nirbachonনির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, জনমনে ততই বাড়ছে আতঙ্ক। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার সহযোগীরা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নে অনড়। ক্ষমতাসীন মহাজোট পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে গৃহীত ব্যবস্থায় নির্বাচনের কথা বলছে। সেটি হচ্ছে বর্তমান সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। তবে কখনও কখনও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথাও বলা হচ্ছে। কীভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে_ সেটি এখন প্রশ্ন।
ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় রাষ্ট্রপ্রধানের আহ্বানে বিদায়ী সরকারই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করে। সেটি এক ধরনের নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় বিএনপির আস্থা নেই। অতীতে আওয়ামী লীগের আস্থা ছিল না বলেই দীর্ঘ আন্দোলনের মুখে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রবর্তিত হয়েছিল। এ সংক্রান্ত আদালতের রায় এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তা বাতিল করায় বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এখন বিএনপি জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা বললেও হুবহু তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি থেকে সরে এসেছে। ইতিপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেনি বিএনপি। বিএনপি সর্বদলীয় সরকার ব্যবস্থা মানতে রাজি। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বা দলীয় কোনো সদস্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকলে তা মানবে না। এ পরিস্থিতিতে সংলাপ এবং সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে সমঝোতায় আসার কোনো বিকল্প নেই।
সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি। কিন্তু নির্বাচনই শেষ কথা নয়। কোনো গ্যারান্টি আছে যে, নির্বাচনের পর নতুন করে একই সংকট দেখা দেবে না? বরং এমন আশঙ্কাই প্রবল। হয়তো আবার দেখা যাবে যে_ বিরোধী দল সংসদে বসছে না, নতুন করে সংসদ বর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কারণ, দেশ আজ দুটি বড় দলের কাছে জিম্মি। এ দল দুটি ধনিক শ্রেণীর স্বার্থের ধারক-বাহক হলেও মানসিকতায় সামন্তবাদী। ক্ষমতার বাইরে বিরোধী দল হিসেবে রাজনীতি করার যে গণতান্ত্রিক চেতনা থাকা দরকার, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটি তা ধারণ করে না। তদুপরি নির্বাচন ও রাজনীতিতে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও নব্য ধনিক শ্রেণীর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে নীতি ও আদর্শের স্থান সংকুচিত হয়ে পড়েছে, নির্বাচন ও রাজনীতি পরিণত হয়েছে বাণিজ্যে।
এটি ওপেন সিক্রেট যে, \’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর নির্বাচনে ভোট ডাকাতি বা জবরদস্তিমূলকভাবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ নেই। তবে নির্বাচনে বেড়েছে টাকার খেলা। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের ব্যবহার। এমন নীতিহীন খেলায় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আদর্শবাদীরা ছিটকে পড়েছেন। বড় দল দুটিতেও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াবহির্ভূত নব্য ধনী ও হায়ারের খেলোয়াড়ের দাপট বেড়েছে, ত্যাগী রাজনীতিকরা হয়ে পড়েছেন কোণঠাসা। উভয় দলেরই প্রবীন রাজনীতিকরা আক্ষেপ করে বলছেন, রাজনীতি এখন রাজনীতিকদের হাতে নেই।
বেশিরভাগ সাংসদই কর্তব্য পালনে উদাসীন। বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের সিদ্ধান্তে সাংসদদের মধ্যে ক্ষোভ নেই, নেই বাদ-প্রতিবাদ। কারণ তাদের দরকার নামের সঙ্গে এমপির তকমা। সেটি রক্ষা করতেই ৯০ দিন অন্তর তারাএকবার সংসদে যান। সাংসদ হিসেবে সংসদে গিয়ে আইন প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখতে মোটেই আগ্রহী নন তারা। সংসদে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে একইভাবে অনাগ্রহ লক্ষণীয় সরকার দলের সাংসদদের মধ্যেও। তাই কখনও কখনও কোরাম সংকট দেখা দেয় অধিবেশন শুরু করতে। কারণ, সংসদ চলাকালে তারা ব্যস্ত থাকেন সচিবালয়ে তদবির কিংবা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে।
সংসদে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও নব্য ধনীদের যে প্রাধান্য, তা অব্যাহত থাকলে জাতীয় সংসদ ক্রমেই বিরাজনীতিকীকরণ হবে। সংসদ ও রাজনীতি থেকে ত্যাগী ও আদর্শবাদীরা হবেন চিরদিনের জন্য বিতাড়িত, যা রাজনীতিতে এক অশনিসংকেত।
দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাই একমাত্র সমাধান নয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও পরিবর্তন দরকার। পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা দরকার। একই সঙ্গে পরিবর্তন দরকার নির্বাচন পদ্ধতিরও। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের কোনো চিরায়ত সংজ্ঞা নেই। এটি সৃজনশীল কর্ম। কোন দেশে কীভাবে নির্বাচন হবে, নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে, সে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিতে হবে। তাদেরই ভাবতে হবে_ কোন ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি (ঊষবপঃড়ৎধষ ঝুংঃবস) যুক্তিযুক্ত।
বর্তমানে দেশে এলাকাভিত্তিক জনপ্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ব্যবস্থাটির রয়েছে ইতিবাচক ও নেতিবাচক_ দুই দিকই। এ প্রক্রিয়ায় তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার সুযোগ অবারিত। সাংসদ জনগণের সমস্যার সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় সমস্যা সংসদে উপস্থাপন করতে পারেন। সঙ্গত কারণেই এ ব্যবস্থায় সাংসদদের জনগণের মুখোমুখি হতে হয়। কৃতকর্মের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহিও করতে হয়। এসব ভালো দিক। তবে একটি বা দুটি উপজেলা নিয়ে নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় সেখানে টাকার খেলার সুযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে সম্ভব হচ্ছে আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভোটারদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করা। এ ব্যবস্থায় ছোট ছোট দলগুলোর বিকাশ রুদ্ধ হচ্ছে। পোক্ত হচ্ছে দ্বিদলীয় বা দুই জোটের পর্যায়ক্রমিক শাসন ব্যবস্থা। ছোট দলের সমর্থকরা তাদের প্রার্থী জয়ী হতে পারবে না_ বিবেচনায় ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বড় দলের প্রার্থীদের সমর্থন করে। কেউ আওয়ামী লীগ ঠেকাতে বিএনপিকে, আবার কেউ বিএনপিকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। এগুলো নেতিবাচক ভোট_ যা প্রার্থীর যোগ্যতা ও দলের নীতি ও কর্মসূচির প্রতি সমর্থনসূচক নয়। এলাকাভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থার ফলে এখানে আদর্শবাদী রাজনৈতিক  ধারা তৈরি হচ্ছে না। উত্থান ঘটছে না তৃতীয় বা বিকল্প শক্তির, যা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের স্বেচ্ছাচারিতার বিপরীতে রাজনীতিতে ভারসাম্য আনতে পারে।
সেই ক্ষেত্রে প্রয়োজন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিধান, যা দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। প্রতিবেশী নেপালেও ওই বিধান গৃহীত হয়েছে। সে বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ হবে একটি নির্বাচনী এলাকা। এই এলাকার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো ৩০০ প্রার্থী ঘোষণা করবে এবং প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী দল আসন লাভ করবে। ধরা যাক, \’ক\’ পার্টি ২০ লাখ ভোট পেয়েছে। ধরা যাক, প্রদত্ত ভোটের অনুপাতে একজন সাংসদ ২ লাখ ভোটে নির্বাচিত হবে। সে ক্ষেত্রে \’ক\’ দলের ক্রমঅনুসারে ১০ জন প্রার্থী নির্বাচিত হবেন।
এখানে টাকার খেলার সুযোগ নেই। এ ব্যবস্থায় প্রার্থী নিজের জন্য সরাসরি ভোট প্রার্থনা করতে পারেন না। দলের জন্য ভোট চাইতে হয়। তাই এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির অর্থ বিনিয়োগ নিরর্থক। আর দেশজুড়ে টাকা ছড়ানো সম্ভব নয়। এ প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থায় নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে দলের আদর্শ ও কর্মসূচিই হয়ে ওঠে প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
অসুবিধার দিক হচ্ছে, কোনো এলাকা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বশূন্য হতে পারে। সাংসদরা হয়ে যেতে পারেন জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরের মানুষ। এতে পার্টিগুলোর মধ্যে আমলাতান্ত্রিক প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।
সেই ক্ষেত্রে আমরা দুটি ব্যবস্থার সমন্বয় করতে পারি। যেটি জার্মানিতে আছে। তা হচ্ছে, প্রত্যেকের জন্য দুই ভোটের বিধান। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এবং অপরটি এলাকার জন্য। এ নিয়ম অনুযায়ী আমাদের সংসদের ৩০০ আসন ভাগ হবে। ১৫০ জন এলাকাভিত্তিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হবে। অপর ১৫০ জন দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে লাভ করবে। আর এটি হলে তা হবে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ।
দেশ দুই দল বা জোটের কাছে জিম্মি থাকবে না। ছোট ছোট আদর্শবাদী দল যারা দিন দিন ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়ছে_ তাদের মধ্য থেকেও সংসদে যাওয়ার সুযোগ হবে। রাজনীতিতে সুবিধাবাদী মৌসুমিদের জায়গা সংকুচিত হবে, বিকশিত হবে আদর্শবাদী ধারা।
এ প্রক্রিয়ায় রুখে দেওয়া সম্ভব সংসদ বর্জনের নেতিবাচক রাজনীতি। তাই দেশের রাজনৈতিক সংকটের চির অবসানের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার পাশাপাশি নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে ভাববার সময় এখনই।