধিকারের প্রতি সম্মান রেখেই প্রতিবন্ধী কোটা বহাল রাখতে হবে, যা সব সময়ের জন্য সংরক্ষিত থাকা প্রয়োজন। এর বাইরে আমি মুচি-চর্মকার-বুনো-ধাঙ্গড় যাদের এক কথায় দলিত শ্রেণী বলা যায়, তাদের জন্য কোটা প্রবর্তনের বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য মনে করছি। কেউ বলতে পারেন, যখন কোটা তুলে দেওয়ার দাবি উঠেছে, তখন নতুন করে কেন দাবি তুলছি? কারণ এই অংশটি সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। তবে কোনো বিবেচনাই কোটা সাধারণ প্রতিযোগিতার চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয়। আজকের বাস্তবতায় নারী-আদিবাসীসহ পিছিয়ে পড়া অংশের সংরক্ষিত কোটা ২৫-৩০-এ নামিয়ে আনাই সঙ্গত। সেই ২৫-৩০-এর মধ্যে দলিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
আজকের বিবেচনায় জেলা কোটার কোনো প্রয়োজন নেই। একদা কুমিল্লাসহ দু\\’একটি জেলার সঙ্গে অন্যান্য জেলার বৈষম্য দৃশ্যমান ছিল, এখন সেটি আগের অবস্থায় নেই। সে ক্ষেত্রে এটি তুলে দেওয়াই সঙ্গত।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আসা যাক। বিষয়টি স্পর্শকাতর মনে করে অনেকেই মন্তব্য থেকে বিরত থাকেন। আবার কেউ কেউ সুযোগ বুঝে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানসিকতা উগড়ে দেন। কোটাপ্রথা বাতিলের মিছিলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে ধ্বনি উঠেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি হয় অজ্ঞানতা, না হয় রাজাকারসুলভ মানসিকতার পরিচায়ক, যা কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে আমার একবিন্দু শিশিরসম ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে বলব, কোনো মুক্তিযোদ্ধাই প্রাপ্তির জন্য যুদ্ধ করেননি। তাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তবে মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের পরিবার, আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রের করণীয় ছিল, পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল।
দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, স্বাধীনতার পর পাকিস্তান সরকারের রেখে যাওয়া প্রশাসন দিয়ে দেশ গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হলে প্রশাসনের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যারা জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা আনলেন_ কোনো শাসনামলে তাদের সঠিক মূল্যায়ন হলো না। স্বাধীনতার ৪২ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধারা নানাভাবে লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়েছেন। শহীদ পরিবার, যুদ্ধাহত ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব পালন করা উচিত ছিল, তা কোনো সরকারের আমলেই করা হয়নি। তবে স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে কোটা প্রবর্তন করা হয়েছিল, সেটি ছিল একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ। এটি নিয়ে কখনও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু সেটি মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান পর্যন্ত বাড়ানো যৌক্তিক কি-না, সে বিতর্ক তখনই দেখা দিয়েছিল সঙ্গত কারণেই। সেদিন এই ভেদরেখা টানা উচিত ছিল না।
এখন মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যর জন্য চাকরির কোটা আছে, কিন্তু তা পূরণ হয় না। কারণ, বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই অর্থনৈতিক দুর্ভোগের মধ্যে দিন গুজরান করছেন। তারা তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা দিতে পারেননি। যে কারণে তাদের অধিকাংশের সন্তানরা এ সুযোগ গ্রহণে অপারগ। তাই অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা নয়, জীবিকার ব্যবস্থা করাই আজ জরুরি।
বর্তমান সরকার সন্তানের পরিবর্তে পোষ্য করে নাতি-নাতনির ক্ষেত্রে এই সুযোগ সম্প্রসারিত করেছে। তখনই আমি এর প্রতিবাদ করে লিখেছিলাম যে, এটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর জন্য সম্মান বয়ে আনবে না, বরং প্রশাসনে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিভাজন রেখা দেখা দেবে। আমি এ বক্তব্যে এখনও অটুট।
প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে কোটা রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অবমাননাকর। এ সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রত্যাহারযোগ্য। কেবল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সন্তানদের ক্ষেত্রে সংরক্ষণনীতি কার্যকর থাকতে পারে। তবে সেটি কমিয়ে এনে ৩০ শতাংশের স্থলে ১০ শতাংশ করাই যুক্তিযুক্ত।
জেলা কোটা বাতিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা ১০ শতাংশে কমিয়ে আনলে সে ক্ষেত্রে সংরক্ষিত কোটা শতকরা ২৬ ভাগে এসে দাঁড়াবে। কোনো বিবেচনায় এটি ৩০ শতাংশের অধিক হওয়া উচিত নয়। আর চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পরেই কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। কোনো কোটায় পদ শূন্য থাকলে তা সাধারণ মেধা তালিকা থেকে পূরণের বিধান বাঞ্ছনীয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রশাসনে নারীসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি মেধা ও যোগ্যতার বিষয়টিও বিবেচ্য।