সিডর-আইলার ছোবলে প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য আমরা চোখের জল ফেলেছি। স্পেকট্রাম-তাজরীন-রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির জন্য অতিলোভী মালিকদের কঠোর সমালোচনা করেছি বা করে চলেছি। রাজনৈতিক সহিংসতায় জানমালের ক্ষতির জন্য কখনও সরকার, কখনও বিরোধী দলকে দায়ী করছি। কিন্তু গত ৫ ও ৬ মে যেভাবে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে অর্ধশত (পত্রপত্রিকার দেওয়া তথ্য_ বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে) মানুষের প্রাণহানি ও ব্যাপক ধ্বংসলীলা সংঘটিত হলো তা কীভাবে দেখব?
হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ ও শাপলা চত্বরের সমাবেশ ঘিরে এসব ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজত নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন বলে দাবি করছে। যদিও ১৮ দলের অন্তর্ভুক্ত চারটি দলসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী দল হেফাজতের শরিক। তাদের ১৩ দফার মধ্যে ইসলামপন্থি দলগুলোর রাজনৈতিক দাবি-দাওয়াগুলোও সনি্নবেশিত রয়েছে। তবে ইসলামপন্থি দলগুলোর রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার বাইরে ইসলামের অবমাননাকারী নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি, কাদিয়ানিদের নিষিদ্ধ করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করা, শিক্ষা নীতি ও নারী নীতি বাতিল, সমস্ত ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ অসাম্প্রদায়িক উৎসব ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা রয়েছে।
প্রচলিত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি এবং ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি আলেম-ওলামাদের ক্ষোভ নতুন নয়। ইংরেজ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাকে ইংরেজি শাসনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার ভ্রান্ত প্রবণতা ব্রিটিশ ভারতেই দেখা দিয়েছিল। এর বিপরীতে আড়াইশ’ বছর আগে ভারতের দেওবন্দে যে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তিত হয়েছিল, বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো সেই নেসাবের অনুসারী। বিশ্ব বদলেছে, কিন্তু কওমি মাদ্রাসায় সেই সময় প্রবর্তিত দরসে নিজামিয়া নেসাব বা কারিকুলামের কোনো হেরফের হয়নি। এখানে অঙ্ক, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, ইংরেজি পড়ানো হয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা চালু হলেও তা যথেষ্ট নয়। এখনও উচ্চতর শ্রেণীতে আরবি-ফারসি কেতাবের উর্দু তরজমাই পড়ানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে ইতিহাস, ঐতিহ্য, আধুনিক শিক্ষা, নারী অধিকারবিদ্বেষী মনোভাব শানানো হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ইসলামী জলসায় কওমি মাদ্রাসার একশ্রেণীর মাওলানা এগুলো বয়ান করে আসছেন। যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুখেও শিক্ষাঙ্গনে নারী-পুরুষের চলাফেরা, ভাস্কর্য, মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালনসহ বিভিন্নম্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বানোয়াট ও অশ্লীল বয়ান শোনা যেত। গত ৬ এপ্রিল ও ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজত নেতাদের মুখে ওই বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শুনেছি। এর সারসংক্ষেপ হলো_ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘নাস্তিকবাদী’ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, ব্লগে ইসলামের অবমাননা হচ্ছে, শহরে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি পূজা হচ্ছে, মোমবাতি জ্বালিয়ে অগি্নপূজা হচ্ছে, বেতার-টেলিভিশনে দাড়ি-টুপিধারীদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হচ্ছে ইত্যাদি।
