gspবাণিজ্যের সঙ্গে রাজনীতির যোগ আছে। কোনো দেশেরই রাজনীতির প্রভাবমুক্ত বাণিজ্যনীতি নেই। সে বিবেচনায় ওবামা প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা যে (জিএসপি) স্থগিত করেছে, তা-ও হয়তো রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে নয়। তবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, \’বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করাই শ্রেয়। তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নের কোনো পদক্ষেপ বাংলাদেশ নেয়নি, নিচ্ছে না।\’ একই যুক্তিতে একাধিক সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য বাংলাদেশের পণ্যের অগ্রাধিকার সুবিধা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষা ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তাজনিত শর্ত পূরণ না করায় ২০০৭ সাল থেকে জিএসপি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছিল \’আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন\’ (এএফএলসিআইও)। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর এএফএলসিআইও\’র আবেদনটির ওপর কয়েক দফা শুনানির পর মার্কিন প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
মার্কিন প্রশাসন যে শ্রমিকদের অধিকারের দোহাই পেড়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে শ্রমিকরাই হবে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের এই শিল্পের কর্মীরা (যার শতকরা ৯০ ভাগই নারী) কাজ হারাবে, আরও দুর্দশায় পড়বে তারা।
মার্কিন প্রশাসন শ্রমমান উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপে সন্তুষ্ট নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে দেশবাসী কি সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট ও যৌক্তিক মনে করছেন? দেশের অর্থনীতিতে গার্মেন্ট শিল্পের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু এখানে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, মজুরি ও ট্রেড ইউনিয়ন না থাকায় ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। গার্মেন্ট শিল্পের সাফল্য অব্যাহত রাখতে এ বিষয়গুলোর যে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তা দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো মালিক নিজের গরজে কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশের উন্নয়ন করেছেন, \’কমপ্লায়েন্স\’ অনুসরণ করছেন। কিন্তু সামগ্রিক চিত্র হতাশাব্যঞ্জক। এ অবস্থার উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মার্কিন প্রশাসন থেকে যে তিন শর্তের কথা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে_ শ্রম আইন সংশোধন করে তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ, কর্মপরিবেশের দৃশ্যমান উন্নতি এবং ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিতকরণ। মার্কিন ফরমায়েশে নয়, আমাদের স্বার্থেই এসব পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
লক্ষণীয় যে, গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে যখন-তখন রাস্তায় নেমে আসছে। ভাংচুর হচ্ছে। পুলিশ দিয়ে মোকাবেলা করা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না। অসন্তোষ দূর হচ্ছে না। এর কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। উপরন্তু কখনও কখনও \’ষড়যন্ত্র তত্ত্ব\’ আবিষ্কার করা হচ্ছে।
বলা আবশ্যক, শ্রমিকরা সবসময় যৌক্তিক দাবি করেন, তা নয়। তাই কোনটা যৌক্তিক, কোনটা অযৌক্তিক তা নিয়ে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনার ব্যবস্থা থাকা দরকার। সে জন্য শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প নেই। কেবল শ্রমিকদের স্বার্থেই নয়, শিল্প মালিক তথা এই সেক্টরের সামগ্রিক স্বার্থেই ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার থাকা দরকার। নিশ্চিত হওয়া দরকার মানসম্পন্ন কর্মপরিবেশ।
এ ক্ষেত্রে ভ্রান্তিবিলাস রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, জিএসপি স্থগিত করায় গার্মেন্ট শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কথাটি আপাত সঠিক। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে গার্মেন্ট পণ্যের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা দেওয়া হয় না। কিন্তু এটি প্রত্যাহার করা হলে গার্মেন্ট শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাপারটা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। কানাডা-ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশসহ সর্বত্র এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। আরও বলা হচ্ছে_ বাংলাদেশ থেকেই তারা কম দামে পোশাক কিনতে পারে, এমন সুযোগ আর কোথাও মিলবে না। তাই তারা ঘুরেফিরে এখানে আসবে। কথাটি সর্বতোভাবে সত্য নয়।
জিএসপির আওতায় বাংলাদেশের সিরামিক পণ্য, চশমা, তাঁবু, প্লাস্টিক ব্যাগ, পশম, শতরঞ্জি রয়েছে। গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রায় ৩৩০ কোটি টাকার সিরামিক রফতানি হয়েছে। মোট রফতানির ২৫ শতাংশ গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। সিরামিক শিল্পের মালিকরা বলেছেন, আমাদের কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমমান নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। তবে আমাদের সুবিধা কেন কেড়ে নেওয়া হলো? এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন লা-জওয়াব। বাংলাদেশের সিরামিক ও পাটজাতদ্রব্যের বাজার যখন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তখন এ সিদ্ধান্ত সিরামিকসহ সংশ্লিষ্ট শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এ প্রসঙ্গে স্বীকার্য, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের মান উন্নয়ন না হওয়ার জন্য সরকার ও গার্মেন্ট মালিকদের দায় আছে। কিন্তু মার্কিন ক্রেতারা ও সে দেশের সরকার কি নৈতিক দায় এড়াতে পারেন?
