violence-3বিষয়টি উদ্বেগজনক। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা জামায়াত-শিবিরের আক্রমণের টার্গেট এখন। ১ এপ্রিল দলটির ক্যাডারদের হিংস্রতার শিকার হয়েছেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম। রাজশাহীর শালবন এলাকায় টহলরত পুলিশ দলের ওপর উপর্যুপরি বোমাবর্ষণের পর আহত জাহাঙ্গীরকে জামায়াত-শিবির কর্মীরা ইট ও হেলমেট দিয়ে মাথা থেঁতলে দিয়েছে, পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। তিনি এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। রাজশাহীতে এর একদিন আগে জামায়াত-শিবিরের বোমার আঘাতে পুলিশ সদস্য মকবুলের হাতের কব্জি উড়ে যায়। এ নিবন্ধ লিখছি তখন টেলিভিশনের পর্দায় সচিত্র খবর দেখলাম, এবার বর্বর হামলার শিকার হয়েছেন দিনাজপুরের চিরিরবন্দর এলাকার আর এক পুলিশ উপ-পরিদর্শক আবদুস সবুর। তার মাথাও থেঁতলে দিয়েছে হরতালকারীরা। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। যুদ্ধাপরাধের মামলায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর ১০ পুলিশ সদস্য জামায়াত-শিবিরের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এখন অহরহ ঘটছে পুলিশের ওপর পরিকল্পিত ও উপর্যুপরি হামলা, বন্দুক কেড়ে নেওয়া, পিটিয়ে হত্যার ঘটনা, মাথা থেঁতলে দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনা।
অতীতেও আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রাজপথে দেখেছি_ মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের বচসা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তবে পুলিশকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার ঘটনা এই প্রথম। প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক, পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সম্পর্ক একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। এর আগে দেখা গেছে, পুলিশ তেল গ্যাস বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির কর্মীদের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ করেছে। সিপিবি-বাসদসহ বাম দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর পেপার স্প্রে ছুড়েছে। এমনকি নিরীহ শিক্ষকদের পেপার স্প্রে ছুড়ে তাদের ধরাশায়ী করেছে। তখন পুলিশ জামায়াত-শিবিরের গাড়ি ভাংচুরসহ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে, কখনও কখনও ওদের হাতে মারও খেয়েছে, কিন্তু রুখে দাঁড়ায়নি। পুলিশকে সহাস্য বদনে রাজপথে জামায়াত-শিবির কর্মীদের হাত থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা নিতেও দেখা গেছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হয় পুলিশ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অথবা ওপরের নির্দেশে জামায়াত-শিবিরের প্রতি এমন অভাবিত নমনীয় আচরণ দেখিয়েছিল।
বলা বাহুল্য, নির্বাচনী অঙ্গীকার রক্ষায় সরকার চিহ্নিত কতিপয় যুদ্ধাপরাধীর বিচারের আয়োজন করলেও জামায়াতকে চূড়ান্তভাবে মোকাবেলার কোনো অভিপ্রায় তাদের ছিল না। বরং তখন জামায়াতকে বিএনপির কাছ থেকে আলাদা করার কলাকৌশল প্রয়োগ করছিল। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের কারণে সে কৌশল রহিত বা স্থগিত হতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে যুদ্ধাপরাধী দলের বিচারের বিষয়টি সংযোজন করায় অনুমিত হয় যে, সরকার জামায়াত নিষিদ্ধের কথা ভাবছে। আবার শাহবাগের আন্দোলন বন্ধ করার কলাকৌশল দেখে মনে হয়, সরকার যেমনি জামায়াতের সঙ্গে জটিল রাজনীতির খেলা খেলছে, তেমনি গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের সঙ্গেও অন্য এক খেলা খেলছে। ইতিমধ্যেই তিনজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি হুমকিদাতা ইসলামী দলগুলোকে খুশি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে সরকারের পূর্বের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ। সময়ই বলবে কোনটি সরকারের বিশ্বাস, আর কোনটি তাদের খেলা।
পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গেই ফেরা যাক। সরকারের দোদুল্যমান অবস্থান প্রমাণ করে, জামায়াতের তাণ্ডব হতে পারে_ এমন হিসাব সরকারের ছিল না। যে কারণে পুলিশকে সেভাবে প্রস্তুত করা বা সে অনুযায়ী পূর্বাহ্নে নির্দেশাবলি দেওয়া হয়নি। এমনকি জামায়াতের প্রভাবিত এলাকাগুলোতে পুলিশের বিশেষ ব্যবস্থাও যে গ্রহণ করা হয়নি তা বোধগম্য। কোনো কোনো এলাকায় জামায়াতবান্ধব পুলিশ কর্মকর্তা যে দায়িত্বে ছিলেন, তা সরকার বিলম্বে বুঝতে পেরেছে। সম্প্রতি এক উপ-মহাপরিদর্শক, চার পুলিশ সুপারসহ ২৪ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার এবং তাদের মধ্যে ১৭ জন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ১৮ কর্মকর্তার ওপর নজরদারি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে (সেটি বাস্তবায়নে পুলিশ কর্তৃপক্ষের গড়িমসি সরকারের দুর্বলতার আরেক দিক)। এ থেকে প্রতীয়মান যে, পূর্ব পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণে আন্তরিক না হওয়ায় পুলিশ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারেনি। উপরন্তু আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে, জীবনও দিতে হচ্ছে তাদের।
