bangladeshআমার শৈশব কেটেছে পঞ্চাশের দশকের গ্রামবাংলায়। তখন সেখানে ভূতের গল্পের ছড়াছড়ি। হরহামেশাই শোনা যেত, অমুককে ভূত ভয় দেখিয়েছে। তমুককে তাড়া করেছে। আবার কারও ওপর আসর হওয়ার ঘটনা ঘটত। মেয়েদের ওপর ভূত এবং ছেলেদের ওপর পেত্নী ভর করত। ওঝারা শর্ষে পড়া আর ঝাঁটাপেটা করে ভূত তাড়াত।
তখন ভূত বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে ভূতের জন্মরহস্য শুনেছি। তা হলো দুষ্ট নর-নারীরা মৃত্যুর পর ভূত ও পেত্নী হয়ে এসব উৎপাত করছে। বাবার কাছে যখন এ সম্পর্কে জানতে চাইলাম তিনি বললেন, \’ভূত বলে কিছু নেই। এসব হচ্ছে মনের ধন্ধ।\’ আমিও সেই বিশ্বাসে অটুট রয়েছি যে, মৃত্যুর পর মানুষ কখনও ভূত হয়ে ফেরে না, তবে \’৭১ সালে যে পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে সেই পাকিস্তানের প্রেতাত্মা যে স্বাধীন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে_ তা কী করে অবিশ্বাস করব?
স্বাধীনতার পরপরই শহীদের রক্তস্নাত বাংলার উদার মানবিক জমিনে উঁকি-ঝুঁকি দিতে শুরু করে পাকিস্তানি প্রেতাত্মা। এর প্রতিফলন ঘটে সরকারের বিভিন্ন আচরণে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষিত হলেও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নিজেদের মুসলমান ও বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র বলে পরিচয় দেওয়ার ঝোঁক দেখা যায়। তবে পাকিস্তানি ভূত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম আসর করে কতিপয় সেনা কর্মকর্তা ও খন্দকার মোশতাক আহমদের ওপর। পাকিস্তানি কায়দায় ক্যু করে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, শুরু হয় পরিত্যক্ত পাকিস্তানি ভাবাদর্শের উল্লম্ফন। খন্দকার মোশতাক জয় বাংলার স্থলে পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে প্রমাণ করলেন যে, সত্যি তার ওপর পাকিস্তানি ভূত আসর করেছে। বাংলাদেশ বেতার হয়ে গেল রেডিও বাংলাদেশ। আর ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রতিধ্বনি করে বললেন_ ধর্মকর্ম গণতন্ত্র।
তারপর এলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। তৈরি করলেন ধর্মকর্ম, গণতন্ত্র আর সামরিকতন্ত্রের ককটেল জিয়াতন্ত্র_ যা পাকিস্তানের আইয়ুব খান, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানসহ সামরিক শাসকদের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গেই তুলনীয়। তারই ফরমানে ঠুঁটো জগন্নাথ সংসদে পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ছেঁটে ফেলা হয়। সেখানে প্রতিস্থাপিত হয় \’সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস\’। সংবিধানে লেখা হয় \’বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম\’।
ধর্মপ্রাণ মানুষ সাধারণ নিয়মেই \’বিসমিল্লাহির … রাহিম\’ বলে কাজ শুরু করেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখেন। সর্বদাই ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে এ বিশ্বাস ও রেওয়াজ অটুট ছিল। সংবিধানে সংযোজন করার মধ্য দিয়ে এ বিশ্বাস নতুন মাত্রা লাভ করেনি। ধর্মকে মহিমান্বিত করেনি বরং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে আহত করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফয়সালা হয়ে গিয়েছিল যে, রাজনীতি ও ধর্ম মেলানো যাবে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র হবে সবার। সংবিধানের গায়ে ধর্মীয় ছাপ সেই নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, জিয়াউর রহমান কি এই পরিবর্তন ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে করেছিলেন? না, এমনটি ভাবার কোনো জো নেই। আসলে এটি ছিল রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগানোর কৌশল। সবারই অনুধাবনযোগ্য যে, কৌশল কোনো বিশ্বাস বা চেতনাগত ব্যাপার নয়। আমাদের সমাজে ধর্মের মানবিক চেতনা ধারণ করে অনেক মহৎ কাজের দৃষ্টান্ত আছে। সংগ্রামের ইতিহাস আছে। তিতুমীর ধর্মের মানবিক চেতনা ধারণ করে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে বাঁশের কেল্লা গড়ে সাহসী লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আছে এমনই আরও সোনালি অধ্যায়। