পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হই। চেনা-অচেনা চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা-মুরংসহ বিভিন্ন জাতিসত্তার নর-নারীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হই, সে সঙ্গে কিছু অতীত স্মৃতি আমাকে ব্যথিত করে, ক্ষুব্ধ করে। গত ২১ মে রাঙামাটিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দুই যুগ পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে অতীতের অনেক ঘটনা আমাকে নতুন করে বেদনাপ্লুত করেছে।
আমার স্মৃৃতিতে জমে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে অনেক ঘটনা। ১৯৯৩ সালের নভেম্বর নানিয়ারচর ট্র্যাজেডির কয়েকদিন পর সেখানে উপস্থিত হয়ে আমি আদিবাসীদের পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ির অবশেষ, ধ্বংসস্তূপ, রক্তের দাগ, আহতদের আর্তচিৎকার শুনেছি। লোগাং হত্যাকাণ্ডের বার্ষিকী অনুষ্ঠানে গিয়ে স্বজনহারাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যথিত হয়েছি। আমার কাছে বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়ে আছে দুটি নাম_ কল্পনা চাকমা ও রূপম। খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি গণপরিষদের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে ওদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কিছুদিন পর পত্রিকায় দেখি_ একটি চাকমা মেয়ে অপহৃত হয়েছে। নাম ও ছবিতে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠি। এই সেই কল্পনা, ও আর রূপম আমাকে খাগড়াছড়ির আশপাশের এলাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। ওদের সহজ-সরল কথাবার্তা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, অল্পক্ষণের মধ্যে ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। যতদূর মনে পড়ে, ওদের আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেছিলাম, ঢাকায় এলে দেখা করো।
রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবান-ঢাকাময় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই বিক্ষোভের খবর পড়তে গিয়ে রাঙামাটিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত লাল শার্ট পরা ছেলেটির ছবিতে চোখ আটকে গেল। রূপমও কল্পনার অপহরণের প্রতিবাদ করতে এসে প্রাণ দিল।
কল্পনা-রূপমদের জীবন নেওয়ার খেলা, রক্তপাত বন্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আদিবাসী ও বাঙালির মধ্যে সৌহার্দ্য ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে যে পদক্ষেপের কথা জম্মু ও সচেতন বাঙালি জনগোষ্ঠী দাবি করে আসছিল, তা বাস্তবে রূপ নিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে। এটি ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বড় অর্জন। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া থেমে যায়। বিএনপি সরকারের অবস্থান ছিল নেতিবাচক। তাই সঙ্গত কারণেই বর্তমান সরকার আবার আমাদের প্রত্যাশা জাগিয়েছিল। জম্মু জনগোষ্ঠী তো বটেই, আমাদের সবার আশা ছিল, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আর কোনো বিলম্ব ঘটবে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সে প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করেছে, চার বছর পর এখনও সে প্রশ্ন করতে হচ্ছে।
বর্তমান মহাজোট সরকারের মেয়াদের শেষ লগ্নে এসে এখনও কেন শুনতে হচ্ছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে? কেন, কাদের উস্কানিতে আদিবাসীদের ওপর হামলা, হত্যা, অপহরণের মতো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে? পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্ত ভূমির ওপর পাহাড়িদের অধিকার সংরক্ষণ, মালিকানা রক্ষায় আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আর সেটি করতে \’চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১\’ বিরোধার্থক ধারাগুলো সংশোধন করে আইন পাস করা জরুরি। এ ব্যাপারে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু ৪ বছরে সংশোধনীর বিল সংসদে উত্থাপিত হয়নি। সরকারের মেয়াদের মধ্যে তা না করা হলে ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা আরও বাড়বে। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনানিবাসের সম্প্রসারণ, ইকো পার্ক ও পর্যটন কেন্দ্র, রাবার চাষের জন্য জমি ইজারা দেওয়া তা ভূমি সংকটকে তীব্র করেছে। চলমান এ প্রক্রিয়ার অবসান হওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জমির ওপর অধিকার স্থায়ী পাহাড়ি ও আদি বাঙালিদেরই, এখানে ভূমির অধিকার বহিরাগতদের নয়। জনসংহতি সমিতির অভিযোগ, \’অব্যাহতভাবে সমতল অঞ্চল থেকে বহিরাগতরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকছে এবং বসতি গড়ে তুলছে। তারা পাহাড়ি-বাঙালি স্থানীয় অধিবাসীদের জায়গা-জমি জবরদখল করছে।\’ এ অভিযোগ গুরুতর। এভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাহাড়ে অনুপ্রবেশের সুযোগ দেওয়া শান্তির পথে বড় হুমকি। দ্রুত তা বন্ধ করা উচিত। সেই সঙ্গে ভাবা উচিত তাদের কথাও, সমতল থেকে যেসব নদীভাঙা ও দুস্থ জনগোষ্ঠীকে প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়ে নিয়ে আসা হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে তাদের \’মানবঢাল\’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা গুচ্ছগ্রামে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব ভাগ্যহত ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনের পথও সরকারকে ভাবতে হবে।
শান্তিচুক্তির ১৫ বছরে কোনো অগ্রগতি ঘটেনি_ তা বলা যাবে না। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি ঘটেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের হাতে যেসব প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর করার কথা, তার দীর্ঘসূত্রতা কাম্য নয়। এটি আমি বুঝে উঠতে পারি না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। আর সেটি করার মধ্য দিয়ে পার্বত্যবাসীকে সম্পৃক্ত করা হলে শান্তিচুক্তির জনগণের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। তা কেবলই বিলম্বিত হচ্ছে। মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগসহ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির বিষয়টি এখনও উপেক্ষিত।
কাপ্তাই বাঁধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যে ব্যাপক আদিবাসী উদ্বাস্তু হয়েছে (যার মধ্যে স্থানীয় বাঙালিও আছে) তাদের পুনর্বাসন, চাকরি-বাকরিতে অগ্রাধিকার নীতি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে জাতীয় উন্নয়নের ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, নীতিনির্ধারকরা কিন্তু দ্বিমত করছেন না। তবে কেন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না?
এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় \’বিশেষ শাসন ব্যবস্থা\’ গড়ে তোলার তত্ত্বগত বিষয়টি পরিষ্কার নয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখে শুনেছি, পাহাড়িরা ঢাকায় এসে জায়গা কিনলে আপত্তি নেই, পার্বত্য চট্টগ্রামে আমি কিনতে গেলে ভিন্ন কথা কেন শুনব? এই মনস্তাত্তি্বক সমস্যা মাথায় থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তার মর্যাদা, বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও ক্ষমতায়ন করা কি সম্ভব? বলা বাহুল্য, এ মানসিকতা সমতলের আদিবাসীদের উন্নয়নেও বাধা।
সরকার শান্তিচুক্তি করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে, কিন্তু নীতিনির্ধারক ও আমলাদের বড় অংশ এই চুক্তির মর্মবাণী উপলব্ধিতে অক্ষম। এই ভ্রান্ত মানসিকতায় যারা ভুগছেন, তাদের হাত দিয়ে শান্তিচুক্তি, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা, বহুত্ববাদী সমাজে সংহতি রচনার কাজ সত্যিই দুরূহ।
আমাদের স্মরণ রাখা দরকার, বাংলাদেশ কেবল বাঙালির দেশ নয়, বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এই জনপদে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো, খাসিয়া, মণিপুরিসহ বহু জাতিসত্তার মানুষ যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। এসব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন ঐকতান আছে, তেমনি আছে ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য। এই বহুত্ববাদের মধ্যেই অসাম্প্রদায়িক ও সেক্যুলার বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও সৌন্দর্য। বাংলাদেশ জনপদের সব জাতির, ধর্মের, বর্ণের ও ভাষার মানুষের মাতৃভূমি। তাই দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আমরা সব জাতি ও ধর্মের মানুষ একাত্তরে একসঙ্গে লড়েছি। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি ও আদিবাসীর রক্ত এক ধারায় মিশে সে বন্ধনকে আরও দৃঢ় করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর সে সত্য উপলব্ধি না করে মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডিত চেতনা ধারণ করে স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালির জাতিরাষ্ট্র গড়ার যে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ব্যথিত করেছিল। এ কারণে বিভেদের দেয়াল।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শান্তিচুক্তি সে দেয়াল ভেঙে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পথ রচনা করেছে। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সামনে আরও একটি সুযোগ অবারিত হয়েছিল, সেটি আদিবাসী পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি।
সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসী একত্র হয়ে আদিবাসীর সাংবিধানিক স্বীকৃতির যে আওয়াজ তুলেছিল, তা ছিল যৌক্তিক। কিন্তু সরকার, মন্ত্রী-এমপিদের মাথায় ঢুকল এক অদ্ভুত যুক্তি_ ওরা আদিবাসী হলে আমরা নবাগত হয়ে যাব? অথচ জাতিসংঘের আইএলও কনভেনশন ১০৭ (বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে) ও ১৬৯ পড়লে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের যে জনগোষ্ঠীকে আমরা উপজাতি বলে চিহ্নিত করছি, তারা প্রকৃতপক্ষে আদিবাসী। আইএলও কনভেনশন দুটিতে আদিবাসীর যে বৈশিষ্ট্য থাকার কথা, তা তাদের মধ্যে দৃশ্যমান। সনাতনী জীবন পদ্ধতি, প্রথা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যরা প্রবেশের আগে কোনো অঞ্চলে বসতি স্থাপনের ইতিহাস আছে তাদেরও। এ ইতিহাস কারও অজানা নয়, পাহাড়ে সবার আগে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরংসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বসতি গড়ে তুলেছে। ভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তারা ধারণ করে আছে, একইভাবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে গারো, সাঁওতাল, মুণ্ডা, খাসিয়া, মণিপুরিসহ অর্ধশত জাতিসত্তার মানুষ। সংবিধানে আদিবাসী স্বীকৃতি প্রদানের মধ্য দিয়ে তাদের কাছে টানার ও বাঙালি আদিবাসীর মধ্যে সৌহার্দ্যের বন্ধন আরও নিবিড় করার যে সুযোগ ছিল, তা মহাজোট সরকার গ্রহণ করতে পারেনি।
আমরা বাঙালিরা সংখ্যাগুরু হতে পারি। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের জোরে সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ওপর অবমাননাকর কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না। উদার মানবিক দৃষ্টিতে সবকিছু বিবেচনা করা দরকার। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, সব জাতি, সব ধর্মাবলম্বী, সব ভাষার ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষ একাট্টা হতে পারার মধ্যেই জাতির কল্যাণ নিহিত। উগ্র জাতীয়তাবাদ বা ধর্মান্ধতাকে মোকাবেলা না করে কল্যাণের ধারা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।