মাদ্রাসার তরুণ-কিশোর তালেবে আলেমদের মধ্যে তাদের শিক্ষকরা আধুনিক শিক্ষা ও জীবনের বিরুদ্ধে যে ঘৃণার বীজ বপন করছেন, তার প্রকাশ ঘটেছে ৫ মে গুলিস্তান, তোপখানা, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তাদের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা ও নৃশংস আচরণে। ‘পাপের শহরে’ তারা সামনে যা পেয়েছে তা-ই ভাংচুর করেছে, আগুন দিয়েছে। ফুটপাতে হকারের দোকান, বইয়ের দোকান, বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণের দোকান, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ভস্মীভূত করেছে, আইল্যান্ড উপড়ে ফেলেছে, অসংখ্য গাছ কেটেছে, অগণিত গাড়ি ও অর্থ প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে। বায়তুল মোকাররমের বইয়ের দোকানে অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে কোরআন-হাদিস শরিফও পুড়েছে।
কমিউনিস্টদের ওপর লালিত ঘৃণা তাদের অনেক দিনের, তাই তাদের অফিসে আগুন দিয়েছে। নাস্তিকদের ‘আশ্রয়দাতা’ আওয়ামী লীগ অফিসেও হামলা করেছে। ওরা প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। সঙ্গে ছিল গানপাউডার, করাত, শাবল ইত্যাদি। তবে ৬ এপ্রিল যেভাবে নারী সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়ে মনের জ্বালা মিটিয়েছিল, এবার তা করার সুযোগ পায়নি। কারণ সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলো গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে এবার হেফাজতের সমাবেশ কভার করতে নারী সাংবাদিকদের পাঠায়নি।
তারা এসেছিল চূড়ান্ত খেলার জন্য। হয় সরকার ১৩ দফা মানবে, না হয় সরকার ফেলে দিয়ে তারা নিজেরা সরকার গড়বে (শাপলা চত্বরে হেফাজত নেতারা এমন কথাই বলেছেন)। পুলিশের ওপর তীব্র ক্ষোভ থেকে তাদের ওপরও হামলা করেছে। পিটিয়ে পুলিশ সদস্যকে হত্যা করছে, পুলিশের প্রতিরোধে হেফাজতের কর্মীরাও প্রাণ হারিয়েছে। এভাবে ৫ মে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত গুলিস্তান, তোপখানাসহ আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।
৫ মে বিকেলেও হেফাজতের প্রশ্রয়দাতা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছিলেন, হেফাজতের ব্যানারে জামায়াত-শিবির এসব ধ্বংসলীলা করছে। হেফাজতের ব্যানারে জামায়াত-শিবিরের অংশগ্রহণ স্বাভাবিক, কিন্তু কেবল জামায়াতকে দায়ী করে হেফাজতিদের ধোয়া তুলসীর পাতা প্রতিপন্ন করার ব্যাপারটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নতুন কোনো বেতাল উক্তি নয়, এটি সম্ভবত হেফাজতের দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি অতিরিক্ত আস্থাশীলতারই প্রকাশ। যতদূর জানা গেছে তা হলো_ হেফাজতে ইসলাম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে তারা ফিরে যাবে। কিন্তু ঘটে গেল অন্য খেলা । হেফাজতের মধ্যে কট্টরপন্থিরা এমনভাবে বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন, তা থেকে ধারণা দেওয়া হলো যে, শাহ আহমদ শফী এসে লাগাতার অবস্থানের নির্দেশ দেবেন। শাহ শফী সভাস্থলে রওনা হওয়ার পর তাকে ফিরিয়ে লালবাগে নিয়ে যাওয়া হলো। বৃদ্ধ শফী সাহেবের অবস্থা তখন সম্রাট শাহজাহানের মতো, তার সন্তান আনাস মাদানী ও অন্যদের হাতে বন্দি তিনি। শাপলা চত্বরে ফরমান জারি হলো_ আমির সাহেবের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত অবস্থান করুন। এরই মধ্যে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসতে এবং হেফাজতের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপির সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম বা তার একাংশের আঁতাত আগেই হয়েছিল। যে কারণে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাব তাচ্ছিল্য করে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন আগের দিন ৪ মে শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে।
৬ এপ্রিল সরকার হেফাজতিদের শান্তিপূর্ণভাবে ফিরিয়ে দিতে পেরেছিল। এতে নাখোশ হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। আর দ্বিতীয় রাউন্ডে সফল খালেদা জিয়ার ১৮ দল। সাফল্যের পরাকাষ্ঠা দেখালেন ১৮ দলের শরিক হেফাজতের অন্তর্ভুক্ত নেজামে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত মজলিশ নেতারা।