অন্যদিকে সহিংসতা মোকাবেলায় পুলিশ কোনো কোনো ক্ষেত্রে যা করেছে, তাও সমর্থনযোগ্য নয়। পুলিশ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেছে নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করেই। কোনো উচ্ছৃঙ্খল দলকে ছত্রভঙ্গ করার ক্ষেত্রে প্রথমে রাবার বুলেট এবং নিরুপায় হয়ে গুলি করলে তা পায়ে করার কথা। সিংগাইরসহ কতিপয় স্থানের ঘটনা পর্যালোচনা করলে তার ব্যত্যয় দেখা যায়। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে কেবল জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাই নয়, সাধারণ মানুষও পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন।
অপরাধী হোক আর নিরপরাধীই হোক, নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। এমনকি পুলিশের ওপর হামলাকারী জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের প্রতি নির্বিচারে গুলি করার প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত। বরং কত কম রক্তপাতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়, সেটিই হবে পুলিশের বিবেচ্য। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের ঘটনার পর বাড়িঘর, দেবালয় ধ্বংসের যে ঘটনা ঘটেছে, তা অবহিত করার পর পুলিশ বাহিনী ছুটে যাওয়া কিংবা দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ওইসব দুর্বৃত্তকে কার্যকরভাবে চিহ্নিত করা এবং গ্রেফতারে পুলিশের আন্তরিক ভূমিকা দেখছি না।
এসব থেকে ধারণা করা যায় যে, পুলিশ বাহিনীর ভেতরে গলদ রয়েছে। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা ধারণের বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে। যদি দেশের পুলিশ ও প্রশাসন অসাম্প্রদায়িক না হয়, পুলিশের কোনো সদস্য জামায়াতে ইসলামীকে যদি ইসলাম মনে করে, তবে সে গলদ দূর না করে সুশাসনের পথে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আমার মনে হয়, ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী দলগুলো যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, এ ব্যাপারে পুলিশকে কখনও মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়নি। পুলিশের সেই বোধ জাগানো হয়নি যে, দেশটি কেবল মুসলমানদের নয়_ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানরাও দেশের সমমর্যাদার নাগরিক। ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষ সব মানুষের জানমাল রক্ষা করা পুলিশের কর্তব্য। আর পুলিশ কী করেই-বা এমন মূল্যবোধ ধারণ করবে? এ দেশে তো কখনোই সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচারের জন্য কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। বরং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীরা সমাজে বুক উঁচিয়েই আছে এবং তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বহাল তবিয়তে আছে।
পুলিশ সদস্যদের জন্য আজ কার্যকর দিকনির্দেশনা প্রয়োজন, তারা কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবে? পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, পুলিশের বসে থাকার সুযোগ নেই। যারা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর-মন্দির ধ্বংস করেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র গুঁড়িয়ে দিয়েছে, ট্রেনের বগিতে আগুন দিয়েছে, রেললাইন তুলে ফেলেছে, জাতীয় পতাকা পায়ে মাড়িয়েছে, শহীদ মিনার ভেঙেছে, প্রতিনিয়ত গাড়িতে আগুন দিচ্ছে, ভাংচুর করছে, তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। পুলিশ বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় হাজার হাজার মানুষকে আসামি করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে তিনটি মামলায় ৫০০ লোকের নাম উল্লেখ করে ১৫ হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এ বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন দেওয়া বা সহিংসতা চালিয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর পাইকারি গ্রেফতার অভিযানও সমর্থনযোগ্য নয়। পাইকারি গ্রেফতার অভিযানের পেছনে দুর্নীতির যোগ থাকে। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে_ দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাতপরিচয়ের তালিকায় নতুন নতুন নাম বসিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে। টুপাইস কামিয়েছে পুলিশ। এমন অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়া হাজার হাজার লোককে আসামি করার কোনো যুক্তি দেখি না। উল্লেখ্য, ৫ নভেম্বর থেকে ১৯ মার্চ ৩৬০টি মামলায় অজ্ঞাত আসামি কয়েক লাখ (সমকাল ৩১ মার্চ ২০১৩)। বিপজ্জনক হচ্ছে, জামায়াত-শিবির এটিকে কাজে লাগিয়ে গ্রামবাসীকে উস্কিয়েছে। শিবগঞ্জে আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশ বিপাকে পড়ার কারণ এটিই। জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে গ্রামবাসীও যোগ দেয় এবং পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সৃষ্ট সংঘর্ষে তিনজন প্রাণ হারায়। অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতেও। সেখানে জামায়াত-বিএনপি ও গ্রামবাসীর মধ্যে সৃষ্ট সংঘর্ষে প্রাণ হারায় দু\’জন।
পুলিশের এ ধরনের যাবতীয় ভ্রান্ত পদক্ষেপ অবশ্যই পরিত্যাজ্য। গণআসামি করে নয়, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেফতারে অগ্রসর হওয়া দরকার। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে সম্পৃক্ত না করে কেবল পুলিশের পক্ষে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।