budgetবাজেট শুধু সরকারের হিসাব-নিকাশের খেরোখাতা নয়, এটি রাষ্ট্রের চরিত্র ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিচ্ছবি। বাজেটে প্রতিফলিত থাকে যে, রাষ্ট্রটি সমাজের কোন অংশ বা শ্রেণীর ধারক এবং বরাদ্দের মধ্য দিয়ে কোন অংশকে কতখানি ক্ষমতায়নের চেষ্টা হচ্ছে? এ বিবেচনায় অতীতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শাসনামলে সাইফুর রহমানের পঠিত এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শাসনামলের আবুল মাল আবদুল মুহিত পঠিত বাজেটগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি?
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, আশির দশকে কৃষিসহ উৎপাদনমূলক ও সেবা খাত থেকে যে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও বিরাষ্ট্রীয়করণের যে প্রেসক্রিপশন দিয়েছিল আইএমএফ- বিশ্বব্যাংক, \’৯১-তে আসা বিএনপি সরকার এবং \’৯৬-তে আসা আওয়ামী সরকারের বাজেটগুলোতে ছিল তার ব্যাপক প্রতিফলন। বিগত চারদলীয় সরকার ও বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে সেখান থেকে সরে এসে ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ক্রমেই নজর দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই সঙ্গে বর্তমান সরকারের শাসনকালে বন্ধ হয়ে যাওয়া কতিপয় রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা চালু করা হয়েছে। এ পরিবর্তন ছাড়া দুই সরকারের নীতিতে কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয় নয়।
এটি অভিনন্দনযোগ্য যে, বর্তমান মহাজোট সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের সমাজতন্ত্র পুনর্স্ট্থাপিত করেছে। যে কারণে সঙ্গতভাবেই প্রত্যাশিত ছিল যে, সরকার ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দেবে এবং বাজেটে সে প্রতিফলন থাকবে। কিন্তু গত ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাজেট ঘোষণায় এর কোনো প্রতিফলন নেই। এ প্রসঙ্গ যদি বাদ দিই, তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় যে, টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক সুবিচারের বিষয়টি কতটুকু বিবেচনায় আনা হয়েছে?
দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ মানবসম্পদ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে তার মূলে কৃষক ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী। স্বাধীনতা-উত্তর জনসংখ্যা যখন ৭ কোটি, তখন বাংলাদেশ ছিল খাদ্য ঘাটতির দেশ। আজ জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। কিন্তু বাংলাদেশ খাদ্য, বিশেষ করে ধান উৎপাদনে বিপ্লব এনেছে। খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এ কৃতিত্বের দাবিদার কৃষক সমাজ। সরকারের ভূমিকা গৌণ। চীন, জাপান ও পশ্চিমা দুনিয়ায় কৃষিতে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সে তুলনায় আমাদের ভর্তুকি ও সহায়তার পরিমাণ নস্যি। অথচ আমাদের কৃষক সব প্রতিকূলতার মুখে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, সোনালি ফসল ফলিয়ে চলেছেন। যা কেবল অর্থনীতির বুনিয়াদ নয়, রাজনীতিকেও করেছে স্থিতিশীল। আজ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকার গঠন করে মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে। তার মূলে রয়েছে কৃষির সাফল্য। বাজারে খাদ্যের ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধি পেলে কোনো সরকার কি স্থায়ী হতো?
কৃষকের সন্তানরা আজ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিদেশের শ্রমবাজার থেকে তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আজকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় ফ্যাক্টর।
পোশাকশিল্পের সাফল্যের পেছনে রয়েছে প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষেতমজুরের সন্তানদের অবদান। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে উদ্যোক্তাদের উদ্যম আছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আছে, তবে সবকিছু ছাপিয়ে শ্রমিকের দক্ষতাই এই শিল্পের প্রাণশক্তি_ তা অস্বীকার করার জো নেই। দেশের সমবৃদ্ধির তিন কারিগর কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক ও গার্মেন্ট কর্মী। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের সহায়তায় কোন কোন প্রস্তাব আছে এ বাজেটে?