এ পরিস্থিতিতে সরকার পুলিশ-র্যাব-বিজিবি যৌথভাবে অতি অল্প সময়ের অভিযানে তাদের হটিয়ে দিয়েছে। রাত জেগে যখন টিভির পর্দায় সেই অভিযানের দৃশ্য দেখছিলাম, তখন অনেকের মতো আমিও অচলাবস্থার অবসানে স্বস্তিবোধ করছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম, মাদ্রাসায় শিক্ষারত কিছু কিশোর হাত উঁচিয়ে বা কানে হাত দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে পুলিশের করুণা ভিক্ষা করছে। হয়তো বলছে, আমাদের মেরো না। তখন আমার মনে পড়ল আমার প্রতিবেশী ও গরিব আত্মীয়ের সন্তানের কথা। যাদের অনেকের বাবাকেও আমি হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় দেখেছি। তারা আমাকে বলেছে যে, ‘ছেলেটাকে স্কুলে দিতে পারলাম না। কওমি মাদ্রাসায় দিয়েছি। ওখানে টাকা-পয়সা লাগে না।’ আমি বাড়িতে গেলে ওই ছেলেগুলো লম্বা কুর্তা পরে এসে দেখা করে, সালাম দেয়। অত্যন্ত আদব-লেহাজের সঙ্গে কথাও বলে।
রাতের অভিযানে ওই কিশোরদের অসহায় মুখ দেখে আমার গ্রামের ছেলেগুলোর কথাই মনে পড়ছিল। জানি না, ওদের মধ্যে আমার স্বজনের কোনো সন্তান ছিল কি-না। সেটি থাক আর না-ই থাক, ওরা দেশের সন্তান, আমাদেরই সন্তান।
স্বাধীনতার ৪২ বছরে রাষ্ট্র এসব হতদরিদ্রের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষার দায়িত্ব নিতে পারেনি। কওমি মাদ্রাসায় কী পড়ানো হয় তার খোঁজ রাখেনি। কখনও কখনও দায়িত্ব গ্রহণ ও কারিকুলাম পরিবর্তনের কথা বলেছে, কিন্তু সব শূন্যে মিলিয়ে গেছে।
আমরা সুবিধাভোগীরা দেশের সব সুবিধা ভোগ করছি। ওদের শিক্ষা না দিয়ে, আলোকিত জীবন না দিয়ে অন্ধকারে রেখেছি। জানি না জাতি সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে কি-না!
আমাদের মতো ক্ষমতাহীন সাধারণ নাগরিকরা এই সত্য উপলব্ধি করলেও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো তা কতটুকু উপলব্ধি করছে? ক্ষমতার মোহে অন্ধ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিযোগিতামূলকভাবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করেছে এবং করছে। ভোটব্যাংক হিসেবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে নিয়ে টানাটানি করেছে। এখন হেফাজতিদের নিয়েও কাড়াকাড়ি করছে। এ খেলায় আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অনেক পারদর্শী। আওয়ামী লীগের নেতারা যতই ইসলামী লেবাস পরিধান করুন আর শেখ হাসিনা যতই পরহেজগার হোন না কেন, মৌলবাদী দলগুলোর মন তারা জয় করতে ব্যর্থ। পক্ষান্তরে বিএনপি নেতারা টাই-সুট পরে, নেত্রী খালেদা জিয়া আধুনিক চালচলন বজায় রেখেও মৌলবাদীদের আস্থা কুড়াতে পারছেন। এর পেছনে ঐতিহাসিক বাস্তবতা আছে_ যা নিয়ে ইতিপূর্বে একাধিকবার লিখেছি।
সবচেয়ে পীড়াদায়ক ব্যাপার, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আজ ভ্রান্ত রাজনীতির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। কল্পিত শত্রু নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে ধর্মরক্ষার দোহাই পেড়ে তাদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ জন্য দায়ী কেবল পশ্চাৎমুখী আলেম-ওলামা ও ধর্মব্যবসায়ীরাই নন, এর পেছনে যেমনি আছে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, তেমনি আছেন একশ্রেণীর বিভ্রান্ত বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক। যারা সংবাদমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পথে নামিয়েছেন। চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে বলে যে ধর্ম ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন, তার চেয়ে কি তারা কম অপরাধী_ যারা ব্লগে ইসলামের অবমাননা হচ্ছে এমন তথ্য দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করেছেন।
এ বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও আদর্শহীনতার বিরুদ্ধে প্রগতিবাদী রাজনীতির পাশাপাশি সুস্থধারার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন জরুরি। অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন করতে হবে, এই অগণিত কিশোর-তরুণের জীবনকে আলোকিত করতে হবে_ যাতে তাদের কেউ বিভ্রান্ত করতে না পারে, রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।