pakistanদুই হাজার কিলোমিটার দূর থেকে আমরা পাকিস্তানের জনগণের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করছি। শত প্রতিকূলতার মুখেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারার আনন্দে সে দেশের জনগণ উদ্বেলিত। সেখানে অস্ত্র দেখিয়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের ঘটনা বহুবার ঘটেছে। পাকিস্তানের ৬৬ বছরের অধিকাংশ সময় কেটেছে সেনাশাসনে। সেখানে সেনাবাহিনীকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। অপরদিকে নির্বাচিত সরকারের শাসনকালের পূর্ণ মেয়াদ পূরণের ঘটনাও পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম।
নির্বাচনে সন্ত্রাস, অপঘাতে মৃত্যু, কারচুপি, অর্থের ছড়াছড়ি সবই ছিল। এসব উপসর্গ ছাড়া শান্ত পরিবেশে নির্বাচন হবে, তা হয়তো কেউ ভাবেননি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ছিল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন। সেটি সফল হওয়াটাই পাকিস্তানের রাজনীতিতে শুভ সংবাদ।
সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে বিজয়ী নেতা মিয়া নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বে জনগণ এখন হয়তো সন্ত্রাসের অবসান ও জননিরাপত্তার কথা ভাবছেন। তারা ভাবছেন, পাকিস্তানের মাটিতে আর কোনোদিন মার্কিনি ড্রোন হামলা হবে না, জাতীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না, দিবারাত্রি আর বিদ্যুৎহীন অবস্থায় কাটাতে হবে না, অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হবে, সুশাসন কায়েম হবে। এমন স্বপ্ন নিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগকে দেশ চালানোর ম্যান্ডেট দিয়েছে।
\’মি. টেন পার্সেন্ট\’ বলে অভিহিত আসিফ আলি জারদারির নেতিবাচক ভাবমূর্তি, পিপিপি সরকারের অপশাসন, সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নগামিতা, জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় অক্ষমতা, দলীয় নেতাদের মধ্যে কোন্দল, পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব ইত্যাদিতে দলটির ভরাডুবি হয়েছে। তবে এসবের বিপরীতে নওয়াজ শরিফ জনগণের অত্যন্ত আস্থাভাজন, এমনটিও কিন্তু নয়। কারণ ইতিপূর্বে ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালে দুর্নীতি ও অপশাসনের অভিযোগ নিয়েই তাকে সরে যেতে হয়েছে। তবে এবার তিনিই ছিলেন অগত্যা একমাত্র বিকল্প। এক সময়ের ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ রাজনৈতিক সুনামি ঘটানোর ঘোষণা দিলেও দলটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়নি। তবে খাইবার-পাখতুনে বৃহত্তর দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ নিশ্চয়ই বড় প্রাপ্তি। সে যা-ই হোক, পিপিপি এবং তাদের সহযোগীদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের কারণেই পিএমএল-এন\’কে পাকিস্তানি জনগণ বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে। ব্যাপারটা বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনীয়। বিএনপির ওপর অতিষ্ঠ হয়ে আওয়ামী লীগ কিংবা আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বিএনপিকে সমর্থন করার সঙ্গে মিল আছে। উল্লেখ্য, পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে আবার নওয়াজ শরিফের অতীত কর্মকাণ্ড ফুটে উঠবে। জনগণের মনে পড়বে তার অতীতের দুটি শাসনামলের দুর্নীতি ও ব্যর্থতার কথা, জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গে তার সখ্যের জারিজুরি এবং পাঞ্জাবে তার ভাইয়ের দৌরাত্ম্য।
সফল পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্য দিয়ে অতীতের দুর্নীতি ও ব্যর্থতাকে আড়াল করার সুযোগ আছে। পরিশুদ্ধ হওয়ারও সুযোগ আছে তার। সবকিছু নির্ভর করছে নওয়াজ শরিফ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন, কীভাবে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করবেন, তার ওপর।
প্রথম চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক। পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধি যখন ৩.৫ শতাংশ, তখন এই পড়ন্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কার্যকর কী পদক্ষেপ নেবেন_ সেটি দেখার বিষয়। অভ্যন্তরীণ সম্পদে এগোবার শক্তি নেই। এ কারণে দাতা সংস্থাগুলোর কাছে হাত পাততে হবে। প্রয়োজন হবে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের আশীর্বাদ। এ ক্ষেত্রেও তালেবান মোকাবেলার জন্য পদক্ষেপের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ড্রোন হামলা বন্ধসহ বিভিন্নভাবে তালেবানদের অনুকূলে রেখেই তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছেন। সেটি তাকে নিয়ে বিতর্কের অন্যতম বিষয়ও বটে। সে ক্ষেত্রে এই সমর্থক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার বিষয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চটে গেলে সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রটি সংকুচিত হবে। আর কেবল মার্কিনিদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নই নয়, প্রতিবেশী ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও তাকে তালেবান দমনের কথা ভাবতে হবে। সর্বোপরি ভাবতে হবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং সামগ্রিক কল্যাণের কথা। মনে রাখা দরকার, তালেবানি তৎপরতা থাকলে ড্রোন হামলা বন্ধ হবে না। আর ড্রোন হামলা থাকলে জাতীয় মর্যাদাও পুনরুদ্ধার হবে না। দেশের বিপুলসংখ্যক জনগণ তালেবানি তৎপরতা ও ড্রোন হামলা দুই-ই চায় না। তবে জনগণের একাংশের মধ্যে তালেবানদের সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধন আছে। এমন সম্পর্ক রয়েছে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কখনও নেপথ্যে, কখনও প্রকাশ্যে রাজনীতির কলকাঠি নেড়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে বাগড়া দিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ইতিপূর্বে নওয়াজ শরিফের নেওয়া ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে লাহোর-দিলি্ল ট্রেন যোগাযোগের আয়োজনে সেনা নেতৃত্ব প্রকাশ্যে বৈরী আচরণ করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়ার ভেতরে রয়েছে ভারতবিদ্বেষ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তালেবানপ্রেম। প্রশ্ন হচ্ছে, হাতে গড়া শক্তিকে কী করে গলাটিপে ধরবে তারা? তাই এই সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে রাজনীতি নিরাপদ রাখা এবং প্রতিবেশী ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন খুবই কঠিন কাজ। যে কাজ করা ও না করা দুই-ই নওয়াজ শরিফকে ঝুঁকির সম্মুখীন করবে। সে ক্ষেত্রে তাকে অত্যন্ত দূরদর্শিতা ও দক্ষতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে।
স্বল্পশিক্ষিত বেকার যুবকরা মৌলবাদী-জঙ্গি সংগঠনগুলোতে নাম লিখিয়েছে বা লেখাচ্ছে। পাকিস্তানকে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদমুক্ত দেশ গড়তে হলে ব্যাপক প্রশাসনিক-সামরিক পদক্ষেপের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দরকার। বেকারদের কর্মসংস্থান জরুরি। একইভাবে পরিচালনা করতে হবে মতাদর্শিক সংগ্রামও।
কী সেই মতাদর্শিক সংগ্রাম_ ইসলামী হুকুমত? পাকিস্তানের ৬৬ বছরে ইসলামী হুকুমত গড়ার প্রবণতা দেশটিকে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে দেয়নি। অপরদিকে পাকিস্তান পরিণত হতে পারেনি একটি শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্রেও। উপরন্তু সুনি্ন, শিয়া, আহমদিয়াসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানি সামাজিক শান্তি বিঘি্নত করে চলেছে। রাজনীতি ও অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করেছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে, ইসলামই পাকিস্তানের রক্ষাকবচ। কিন্তু ধর্মের এই জিগির তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে ধরে রাখতে পারেনি। এখনও তা পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকে অভিন্ন রাজনীতিতে গ্রথিত করতে পারছে না। এমনকি সারা পাকিস্তানে কোনো একক দল প্রাধান্য বিস্তার করতে সমর্থ হচ্ছে না। এবারের নির্বাচনেও তার প্রমাণ মিলেছে। নওয়াজের মুসলিম লীগ কেন্দ্র ও পাঞ্জাবে প্রাধান্য বিস্তার করতে পেরেছে। কিন্তু সিন্ধুর শহরাঞ্চলে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম), সিন্ধুর গ্রাম এলাকায় পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), খাইবার-পাখতুনে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এবং জামায়াত-আল-ওয়ালামা (ফজলুর) ভালো করেছে। উপর্যুপরি তালেবানি আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত বেলুচিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিপর্যয় ঘটেছে। তবে সেখানে বেলুচ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মোর্চা তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে।
প্রদেশগুলোতে রয়েছে পাঞ্জাবি শাসনের প্রতি ক্ষোভ। একসময় ভারত থেকে আসা রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক আমলারাই ছিল পাকিস্তানের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। সেই মোহাজের নেতৃত্বের স্থলে এখন পাঞ্জাব হয়ে উঠছে শাসন-প্রশাসন এবং অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি। এ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অন্যান্য প্রদেশের জনগোষ্ঠীর ক্ষোভের কারণে পাঞ্জাবের কোনো নেতার প্রতি সমগ্র জনগোষ্ঠী আস্থা দেখাতে পারছে না। এবারও পাঞ্জাবের বাইরের প্রদেশগুলোতে বিরোধী সরকার গঠিত হবে। সেটিও নওয়াজের জন্য চ্যালেঞ্জ।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে প্রদেশগুলোর জনজীবনের সমস্যা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান বহু ভাষা ও জাতির রাষ্ট্র_ যেসব জাতি ও ভাষার মানুষ পাকিস্তানি শাসন কাঠামোর মধ্যে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি লালন আর বিকাশের জন্য সচেষ্ট। সেদিকে সম্মান না দেখিয়ে, পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক উন্নতি না ঘটিয়ে কেবল ধর্মীয় সংহতির কথা বলে কি পাকিস্তানের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব?
পাকিস্তানে জোতদার ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছে কুক্ষিগত রাষ্ট্র ও রাজনীতি। সেই আধিপত্যের জাল ছিঁড়ে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছে, নাগরিক সমাজ মুক্তচিন্তা করছে। সমাজের এই অগ্রসর মানুষের কাছে ধর্মীয় উন্মাদনা নয়, পারমাণবিক গর্ব নয়, তাদের আকাঙ্ক্ষায় আছে আধুনিক গণতান্ত্রিক পাকিস্তান। যে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যয়িত হবে সাধারণ মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে; সেই জনআকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র গড়তে, জননিরাপত্তা ও জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে কতটুকু পারদর্শিতা দেখাবেন তিনি, তার ওপরই নির্ভর করবে পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা নওয়াজ শরিফের সাফল্য আর পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ।