ছোট একটি ঘটনা আমার নজর কেড়েছে। ক\’দিন আগে যখন সংবাদপত্রে খবরটি পড়েছি_ তখন ভাবিনি যে, ঘটনাটি এমন পরিণতি লাভ করবে।
রাজধানীর একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শার্ট এবং ছাত্রীদের কামিজের লম্বা হাতা কেটে দিয়েছেন উপাধ্যক্ষ ও কয়েকজন শিক্ষক। স্কুলের ড্রেসকোড অনুযায়ী কনুই পর্যন্ত হাতা রাখার কথা, তার চেয়ে লম্বা থাকায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা বলেছেন, ছেলেদের শার্ট ও মেয়েদের কামিজের হাতা কনুই পর্যন্ত হবে। তা স্কুলের ডায়েরিসহ বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া আছে। কিছু শিক্ষার্থী তা না মানায় বারবার সতর্ক করা হয়েছে। তারপরও নিয়ম না মানায় যে ধরনের ব্যবস্থা আগে নেওয়া হতো, এবারও তা-ই নেওয়া হয়েছে।
এই নিয়ে অভিভাবক মহলেও এবার প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অভিভাবকদের কেউ কেউ অধ্যক্ষ ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। সে অনুযায়ী ২৬ মে পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপাধ্যক্ষ মাহবুবা খানমকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঘটনাটি আমাকে হতবাক করেছে। এভাবে হাতা কেটে দেওয়া ব্যাপারটা শোভন নয়। তাই বলে এ ঘটনার জন্য কোনো শিক্ষককে অপসারণ করা কতটুকু যৌক্তিক? অধ্যক্ষ বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা দুঃখ প্রকাশ করলেই এর অবসান হওয়ার কথা। কিন্তু অভিভাবকরা একজন শিক্ষকের অপসারণে খুশি নন, তাদের আরও দাবি হচ্ছে, অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্য শিক্ষকদেরও অপসারণ করতে হবে। এ জন্য বিদ্যালয়ের সামনে তারা মানববন্ধনও করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, শিক্ষকদের যদি ওটি বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের এই কি গোঁ-ধরা মহাবাড়াবাড়ি নয়?
ইতিপূর্বে অধ্যক্ষ উম্মে সালমা বেগম জানিয়েছেন, জামার হাতা কেটে দেওয়ার বিষয়টিকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। এ নিয়ে গত শনিবারে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর বিবৃতিতে সেটির প্রমাণ মিলল। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, \’মেয়েদের পোশাকে হাতা কাটার এ ঘটনা কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতেই আঘাত হানেনি বরং ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিধান পর্দা পালনে বাধা দেওয়ার মতো গুরুতর অপরাধ। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটতে পারে, তা ভাবাই যায় না।\’ বিবৃতিতে আগ্রহী ছাত্রীদের পুরো হাতার পোশাক ও হিজাব পরে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া এবং এ জন্য প্রয়োজনে ড্রেসকোড পরিবর্তনের আহ্বান জানানো হয়।
হেফাজতিদের এই বক্তব্য নতুন নয়। ৬ এপ্রিল শাপলা চত্বরে আসা মাদ্রাসার ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন ইটিভির স্টাফ রিপোর্টার নাদিয়া শারমিনসহ কয়েকজন নারী সংবাদকর্মী। কেন জিন্স পরেছো, মাথায় কাপড় নেই কেন_ ইত্যাদি বলে তাদের ওপর চড়াও হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা ঘোষণায় বলা হয়েছে যে, নারী-পুরুষের অবাধ চলাফেরা নিষিদ্ধ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে নারীদের মধ্যযুগে ফিরিয়ে নেওয়ার কথাই বলা হয়েছে।
আমার প্রশ্ন জাগে, এসব অভিভাবক কি না জেনে না বুঝেই হেফাজতিদের মতো কথা বলছেন? শিক্ষকদের এই ঘটনার জন্য অভিভাবকদের মরিয়া হয়ে নামার পেছনে কোন মানসিকতা কাজ করছে জানি না।
সবার জানা কথা, বাংলাদেশের যেসব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ড্রেসকোড রয়েছে_ দু\’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবগুলোতেই ছেলেমেয়েদের জন্য হাতা কাটা জামা পরিধানের নির্দেশিকা রয়েছে। এতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগছে বলে কোনো কথাবার্তা এতকাল শুনিনি। এমনকি তা শোনা যায়নি পাকিস্তানি শাসনামলেও।