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা ধর্মের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের বিরুদ্ধে সেদিন আওয়ামী লীগসহ বামদলগুলো প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু কার্যকরভাবে মোকাবেলা করেনি। বরং আপস করেছে, জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে ধর্মকে ব্যবহারের প্রতিযোগিতা করেছে আওয়ামী লীগ। জামায়াত যখন বলেছে, \’যা করে আল্লায়/ ভোট দেব পাল্লায়\’। তখন এর অনুকরণে বিএনপি স্লোগান দিয়েছে, \’ধানের শীষে বিসমিল্লাহ\’। আর আওয়ামী লীগ বলেছে, \’নৌকার মালিক তুই আল্লাহ\’। \’৭৫-উত্তর রাজনীতিতে এভাবেই ধর্মের ব্যবহারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাইকে টেক্কা দেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি পাকিস্তানের অনুকরণে রাষ্ট্রধর্ম বিধান প্রবর্তন করেন। মজার ব্যাপার এই যে, পাকিস্তানের সংবিধানের ২। অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্ম বিধান রয়েছে। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে অনুরূপভাবে ২।ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজিত হয়। এটি পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম বিধানের কার্বন কপি।
স্বীকার্য যে, চূড়ান্ত বিচারে জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুসারী নন, কিন্তু তাদের ভ্রান্ত নীতি মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতির বীজতলা তৈরি করেছে, বিষবৃক্ষের ঝাড় বংশবিস্তার করেছে, ডালপালা ছড়িয়েছে, যা বিষাক্ত ফণা তুলে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর ছোবল হেনে চলেছে। ক্ষমতার মোহে বড় রাজনৈতিক দলগুলো সেই বিষধর সাপ নিয়ে এখন খেলছে।
সরকার এখনও দুই নৌকায় পা দিয়ে আছে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও মহাজোটের সহযোগী দলগুলোর হুঁশিয়ারিতে কান দিচ্ছে না সরকার। ছলে-বলে-কৌশলে \’হেফাজতের\’ ভোটব্যাংক দখল করার নীতি অনুসরণ করছে। মদিনা সনদ ও বিদায় হজের ভাষণ অনুসরণে দেশ চালানোর কথা বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্নভাবে হেফাজতকে কাছে টানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বিএনপি। লজ্জার মাথা খুইয়ে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে নিয়েই তারা পথ চলছে। হেফাজতকে খুশি করতে তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া শাহবাগের তরুণ আন্দোলনকারীদের \’নাস্তিক\’ ও \’নষ্ট\’ আখ্যায়িত করেছেন। ঢাকায় আগত হেফাজতিদের বিরিয়ানির প্যাকেট সরবরাহ করে, নেতাদের মঞ্চে পাঠিয়ে সংহতি ঘোষণা করে মন জয়ের চেষ্টা করেছেন। ১৮ দলের গোটা পাঁচেক ইসলামী দলের নেতারা সরাসরি হেফাজতে ইসলামের জোটে শরিক। তাই বলা যায়, এবারও ধর্মান্ধ ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের মন জয়ের সফল কারবারি খালেদা জিয়া। তবে এতে নিবাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে কি-না সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। আর এদের মন জয়ের জন্য শেখ হাসিনার সকল কলাকৌশলই মনে হয় পণ্ডশ্রম।
এটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপলব্ধি করার বিষয়ে যে, এ আলেম-ওলেমাদের ইমামতিতে জনগণ নামাজ পড়েন, কিন্তু তাদের কথায় ভোট দেন না। এ প্রসঙ্গে আটরশির পীরের গড়া \’জাকের পার্টি\’র কথা উল্লেখ করা যায়। ইতিপূর্বে মুরিদের সংখ্যা গুনে ভোটযুদ্ধে নেমেছিলেন; কিন্তু মুরিদানদের দু\’আনি ভোটও পাননি। একজন জাকের পার্টির নেতার গল্প শুনেছিলাম, তার নির্বাচনী এলাকায় মুরিদ ছিল এক লাখ। প্রতিটি মুরিদের পরিবারে তিনজন সদস্য থাকলে ভোট পাওয়ার কথা ছিল তিন লাখ; কিন্তু পেয়েছিলেন তিন হাজার।
হেফাজতে ইসলামের আওতার মধ্যে ১৫ হাজার কওমি মাদ্রাসার ২০ লাখের ওপরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছেন, এটি সত্য। তাদের পক্ষে ওই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বড় অংশকে ঢাকায় এনে চমক দেখানো সম্ভব। কিন্তু তাদের কথায় কি ওই মাদ্রাসাছাত্রের পরিবার চলবে, ভোট দেবে? আমার এলাকার অনেক গরিব পরিবারের সন্তান কওমি মাদ্রাসায় পড়ে। ওদের কথা আমি জানি_ ভাই মাদ্রাসায় পড়ছে, বোন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে। ওই ভাই কি তার বোনকে হেফাজতিদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বলতে পারবে যে, তুমি গার্মেন্টে কাজ করো না। সেটি বলার অধিকার যেমনি সে রাখে না, তেমনি বোনের ভোটদানের সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করতে পারবে না। তাই ২০ লাখ মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র মানে ২০ লাখ পরিবারের সমর্থন নয়। ধরে নেওয়া যায়, বড়জোর ২০ লাখ ভোট (বাস্তবে মাদ্রাসার সব শিক্ষক-ছাত্র হেফাজতের আজ্ঞাবহ নয়); যা ৮ কোটি ভোটারের আড়াই শতাংশ।
বাংলাদেশে হেফাজতের আড়াই শতাংশ আর জামায়াতের ৫ শতাংশ ভোট নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। কিন্তু সিংহভাগ ভোটের মালিক জাগ্রত নতুন প্রজন্ম, নারী ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ (এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আদিবাসী-সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী)। যারা নির্বাচনের মূল ফ্যাক্টর।
এই অগণিত মানুষ ভাংচুর করছে না। হুঙ্কার ছাড়ছে না। তারা শান্তি চায়, স্বস্তি চায়। দেশের সাধারণ মুসলমানরা প্রতিবেশী হিন্দুর বাড়িতে হামলা হলে কষ্ট পায়। হিন্দুর মন্দির গড়তে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। হিন্দুরা প্রতিবেশী মুসলমানের হৃদয়ের বন্ধন অনুভব করে। এই অগণিত মানুষের চাওয়া সম্প্রীতির বাংলাদেশ, সব ধর্মের সব জাতির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারের বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠে নববর্ষে শহরের বর্ষবরণ ও গ্রামের মেলায়। সেখানে নারী-পুরুষ-শিশু ছুটেছে হাতে হাত ধরে। জনগণের স্রোতে ধাবমান মানুষের মনে কখনও মনে হয় না_ কে মুসলিম, কে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান। সবাই মায়ের সন্তান।
জননী বাংলাকে একাত্তরে সব সন্তান এক হয়ে মুক্ত করেছে। পাকিস্তানি জান্তাদের তাড়িয়েছে, ভাবাদর্শকে করেছে সমাহিত। আর সমাধি থেকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রেতাত্মা এসে হুঙ্কার ছাড়বে আর দেশবাসী ভয় পেয়ে যাবে_ তা কখনও হবে না। পাকিস্তানি ভূত ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের ভয় দেখাতে পারে, বিভ্রান্ত করতে পারে। কিন্তু দেশের ১৬ কোটি মানুষ এতে বিভ্রান্ত হবে না।
ধর্মের নামে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র যে জনগণ মোকাবেলা করেছে সেই জনগণ আজ ধর্মের নামে সব ষড়যন্ত্র, বিভ্রান্তির কূটচাল মোকাবেলা করতে সক্ষম_ তা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।