বাংলাদেশের সস্তা শ্রমের ওপর ভাগ বসাচ্ছেন মার্কিন ক্রেতা ও সরকার। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি শুল্ক শতকরা ১ ভাগের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যের ওপর শুল্কহার শতকরা ১৫ ভাগ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। এ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছ থেকে শুল্ক বাবদ পেয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা চীন, ভারত, ভিয়েতনাম থেকে যে দামে গার্মেন্ট পণ্য কিনছেন, তার চেয়ে কম দামে কিনছেন বাংলাদেশ থেকে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ সরকার ও উদ্যোক্তারা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছেন না। মালিকরা পারছেন না ক্রেতাদের কাছ থেকে যৌক্তিক মূল্য আদায় করতে, আর সরকার পারছে না শুল্ক কমানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করতে। সব চাপ এসে পড়ছে শ্রমিকের কাঁধের ওপর।
বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার ও উন্নয়নের ভাবনা অন্য কারও কাজ নয়। এটি সরকারের দায়িত্ব। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে ন্যায্যতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা এবং কূটনৈতিক দক্ষতা প্রয়োগ করে বাংলাদেশের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কতটুকু সাফল্যের পরিচয় দিতে পারছে_ সেটি খতিয়ে দেখার বিষয়।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে গ্যাস উত্তোলনে পিএসসি চুক্তিতে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার বিষয়টি এখন দেশবাসীর কাছে অস্পষ্ট নয়। সবারই জানা, সংসদে আলোচনার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে, রাখঢাক করে গ্যাস উত্তোলনের এসব চুক্তি করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো প্রতিনিয়ত বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত থাকলেও বিদেশি কোম্পানির কাছে গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেওয়া নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। সব শাসক দলই একই নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে টিকফা চুক্তি হতে যাচ্ছে, তা নিয়েও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বিতর্ক নেই। সংসদ চলাকালে টিকফা চুক্তির ঘোষণা এলো, কিন্তু এ নিয়ে বিরোধী দলের সমালোচনা দূরে থাক, টুঁ শব্দটিও করেনি। এমনকি বিরোধী দলও সংসদে আলোচনার দাবি পর্যন্ত তুলল না।
আসলে টিকফা কী? এতে আমাদের কতটুকু লাভ-লোকসান হবে তা কি সরকার খতিয়ে দেখেছে? দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত টিফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট) এখন টিকফায় (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট) পরিণত হয়েছে। মন্ত্রিসভা এটি অনুমোদন করেছে। এখন চুক্তি সম্পাদনার অপেক্ষায়। চুক্তিতে রয়েছে উভয়পক্ষের সেবা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা দূর করা, ডবি্লউটিওর আওতায় মেধাস্বত্ব বিধি বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মূলনীতি মেনে উভয়পক্ষের শ্রম অধিকার বাস্তবায়ন করা এবং কর্মপরিবেশের সুরক্ষা করা। পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি অনুসরণের বিষয়টি চুক্তির বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে, এ চুক্তির মধ্য দিয়ে ক্ষতি হবে না বরং বাংলাদেশের লাভ হবে।
চুক্তিতে দেশের শ্রম অধিকার সুরক্ষার বিষয় আছে। তবে রাষ্ট্রেরই এ দায়িত্ব সর্বাধিক। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে উভয় দেশ একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, দুটি অসম শক্তিসম্পন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৈঠক হবে। বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রস্তাবে না বলা কঠিন হবে। ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক বাজার যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ হারাবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রাধান্য দিতে হবে, যা হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশে তেল-গ্যাস উত্তোলনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কিন কোম্পানিগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য। যে আধিপত্যের জাঁতাকলে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে হবে।
সেবা খাতে সে বিনিয়োগ সংকুচিত হবে। ভয়াবহ বাধার সম্মুখীন হবে মেধাস্বত্ব অধিকারের (ট্রিপস) আওতায় আমাদের ওষুধ, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা। আমাদের নিজস্ব সম্পদ ও উদ্ভাবনের ওপর প্যাটেন্ট রাইটস প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের জামদানি শাড়ি, নিম, অর্জুনসহ বিভিন্ন ওষুধ ও কৃষিপণ্যের ওপর আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো প্যাটেন্ট রাইটস প্রতিষ্ঠা করেছে এরই মধ্যে। বাংলাদেশ বহু পিছিয়ে আছে। এসব সুফল ভোগের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি। সে যা-ই হোক, বাংলাদেশের শিল্প বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এখানে এখন মেধাস্বত্ব আইনের অনুসরণে কড়াকড়ি নীতি শিল্প এবং উন্নয়নের ধারা ব্যাহত করবে।
যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ পুঁজির দেশ, বাংলাদেশ শ্রমশক্তির দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজি যদি বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা না থাকে, তা হলে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা থাকবে কেন? সেসব যৌক্তিক দাবি ও বোঝাপড়া না করে চুক্তিতে সই করা কতটুকু সঙ্গত হবে, ভেবে দেখা উচিত। বলা হচ্ছে_ ভারত, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশ একই ধরনের চুক্তি করেছে। বলা বাহুল্য, সব দেশের সঙ্গে চুক্তির শর্ত এক নয় এবং বাংলাদেশের সঙ্গে এ দেশ দুটির অর্থনৈতিক বিকাশের পর্যায়ও তুলনীয় নয়।