কোনো দেশের মানুষের পোশাক সে দেশের আবহাওয়া, মানুষের মূল্যবোধের ওপর নির্ধারিত হয়, আবার যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তা পরিবর্তিত হয়। একদা আবহমান বাংলার কৃষকের পরিধেয় ছিল_ লুঙ্গি, ধুতি ও গামছা। এর সঙ্গে বড়জোর ফতুয়া বা কটি। যারা অবস্থাপন্ন তারা মহাজনী বা ব্যাপারী শার্ট পরত। অভিজাতদের জন্য ছিল পায়জামা-পাঞ্জাবি কিংবা ধুতি-পাঞ্জাবি। মোগল-সুলতানি শাসনামলে আচকান-কোর্তা এসেছে। কিন্তু তা সাধারণের পরিধেয় হয়ে ওঠেনি। মেয়েদের সাধারণ পোশাক শাড়ি। তবে দরিদ্র মেয়েরা দুই প্রস্থ কাপড় ব্যবহার করত। একটি পরত, আরেকটি গায়ে চড়াত। আমি শৈশবে গ্রামে নারীদের শাড়ির পাশাপাশি এমন পোশাক পরতে দেখেছি। স্থানীয় ভাষায় এটিকে বলা হয় ডুমা। বর্তমানে নারীদের পরিধেয় ব্লাউজ ও সায়া (পেটিকোট) এবং শাড়ি পরার ঢং তো জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার থেকে শুরু হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী এটি প্রবর্তন করেন। এভাবে শাড়ি স্টাইল বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষে উভয়ের পোশাক বদলেছে। মোগল-সুলতানি আমলে কোর্তা-আচকান এসেছিল, যা আমির-ওমরাহদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ইউরোপীয়দের প্যান্ট-শার্ট এখন সব শ্রেণীর মধ্যেই প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছে।
শাড়ি এখন নারীদের একমাত্র পোশাক নয়। মোগল-সুলতানি আমলে অভিজাতদের ঘরে সালোয়ার-কামিজ প্রবেশ করেছিল। আজ সেই সালোয়ার-কামিজের প্রসার বেড়েই চলেছে। চাকরিজীবী-কর্মজীবী নারী যারা অফিস-আদালতে বা গার্মেন্টসহ কারখানায় কাজ করছেন, বাসে-ট্রেনে ছুটছেন, তাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যকর পোশাক সালোয়ার-কামিজ। পাশাপাশি মেয়েরা প্যান্ট-শার্ট পরতেও শুরু করেছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি ও শাড়ি এখন নববর্ষসহ নানা অনুষ্ঠানে শোভাবর্ধন করছে। তবে আটপৌরে পরিধেয় হিসেবে শাড়ি গুরুত্ব হারাতে বসেছে।
কৃষক ও মেহনতি মানুষ লুঙ্গি-ধুতি ধরে রেখেছে। মধ্যবিত্ত লুঙ্গি ছাড়েনি, তবে এটি এখন তাদের ঘরোয়া পোশাক। লুঙ্গির সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়েছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি লুঙ্গি পরে জীবন কাটিয়েছেন। ইউরোপ ভ্রমণ করেছেন। চীনে মাও সে তুং, চৌ এন লাইর অতিথি হয়েছিলেন লুঙ্গি পরেই। কিন্তু কথিত অভিজাতদের কাছে লুঙ্গি আজ অপাঙ্ক্তেয়। শহরের অভিজাত ক্লাব ও হোটেলে লুঙ্গি পরে যাওয়া যায় না। সম্প্রতি লুঙ্গি পরা রিকশাওয়ালাদের বারিধারা নামক অভিজাত এলাকায় প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তা নিয়ে প্রতিবাদ উঠেছে। আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বিষয়টি। আসলে লুঙ্গি পরিহিতদের প্রতি নব্য ধনিকদের বিদ্বেষ তাদের মানসিক দৈন্যেরই পরিচায়ক।
পোশাকের আন্তর্জাতিকীকরণও ঘটছে। এখন থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কিছু দেশের রাজনীতিকরা পোশাকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছেন। এছাড়া সব দেশের সাধারণ মানুষের পোশাক একাকার হয়ে গেছে। চীনে মাও সে তুংয়ের কোর্তা রেখে এখন সেখানকার নেতারা কোট-টাই পরছেন। ভারতীয় রাজনীতিকরা এখনও প্যান্টের সঙ্গে শর্ট কোর্তা পরে বৈশিষ্ট্য রক্ষার চেষ্টা করছেন। এটি ভারতের জাতীয় পোশাক। প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়, বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক কী? স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতীয় পোশাক হিসেবে কালো প্যান্ট ও প্রিন্স কোটের প্রচলন করা হয়েছিল। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে সে সময়ের রাজনীতিকদের প্রিয় হয়ে উঠেছিল মুজিব কোট (ভারতে এ রকম কোট জহর কোট বলে পরিচিত, জওয়াহেরলাল নেহরুর নামে নামকরণ)।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তার পরিধেয় \’সাফারি\’ বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রিয় পোশাকে পরিণত হয়। তখন পোশাক দেখে চেনা যেত, কে আওয়ামী লীগের আর কে বিএনপির নেতা? এখন মুজিব কোট-সাফারির দাপট কমে গেছে। উভয় দলের নেতারাই এখন কোট-প্যান্ট পরতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
