সারাদেশই এখন চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও জয়-পরাজয়ের আলোচনায় মুখরিত। তবে বিজয়ী মেয়র ও কাউন্সিলরদের নিয়ে যতটা না কথাবার্তা হচ্ছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আলোচিত হচ্ছে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল এবং বিএনপি বা ১৮ দলের লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশ।
চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটির পাশাপাশি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্যও পরীক্ষা। বর্তমান মহাজোট শাসনকালে স্থানীয় সরকার ও সংসদের উপনির্বাচন হস্তক্ষেপ ও প্রভাবমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবে কি-না, সেটি দেখার বিষয় ছিল। নির্বাচনে পরাজয়ের মুখেও সরকার হস্তক্ষেপ করেনি। চারটি সিটিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এটি তার বর্তমান শাসনকালের প্লাস পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন জোট এই নিরপেক্ষতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এখন নতুন করে বলছে যে, \’জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে। তাই নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন নেই।\’ বিএনপি নেতৃবন্দ জবাবে বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন এক নয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তন হয় না। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা না থাকার ব্যাপার। তাই তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না।
একানব্বই-পূর্ববর্তী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, কারচুপি বা মিডিয়া ক্যুর কাহিনী কারও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। সে কারণে আপাতত সেটি মেনে নেওয়া বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি আওয়ামী লীগের পক্ষেও বিএনপি সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। তাই সঙ্গত কারণে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থায় নিদেনপক্ষে নিরপেক্ষ সরকারপ্রধান কিংবা ভারসাম্যপূর্ণ সর্বদলীয় সরকার ব্যবস্থা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর মানে এই নয় যে, মহাজোট সরকারের শাসনকালে স্থানীয় সরকার ও সংসদের উপনির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের ঘটনা ছোট করে দেখছি। এ জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সাধুবাদ প্রাপ্য। নিরপেক্ষতা বজায় রাখার এ দৃষ্টান্ত গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এখন প্রশ্ন, নির্বাচন কমিশন কতখানি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে? না, কোনো পক্ষপাত দেখায়নি। তার চেয়ে সত্য, পক্ষপাতিত্বের কোনো প্রভাবকে মোকাবেলা করতে হয়নি। এমন প্রস্তাব এলে সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কি মেরুদণ্ড সোজা থাকত_ এমন প্রশ্ন এসে যায়। উল্লেখ্য, নির্বাচনে যথেচ্ছ টাকার খেলা ও ধর্মের অপব্যবহার হয়েছে।
অনেক স্থানে রঙিন পোস্টার ব্যবহার, বিলবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে। এ জন্য নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের নসিহত করেছে। কিন্তু তাদের দিয়ে তা অপসারণ করতে পারেনি। এ কি নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার পরিচায়ক নয়? বলা যায়, সব প্রার্থীরই ব্যয়ের পরিমাণ সিলিং ছাড়িয়েছে। মেয়রদের ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা কোথায়ও ১০ লাখ, কোথায়ও ১৫ লাখ টাকা। প্রার্থীরা ব্যয় করেছেন এর বহুগুণ। এর বাইরে হাজার হাজার টাকা ভর্তি খাম বিলিয়েছেন, সে হিসাব কে রাখে? তবে ব্যয়ের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন চোখ বুজে না দেখার ভান করেছে। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ব্যয় নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। এ প্রসঙ্গে ভারতের এক সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশনের কথা বলতে চাই। ১৯৯১ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে। নির্বাচনী সহিংসতায় ৫ জন লোকসভার প্রার্থী ও ২১ জন বিধানসভার প্রার্থীসহ ৩৫০ জন নিহত হন। এমনই অবস্থায় সেশন চিফ ইলেকশন কমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে কেবল সহিংসতাই দূর করেননি, টাকার ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত অল্প্রব্দ, কর্নাটক, গোয়া ও সিকিমের নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ পরীক্ষার জন্য ৩৩৬ জন অডিট অফিসার নিয়োগ দিয়েছিলেন। এভাবেই বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছিলেন। আর আমাদের এখানে প্রার্থীদের মর্জির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় বা হচ্ছে।
সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলোতে ধর্মের অপব্যবহার রোধের ক্ষেত্রেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পত্রপত্রিকায় এসেছে, জামায়াত-হেফাজত ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে বিভিন্ন কল্পিত কাহিনী দেখিয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করেছে। বলেছে, এরা নাস্তিক আল্লাহ-রাসূলের শত্রু_ তাদের ভোট দেবেন না। এমনকি কোথাও কোথাও কোরআন ছুঁইয়ে শপথ করিয়েছে তারা।
নির্বাচনবিধিতে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় ভোটের জন্য ক্যাম্পেইন করা যাবে না। অথচ উভয় দলের প্রার্থীরা মসজিদে গিয়ে নামাজ শেষে দোয়া চেয়েছেন। নির্বাচনকালে দোয়া চাওয়া আর ভোট চাওয়ার মধ্যে আদৌ কি কোনো পার্থক্য আছে?