কৃষির দিকে চোখ মেলা যাক। গত বছর সংশোধিত বাজেটের ৭.৮৬ শতাংশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল। এবার সেটি ৫.৫১ শতাংশ করা হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এখানে বরাদ্দ বৃদ্ধির কথাই ভাবা উচিত। তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ব্যয় মানেই কৃষকের ঘরে সে সুফল পাওয়া নয়। তারপরও কথা হচ্ছে_ কৃষি খাতকে কতটুকু প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে? কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না থাকলে কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে_ যা সমগ্র অর্থনীতির জন্য হুমকি।
মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা খাতের গুরুত্ব সর্বাধিক। এটি জাতীয় উন্নয়নের সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী বিনিয়োগ। যে কারণে শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। \’সবার জন্য শিক্ষা\’ নিশ্চিত করতে জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয়ে উন্নত করতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গত বাজেটে ছিল ২.২৩ শতাংশ (যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে কম)। এবারের বাজেট প্রস্তাবে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়নি। বরং কমানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ৬.৪ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটে ক্রমে উন্নীত হয়েছিল ৬.১০ শতাংশে। কিন্তু এবারের প্রস্তাবে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৫.৯২ শতাংশে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় কিঞ্চিৎ বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে শিক্ষা খাতে প্রকৃত ব্যয় কমে আসবে। সবচেয়ে উপেক্ষিত রয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাত। যেখানে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চিন্তকরা জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দে উন্নীত করার কথা বলছেন, সেখানে বরাদ্দ কমছে। গত বাজেটে ৪.৮৭ শতাংশ ছিল, এবার ৪.২৬ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে, যা জিডিপির এক শতাংশের কম।
বিগত বছরগুলোর বাজেট একই রকম। কিঞ্চিৎ হেরফের হয়েছে। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এই বাজেটে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কোনো সুখবর নেই। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী স্বল্প সুদে অভিবাসন ঋণ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপনের কথা বলেছেন। এটি ভালো উদ্যোগ। তবে জরুরি হচ্ছে, প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি এবং দেশে ফিরে আসার পর তাদের জন্য কর্মসংস্থান। প্রবাসীদের বিনিয়োগের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিলে তা হতো উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা।
সফল খাতের সহযোগী হয়েও পোশাকশিল্পের কর্মীরা চরম দুরবস্থার শিকার। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি সমগ্র জাতিকে কাঁদিয়েছে। নিশ্চয় সরকারকেও ভাবিয়েছে। কিন্তু সেই ভাবনার কোনো প্রতিফলন নেই। পোশাক কর্মীদের জন্য আবাসন ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণে সরকারের বিশেষ বরাদ্দ থাকলে সেটি হতো মানবিক এবং সরকারের শ্রমবান্ধবনীতির পরিচায়ক।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো হয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও দুস্থ মহিলা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা এবং মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতার হারের আওতা বাড়ানো যৌক্তিক। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এ অসহায় ও দুস্থ জনগোষ্ঠী সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য নীতির শিকার। তাই এভাবে যাতে জনগোষ্ঠী হতদরিদ্র ও দুস্থ না হয়, সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে, সামাজিক সাম্য আনতে হবে। আর সে পদক্ষেপ ছাড়া শুধু নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
বাজেট প্রস্তাবনায় উপেক্ষিত স্থানীয় সরকার খাত। গত বছরের তুলনায় পরিমাণ বাড়লেও প্রকৃত ব্যয় বরাদ্দ কম। গত বাজেটে ছিল ৬.৪৮ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে কিঞ্চিৎ বেশি। আর এবারের প্রস্তাব বাজেটের ৫.৮৩ শতাংশ। জিজ্ঞাসা করতেই হয়_ স্থানীয় সরকারের বরাদ্দ কমানো কি তৃণমূল মানুষের ক্ষমতায়ন নীতির পরিপূরক?
বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, বাজেট কি সমাজের মধ্যকার বৈষম্য কমাবে? বৈষম্য কমবে কি ধনী ও গরিবের মধ্যে, শহর ও গ্রামের মধ্যে? দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে সহায়তা করবে? বাজেটের মধ্য দিয়ে সামাজিক সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে? প্রস্তাবিত বাজেটে এমন আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমান বাজেট গতানুগতিক। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পঠিত এবারের বাজেট বক্তৃতা অতীতে মন্ত্রীদের বাজেট বক্তৃতার প্রতিধ্বনি। কিংবা সেগুলোর মার্জিত সংস্করণ।
এ বাজেটের মধ্য দিয়ে সমাজের তৃণমূলের মানুষের ক্ষমতায়নে তেমন কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে না, বরং তাদের জীবনমান হবে নিম্নগামী। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্র হবে সংকুচিত।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগে লুণ্ঠিত টাকা বৈধ হবে, লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া জোরদার হবে। বৈধ উপার্জনকারীদের জীবন হবে আরও কষ্টকর।