আসলে পোশাকের কোনো স্থায়ী রূপ নেই। যুগের পরিবর্তনে পোশাকের বিবর্তন ঘটছে। ইচ্ছা করলেই পুরনো পোশাকে ফিরে যাওয়া যায় না। তবে মানুষ বিভিন্নভাবে ঐতিহ্য ধারণ ও লালন করে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে আনন্দিত হয়।
অনুষ্ঠানের পোশাক আর নিত্যদিনের পোশাক এক নয়। যে ছেলেমেয়েরা প্যান্ট-শার্ট পরছে, বিয়ের অনুষ্ঠানে তারা শেরওয়ানি ও শাড়ি পরেই হাজির হচ্ছে। ঐতিহ্য ও আধুনিকতা দুইয়ের সমন্বয়েই পোশাকের ফ্যাশন তৈরি হচ্ছে। এখানে খবরদারির সুযোগ নেই। পোশাকের এ বিবর্তনকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।
জাতীয় পোশাক আছে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ধর্মীয় পোশাক বলে কিছু নেই। আজ মুসলমানদের ধর্মীয় পোশাকের নামে যা চাপিয়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের সাধারণ পোশাক। ঐতিহ্য ও তপ্ত আবহাওয়ার কারণে সেখানকার অমুসলিমরাও লম্বা কোর্তা, মাথায় শেরবন্ধ ব্যবহার করে। সেখানে ইহুদি, খ্রিস্টান আর মুসলিম নারীদের সনাতনী পোশাকে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের দেশেও এখন পোশাক দেখে বলা যায় না, কে হিন্দু, কে মুসলিম, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান। কেবল ধর্মীয় নেতাদের পোশাকে পার্থক্য লক্ষণীয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পোশাক কেমন হবে? ড্রেসকোডে ধর্ম অনুযায়ী আলাদা আলাদা পোশাকের সুযোগ থাকলে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টি করবে না, বরং দূরত্বই বাড়াবে। তাই এমন ড্রেসকোড দরকার, যা সব ধর্মের মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ড্রেসকোডে এই নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। যদিও কিছু ব্যতিক্রমও দেখছি। রাজধানীর আইডিয়াল স্কুলে ড্রেসকোডে ছেলেদের জন্য মুসলমানদের ধর্মীয় টুপি এবং মেয়েদের মাথায় স্কার্ফ বাঁধার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা ভিন্নধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদেরও অনুসরণ করতে হচ্ছে। এটি কি সমর্থনযোগ্য? এটি সত্য, বাংলাদেশ ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ, কিন্তু ১০ ভাগ ভিন্নধর্মাবলম্বীর ওপর ধর্মীয় পোশাক চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি মুসলিম শিক্ষার্থীদেরও বাধ্য করা যায় না।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তা রক্ষা করতে হলে এবং এগিয়ে নিতে হলে কেবল শিক্ষা ব্যবস্থায়ই নয়, শিক্ষার্থীদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডেও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন দরকার। এখানে বলা আবশ্যক, ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা টুপি পরে মসজিদে যাবে, হিন্দুরা কপালে তিলক এঁটে মন্দিরে যাবে, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরাও ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী উপাসনালয়ে যাবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে স্কুলে যাবে না। তারা অভিন্ন পোশাকে স্কুলে যাবে। এটাই সঙ্গত। পুলিশ, সেনাবাহিনীর পোশাক দেখেও বোঝা যাবে না যে, কার কোন ধর্ম। অযৌক্তিকভাবে পোশাক-আশাকে ভিন্নতা তৈরি করা হলে সব ধর্মের, সব জাতির মানুষ মিলে কি একাট্টা হওয়া যায়? এটি রাজধানীর উদয়ন স্কুল ও আইডিয়াল স্কুলসহ দেশের সব স্কুলের শিক্ষক-অভিভাবকদের উপলব্ধি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপও দরকার।