তাই সবকিছু বিবেচনা করে আমার মনে হয়েছে, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ, তবে ইমানের দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। এবারের নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশন পাস করেছে। কিন্তু এ+ পায়নি। দেশে প্রয়োজন এ+ পাওয়া শক্ত নির্বাচন কমিশন।
এবার আসা যাক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রসঙ্গে। কেন আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দল সমর্থকরা হেরেছেন? এই পরাজয়ের কারণ হিসেবে প্রার্থীদের কর্মকাণ্ডের কথা বলা হচ্ছে। এটি কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়।
এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও স্থানীয় থাকেনি, জাতীয় নির্বাচনের আমেজ লাভ করেছে। এলাকার ইস্যু ছাড়িয়ে জাতীয় ইস্যুগুলো প্রাধান্য লাভ করেছে। ফলে সরকারের গত ৪ বছরের শাসনামলের ব্যর্থতা, দুর্নীতি, কেলেঙ্কারির কাহিনী উঠে এসেছে। শেয়ারবাজার, সোনালী ব্যাংক, হলমার্ক, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতি এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি-দখলবাজি জনমতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। খুলনা ও বরিশালের ভোটারদের ক্ষোভ ছিল_ কেন একজন আবুল হোসেনকে বাঁচাতে গিয়ে পদ্মা সেতু বন্ধ হয়ে গেল। এসব প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের জবাব জনগণ গ্রহণ করেনি। হেফাজতের সমাবেশে আক্রমণ করে শত শত আলেমকে হত্যার অভিযোগ প্রচার করেছে বিএনপি ও তার সমর্থকরা। অন্যদিকে যুক্তি খণ্ডন এবং হেফাজতিদের বিশৃঙ্খল ও বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে আওয়ামী লীগ ছিল দ্বিধান্বিত। ফলে বিএনপি-জামায়াতের প্রচারিত কল্পকাহিনী জনগণের একাংশ বিশ্বাস করেছে। ভোটে তার প্রভাবও পড়েছে।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিএনপির অপশাসন, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের কেলেঙ্কারির কথা বলেছেন। কিন্তু এসব তো অতীত স্মৃতি। মানুষ বর্তমানের অপকর্মই ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে বিবেচনা করেছে। সেই সঙ্গে মিশেছে মেয়রদের বিরুদ্ধে নগরবাসীর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। যেখানে বিএনপির প্রার্থীরা নতুন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যর্থতা বা দুর্নীতির অভিযোগ আনা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া আওয়ামী লীগের ভেতর দলীয় কোন্দল ছিল, বিএনপিতে ততটা লক্ষণীয় নয়। ১৪ দলের শরিকদের ভেতরে ক্ষোভ ছিল, তা বিবেচনায় এনে একযোগে কাজ করার পরিকল্পনা ছিল না। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির ভিন্ন অবস্থান এবং আলাদা প্রার্থী দেওয়াও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। পক্ষান্তরে ১৮ দলীয় শরিকরা ঐক্যবদ্ধ, জামায়াত-হেফাজতের কর্মীরা ছিল যথেষ্ট সক্রিয়। তাই বলা যায়, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কারণেই আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীরা হেরেছেন। এলাকার কাজ তেমন গুরুত্ব পায়নি।
তবে এই নির্বাচনী রায় কি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে সদৃশ? না, তা নয়। জাতীয় রাজনীতির ছায়া পড়েছে সত্য, তবে জাতীয় নির্বাচনের অবিকল রায় নয়। জাতীয় নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের প্রশ্ন, তাই এ ক্ষেত্রে দু\’দলের সামগ্রিক রাজনীতির বিষয়টি গুরুত্ব পায়। যেটি এ ক্ষেত্রে একইভাবে বিবেচিত হয়নি।
আমাদের মনে রাখা দরকার, দেশে আওয়ামী লীগের একটি ভোটব্যাংক আছে, বিএনপিরও ভোটব্যাংক আছে। তবে দুই ভোটার গোষ্ঠীর চেয়ে বড় ভোটব্যাংক নির্বাচনের সময় এ ধারা যে দলের দিকে ঝোঁকে সে দলই বিজয়ের হাসি হাসে। এই জনগণ দুই বড় দলের আচরণে ক্ষুব্ধ। তারপরও জোটের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তৃতীয় কাউকে দেখছে না। তাই মন্দের ভালো বেছে নিচ্ছে। আগামী নির্বাচনের আগেই ঠিক করবে কে মন্দের ভালো।
পরিশেষে বলতে হয়, বিএনপি বিজয়ী, আওয়ামী লীগ পরাজিত। তবে কোনো দলই জনগণের কাছে \’প্রিয়\’ নয়। জনপ্রিয় হওয়ার জন্য উভয় দলই নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করবে, সেটিই জনগণ আশা করে।
জনগণের প্রত্যাশা, কেউ ফাউল খেলবে না। বরং নিজেদের পরিশুদ্ধ করবে। রাজনীতি যে সুবিধাবাদিতা, দুর্নীতি ও লুটপাটের মহড়া তা থেকে মুক্ত হবে।